• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ২, ২০২১, ১১:১১ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ২, ২০২১, ১১:৩২ এএম

শতবর্ষে সত্যজিৎ

সত্যজিৎ রায় ছিলেন আমার অভিভাবকতুল্য: ববিতা

সত্যজিৎ রায় ছিলেন আমার অভিভাবকতুল্য: ববিতা

বাংলার আন্তর্জাতিক পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ববিতার চলচ্চিত্রিক যোগসূত্র আছে। পশ্চিমবঙ্গের এই পরিচালকের হাত ধরে নিজেই আন্তর্জাতিক অভিনেত্রী আত্মপ্রকাশ করেছিলেন বদ্বীপের সাড়া জাগানো নায়িকা ববিতা। তাই এপার বাংলায় সত্যজিৎ প্রসঙ্গ এলেই তার দ্বারস্থ হতে হয়। বিশেষ করে জন্মদিন কিংবা মৃত্যুদিনে। ববিতাও মুখিয়ে থাকেন সত্যজিৎকে নিয়ে কিছু বলতে। তার কাছে এটি একটি গর্বের বিষয়। তিনি নিজেকে ‘হিরোইন অব সত্যজিৎ রায়’ মনে করেন।  

১৯৭৩ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল ববিতার। তখন টলিউড, বলিউডের নামকরা নায়িকারা সত্যজিতের ছবিতে অভিনয়ের জন্য ধরনা ধরতেন। কিন্তু তাদের রেখে তিনি আস্থা রেখেছিলেন ববিতার ওপর। তখন ছবির বিষয়ে কথাবার্তা বলতে কলকাতা থেকে চিঠি এসেছিল ববিতার ঢাকার গেণ্ডারিয়ার বাড়িতে। যদিও এই চিঠি প্রথমে অবিশ্বাস করেছিলেন তিনি। 

সত্যজিৎ রায় ডট অর্গ

ববিতার ভাষ্য, “১৯৭২ সালের ঘটনা। ‘অশনি সংকেত’ নামে একটি যুদ্ধবিরোধী ছবি নির্মাণের কাজ হাতে নিলেন সত্যজিৎ রায়। সেই সিনেমার জন্য নায়িকা খুঁজছিলেন তিনি। তার ক্যামেরাম্যান নিমাই ঘোষ ঢাকায় এসে আমার দুই শ ছবি তুলে নিয়ে গেলেন। তখন আমার বয়স ১৬ বছর। এরপর অনেক দিন পর হঠাৎ আমাদের বাসার ঠিকানায় আমার নামে একটি চিঠি এলো। চিঠির বিষয় ছিল, সত্যজিৎ রায়ের মতো বিখ্যাত পরিচালকের সঙ্গে ছবির ব্যাপারে দেখা করতে যেতে হবে ভারতে। চিঠি পড়ে হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে প্রায় পড়েই গিয়েছিলাম। বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, কেউ বুঝি মজা করার জন্য অমন চিঠি লিখেছেন।”

তারপর বিশ্বাস হলো কীভাবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কিছুদিন পর বাংলাদেশের ভারতীয় দূতাবাস থেকে বাসায় ফোন করে আমাকে আবারও বলা হয়, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে। তখন আমরা সবাই সিরিয়াস হলাম। ভাবলাম, ওটা মজা ছিল না, সত্যি ছিল। তারপর সুচন্দা আপাকে নিয়ে কলকাতায় যাই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে।”

সত্যজিৎ রায় ডট অর্গ

ববিতা জানালেন টলিউডের ইন্দ্রপুরির স্টুডিওতে সত্যজিতের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় তার। প্রথম দেখায় অনেক প্রশ্ন করা হয়েছিল তাকে। ববিতা বলেন, “স্টুডিওতে নানা প্রশ্ন করলেন তিনি। এরপর তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমি অনঙ্গ বৌ পেয়ে গেছি’। একসময় স্ক্রিপ্ট হাতে পাই। তারপর ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া হয়। সাধারণ একটি শাড়ি পরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই। সত্যজিৎ রায় বলেন, ‘মেয়েটি তো দারুণ ফটোজেনিক’। এরপর বাকি ইতিহাস তো সবারই কমবেশি জানা। সিনেমা মুক্তি পেল। আমার পরিচিতি হলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।”

আজ এই সময়ে এসে শুটিংয়ের সেই দিনগুলোর কথা ভেবে নস্টালজিক হয়ে যান ববিতা। তিনি বলেন, “শান্তিনিকেতনে শুটিং করার দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। বিশেষ করে শান্তিনিকেতনে যে বাড়িটিতে শুটিং করেছিলাম, সেই বাড়িটির কথা এবং শুটিং করার কথা এবং শুটিং করার ফাঁকে আড্ডার সময়ের কথাগুলো খুব মনে পড়ে।”

অশনি সংকেত - উইকিপিডিয়া

‘অশনি সংকেত’ বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটিকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘গোল্ডেন বিয়ার’ অর্জন করে। এটিকে জীবনের সেরা প্রাপ্তি হিসেবে মনে করেন ববিতা। তার কথায়, “শুটিং-ডাবিংয়ের শেষের দিকে একদিন সত্যজিৎ রায়ের ফোন এলো। তিনি জানালেন, ছবিটি নিয়ে তিনি জার্মানির একটি চলচ্চিত্র উৎসবে যাবেন। তাও মুক্তির আগেই ছবিটি দেখানো হবে বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। আমাকে নিমন্ত্রণ করা হলো। আমি তো মহাখুশি! আমার সিনেমা যাচ্ছে এতো বড় একটি দেশের উৎসবে! রাজি হয়ে গেলাম। সেখানে সিনেমাটিকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘গোল্ডেন বিয়ার’ দেওয়া হয়। সত্যজিৎ রায়ের নামের পাশাপাশি আমার নামটিও সবাই জানলেন। ওটা ছিল বিরাট প্রাপ্তি।”

 

শতবর্ষে সত্যজিৎ। তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? প্রশ্নের উত্তরে ববিতা বলেন, “আমার জীবনের সেরা ঘটনা সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করা। তার মতো একজন পরিচালকের মূল্যায়ন করা আমার শোভা পায় না। তবে তাকে কাছ থেকে যেভাবে দেখেছি তাতে বলতে পারি, তিনি অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলতেন। তিনি কখনো রোদে শুটিং করতেন না। সেটগুলো এমনভাবে সাজাতেন যেন সবকিছু জীবন্ত। গ্রামের ধানক্ষেত, চালের ওপর লাউ, পাখির খাঁচা একেবারে অন্যরকমভাবে ফুটিয়ে তুলতেন পর্দায়। কেউ কিছু না পারলে শান্তভাবে বলতেন, ‘তোমার কাজ ভালো হয়েছে, তবে আমি আবার শট নিতে চাই’। নিজেই ক্যামেরা চালাতেন এবং স্ক্রিপ্টের ডান পাশে শটের ছবি এঁকে রাখতেন। আমার কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবকতুল্য।”

১৯৯২ সালের ২ মে ইহলোক ত্যাগ করেন সত্যজিৎ রায়। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাকে দেখতে কলকাতা গিয়েছিলেন ববিতা। শুধু চোখের দেখাই দেখতে পেরেছিলেন তাকে। শেষ কথা বলা হয়নি। কারণ তখন তিনি এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে, কথা বলতে পারতেন না।