• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২০, ০৭:৩৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ২৭, ২০২০, ০৭:৩৮ পিএম

মানব সভ্যতার নিষ্ঠুরতা : প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও  মহামারি

মানব সভ্যতার নিষ্ঠুরতা : প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও  মহামারি
- সুবর্না তালুকদার

প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানবসভ্যতার যুদ্ধ অনেক প্রাচীন। এই যুদ্ধে মানুষ অনেকাংশেই জয়ী হলেও পুরোপুরিভাবে জয়ী বলা যায় না। প্রকৃতিও সুযোগ পেলেই ক্ষমতার জানান দিয়ে যায়। এটাকে প্রকৃতির প্রতিশোধও বলা যায়। প্রকৃতি যখন প্রতিশোধ নেয়,তখন মানুষ তার কাছে অসহায়। তবুও বিপর্যয় কেটে গেলে মানুষ আবারও প্রকৃতির উপর তাদের নির্মম শোষণ অব্যাহত রাখে।

মানুষের এহেন নিষ্ঠুরতার ফলে জলবায়ু, প্রাকৃতিক পরিবেশ এমনকি মানবস্বাস্থ্যও প্রতিনিয়ত হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। মানুষের অসহায়ত্ব খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায় যখন  করোনা মহামারির মতো নতুন নতুন অদৃশ্য সব  জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কোন অস্ত্র না থাকায় তাদের ঘরবন্দী জীবনযাপন করতে হয়।  যুগে যুগে নিত্য নতুন রোগ-জীবাণুর জন্ম হচ্ছে এবং উন্নত অনুন্নত নির্বিশেষে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে একেকটা ভয়ংকর মহামারি আঘাত হানছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা,ভেঙ্গে পড়ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাত সর্বোপরি ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।

এর দায় তো কিছুটা হলেও মানুষকেই নিতে হয়!

প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক: প্রকৃতি ও মানুষ একে অপরের পরিপূরক। শরীরের কোন অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে যেমন সর্বত্র সমান ব্যথা অনুভূত হয়,ঠিক তেমনি প্রাকৃতিক পরিবেশের কোন একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ভারসাম্যহীনতা দেখা দিলে জীবজগতের সবকিছুর উপরই তার প্রভাব পড়ে। তাই মানুষকে ভুলে গেলে চলবে না যে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর সবার সমান অধিকার রয়েছে। আর একথা ভুলে গেলেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং সেই সাথে বন্যপ্রাণী সংস্পর্শে ছড়িয়ে পরা সংক্রামক ব্যধিসমূহ মহামারিরূপে মানুষের সাথে স্থায়ী নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারে।  

প্রকৃতিতে মানুষের বিচরণ যেমন নতুন নয় বহু প্রাচীন ঠিক তেমনই সংক্রামক রোগ ও মহামারির ইতিহাসও অনেক প্রাচীন। প্রকৃতি চিরকালই বিনিময় হিসেবে কোন কিছু প্রত্যাশা না করেও মানবসভ্যতাকে খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থানের উপকরণসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে চলেছে। এই প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাবে এবং শিকারের প্রয়োজনে বানর সদৃশ প্রাণী থেকে ক্রমান্বয়ে মানুষের বিবর্তন, হাটতে চলতে অবশেষে দৌড়াতে শেখা। মনব সভ্যতার উন্নয়নের সেই দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রাকৃতিক পরিবেশই আজ সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত।

প্রাচীনকালে সমৃদ্ধ জনপদগুলো নদ-নদী প্লাবিত সমতলভূমিতে গড়ে উঠত। যুগে যুগে এসব নদ - নদী মানুষের জীবন ও জীবীকার প্রয়োজন মিটালেও মানব সভ্যতার উন্নয়নের নামে নদী ভরাটসহ নানা অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়েছে এই মানুষই । প্রতিনিয়ত করে চলেছে পানি,বায়ু, শব্দ প্রভৃতির দূষণ। যার ফলে প্রতি শতাব্দীতে পৃথিবীতে সংঘটিত হচ্ছে এক একটা ভয়ংকর মহামারি।

প্রাকৃতিক পরিবেশে নেতিবাচক পরিবর্তনের মানবসৃষ্ট কিছু কারণ: সতের শতকে সংঘটিত  শিল্প বিপ্লব, পরবর্তী ৪০০ বছরে প্রকৃতি ও পরিবশের অপরিসীম ক্ষতিসাধন করেছে। যান্ত্রিক সভ্যতা মধ্যযুগীয় মানবতাবাদের অবসান ঘটালে প্রাকৃতিক বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করে।তবে প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তন, সংক্রামক ব্যধি ও মহামারীর ঘটনা প্রাগৈতিহাসিক কালেও ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান যেমন- মানব কঙ্কাল,দাঁত,মাথার খুলি প্রভৃতির বিশ্লেষণে যার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে।  

