• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ১৬, ২০১৯, ০৬:৩৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১৬, ২০১৯, ০৬:৩৫ পিএম

মধুপুর গড় : বিপন্ন  প্রাণবৈচিত্র্য

মধুপুর গড় : বিপন্ন  প্রাণবৈচিত্র্য

মধুপুর গড় এলাকার গাছপালা উজাড় হচ্ছে জ্বালানি চাহিদা মেটানো  প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। গড় এলাকায় আর আগের মতো । বনবাসী লোকদের চেয়ে এখানে বাড়ছে বহিরাগত লোকসংখ্যা। জনবসতি বাড়াতে ধংস হচ্ছে বনাঞ্চল । হারাচ্ছে বন্য প্রানী। অজস্র কীটপতঙ্গসহ বহুপ্রজাতির পাখি যেমন ঈগল, কাঠঠোকরা, শালিকসহ অনেক পাখি। প্রানীকূলের মধ্যে খোরগোশ, বেজি, বনবিড়াল, খাটাশ, গুইসাপ, সজারু , বাঘডাসা, মেছোবাঘ, কাকলাস,তক্ষক, ব্যাঙ-ব্যাঙাচি, ইঁদুর শিয়াল, এখন আরচোখে পড়ে না।

ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশে দেখা দিচ্ছে বিরূপ প্রভাব। যেভাবে গ্রামীণ জনপদের জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে পরিবেশের ভারসাম্য ক্রমশ হারিয়ে যাবে। বায়ু মন্ডল উত্তপ্ত হবে। বসবাস কষ্টকর হয়ে পড়বে। আর এর সাথে দেখা দেবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রাণ বৈচিত্র্যের বিষয়টি একদম আলাদা। পৃথিবীতে একটি প্রানী-পতঙ্গ নেই যা অকারনে জন্ম নিয়েছে। সবাই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করছে। এটা না বুঝেই প্রান বৈচিত্র্য ধংস হচ্ছেই।

মধুপুর গড় অনেক বড় বনাঞ্চল। এখানের ভূমির রূপকে স্থানীয় বসবাসকারি মানুষেরা ৩ ভাগে ভাগ করে কাজ করে থাকেন। উঁচু ভূমি বা বন এলাকা। নিচু ভূমি বা জলাশয় এলাকা আর বনের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত লাল মাটির খালেরমতো সরু স্থানকে বাইদ নামে অভিহিত করে থাকে। চারদিকে বনবেষ্টিত স্থানকে স্থানীয়রা চালা নামে অভিহিত করেছেন। মধুপুর গড়ের আউশনারা, অরণখোলা ও শোলাকুড়ি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে পরিদর্শনে গিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মধুপুর গড়ের চালা ভূমি এলাকা বাদে সমতল ভূমির গ্রামীণ এলাকায় ছোট বড় ঝোপ - ঝাড়ে যে সব প্রাণীগুলো ছিল তা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। জ্বালানি সংগ্রহ, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত অর্থ সংকটে পড়ে এসব ঝোপের গাছগুলো বিক্রি করার কারণে এসব ঝোপ ঝাড়ে যে সব প্রাণীরা বসবাস করত তা আজ অনেকটা কমে গেছে। কারন পরিবেশের কারনে তাদের সংখ্যা কমেছে কমেছে বংশ বিস্তার।  যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার করার কারণে আলাদা বাসস্থান করতে গিয়ে ঘরের আসবাবপত্র ও বাড়ির ঘর উঠানো জায়গা করতে গিয়ে এসব ঝোপ বিক্রি করতে হচ্ছে। ঝোপ ঝাড় কমার কারনে দিন দিন কমে যাচ্ছে গ্রামীণ জনপদের প্রাণিকুল।

এক সময় মধুপুরের পাহাড়িয়া এলাকায় দিনেই শিয়াল ডাকত। দিনের বেলায় হাঁস-মুরগি ধরে নিয়ে যেত শিয়ালের দল। স্থানীয়রা শিয়ালের ভয়ে ছাগল, হাঁস-মুরগি নিরাপদ স্থানে রাখত। এখন গভীর রাতে কচিৎ শিয়ালের ডাক শোনা যায় । সংখ্যা কমে আসছে। বনের মধ্যে মানুষের বিচরণ বেড়েছে। বন্য প্রানীর খাবার কমেছে। খাবারের জন্য লোকালয়ে গেলে মানুষের হাতে প্রান দিতে হয়। গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে কুকুর ছিল। এখন আধুনিক জীবনযাপনের কারণে আগের তুলনায় অর্ধেক বাড়িতেও কুকুর পোষা হয় না। দিন দিন কুকুরে সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।

বিড়াল ও কমে গেছে। মধুপুর গড় এলাকার সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ত কাঁঠবিড়ালী। আম, জাম, কাঠাল কলা পেপে পেয়ারা গাছে চোখ মেলে তাকালেই চোখে পড়ত এ চটপটে প্রাণীটির বিচরন। বনে তো কোনো কথাই নেই। এক সময় প্রচুর পরিমানে কাঠ বিড়ালী পাওয়া যেত। ফল ফসলে হরমোন কীটনাশক প্রয়োগের ফলে ও গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে কাঠ বিড়ালী ও কমে গেছে। এভাবে  গ্রামীণ জনপদের প্রাণবৈচিত্র্যের প্রাণীগুলো ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

 এক সময় মধুপুর গড়ের লাল মাটিতে অনেক বড় বড় গাছের ঝোপ- ঝাড় ছিল। ছনের বাগানে ছিল ভরপুর। এসব চালার মধ্যে কোন চাষাবাদ করা হতো না। গ্রামীণ যেসব প্রাণীরা ছিল তারা অবাদে বিচরণ করত। জ্বালানি প্রয়োজন ও ইটভাটার লাকড়ির জন্য এসব চালার গাছ কেটে সাবার করার ফলে গ্রামীণ প্রাণীরা আবাসস্থানের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে গায়রা গ্রামের সুষ্ময় নকরেক জানান, এক সময় বিশাল আয়তনের এ মধুপুর গড়ের বনের পাশাপাশি ব্যাপক পরিমাণে আনারসের বাগান ছিল। আনারসের বাগানে অনেক বড় বড় কাঁঠাল, আম, জাম, গাছ ছিল, ছিল গজারি গাছ। এসব গাছে বসবাস করতো হরেক রকমের পাখি আর বাগানে বিচরণ করতো খরগোশ,শিয়াল, ইঁদুর, সজারু, বাঘাইলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আধুনিক চাষাবাদের কারণে আনারস বাগানের ফলে ব্যবহার করা হচ্ছে হরমোন কীটনাশক। এসব বিষাক্ত ফল খেয়ে গ্রামীণ প্রাণীরা মরে যাচ্ছে।

সুধীর বর্মণ জানান, মধুপুরের ঝোপঝাড়ে প্রচুর খরগোশ পাওয়া যেত। আদিবাসী  কোচরা আনারস বাগান ও ঝোপ ঝাড়ের জাল পেতে খোরগোশ ধরতো। শিকারকৃত খরগোশের মাংস খেয়ে তারা আমিষের চাহিদা পূরণ করত। ঝোপ ঝাড় ও বাগান কমে যাওয়ার কারণে এখন আর খরগোশ আগের মতো পাওয়া যায় না। শোলাকুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন জানান, মধুপুরের প্রত্যেক গ্রামে গ্রামীণ জনপদের শোভাবর্ধণ করত অনেক প্রাণী। আগের সেই দিন এখন আর নেই। গ্রামীণ পল্লী প্রকৃতির শোভা পাওয়া প্রাণীরা আজ বিলুপ্তির পথে। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য
রক্ষার জন্য গ্রামীণ জনপদে এসব প্রাণীর প্রয়োজন।

বনবাসী গারো অধিবাসীরা জানান, যেভাবে গ্রামীণ জনপদের জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অযথা প্রাণী হত্যা ও খাওয়ার অপরাধ থাকলেও
তা কেউ মানছে না। প্রতিনিয়তই  প্রাণী নিধন হচ্ছে। মানুষের মানবিকক গুনাবলী হারিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার
জন্য  এসব প্রাণবৈচিত্র্যকে ধরে রাখার বিকল্প নেই। এজন্য পরিবেশপ্রেমী, সমাজসেবক, সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা জরুরি।