  • জীববৈচিত্র্যের  ও বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতিসাধন প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিবর্তনের অন্যতম একটি কারন।
  • বনভূমি উজাড়,বনাঞ্চলে অগ্নিকান্ড,জীবজন্তুর বাসস্থান ধ্বংস করে বসতবাড়ি, শিল্পকারখানা নির্মাণ।
  • বিলুপ্তপ্রায় বণ্যপ্রাণী খাদ্যদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার ও তাদের চলাচলে বাধার সৃষ্টি ।
  • অবৈধ উপায়ে পাহাড় কর্তন।
  • নদীভরাট,প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর বর্জ্য নিক্ষেপের ফলে নদীর স্বাভাবিক নাব্যতা হ্রাস।
  • পলিথিন জাতীয় ক্ষতিকর দ্রব্যের বিপুল ব্যবহার।
  • বিজ্ঞানী ও আবহাওয়া বিশারদদের হাজারো নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সমুদ্রে প্রায় প্রতি বছর আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরীক্ষা -নিরীক্ষা চাালনো।

এগুলো একদিকে যেমন প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে তেমনি মানুষের স্বাস্থ্যঝুকিও বৃদ্ধি করছে। পাশাপাশি মানুষের গড় আয়ুর উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। প্রাচীনকালে বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির অভাবে মানুষ মারা যেত,বর্তমানে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার ও তার ক্ষতিকর প্রভাবে হৃদরোগ,মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণসহ নানান রোগে মানুষের মৃত্যুহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ইতিহাসের উৎসসমূহ বিশ্লেষণ করলে জলবায়ু তথা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে । উপমহাদেশের তথা বংলার জলবায়ুকে ষুয়ান জাং নাতিশীতোষ্ণ বলেছিলেন। ধোয়ীর ‘পবনদূত’ কাব্যে ফাল্গুন- চৈত্র্য মাসের দক্ষিণা হাওয়া তথা ‘মলয় পবনের' বর্ণনা পাওয়া যায়। লক্ষণসেন যখন দিগ্বিজয়ের উদ্দেশ্যে দক্ষিণ ভারতে গমন করেন তখন কুবলয়বতী নামে মলয়পর্বতের এক গন্ধর্বনারী তার প্রতি প্রেমাসক্ত হন । বসন্তের আগমনে কুবলয়বতী লক্ষণ সেনের বিরহ সহ্য করতে না পেরে বসন্ত পবনকে দূত হিসেবে প্রেরণ করেন । এই কাহিণীতে বাংলার বসন্তকালীন পবন প্রবাহের ইঙ্গিত রয়েছে।

বর্তমান সময়ে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ব্যতীত বাংলায় আর কোন ঋতুর উপস্থিতি তেমন অনুভূত হয় না বললেই চলে।

প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস ও সাহিত্যে মহামারি: ভারতীয় উপমহাদেশে মহামারির অভিজ্ঞতা অনেক প্রাচীন। মহামারির এই সংকটকালে ইতিহাসপাঠের সেসব অভিজ্ঞতা পথনির্দেশের মাধ্যমে মানবজাতির সামনে আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখা দিতে পারে। খ্রিস্টপূর্ব যুগেও উপমহাদেশেসহ পৃথিবীতে মানুষ অসংখ্যবার মহামারির সম্মুখীন হয়েছে। আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে মানব সভ্যতা,বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি কম থাকলেও তখনও বৈশ্বিক মহামারি মানুষ মোকাবিলা করেছে । আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সচেতন ও সতর্ক থেকেছে।এখনকার মত ‘আইসোলেশন', ‘কোয়ারেন্টাইন’ শব্দসমূহ প্রাচীনকালে অপরিচিত থাকলেও তখনও সংক্রামক রোগের বিস্তাররোধে মানুষ আলাদা থেকেছে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের সেসব শিক্ষাই আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিশ্বজুড়ে এই প্রথম প্রায় ২২০ এর কাছাকাছি দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারি ও মানুষের অসহায়ত্ব আবার প্রাচীন ইতিহাসের সেই দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়।

প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানে সংক্রামক রোগ ও মহামারির প্রমাণ: সিন্ধু সভ্যতায় খননে প্রাপ্ত মানব কঙ্কালে যক্ষার জীবাণু পাওয়া গেছে।

  • রাজস্থানে প্রাপ্ত ২০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের মানব করোটিতে কুষ্ট রোগের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
  • জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত কালো পাথরের পর্ণশবরী ভাস্কর্যের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। ভাস্কর্যটিতে দেখা যাচ্ছে দেবী তার দুপায়ে দুটি রোগাক্রান্ত মরাদেহ পিষ্ট করছে, মরাদেহ দুটির গায়ে বসন্তের দাগ সুস্পষ্ট।

ইতিহাসের উৎস হিসেবে মহামারি:
ঐতিহাসিক বিভিন্ন উৎসে মহামারির দেব-দেবীর উল্লেখ রয়েছে । খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে সুমেরে ( বর্তমান ইরাক) প্লেগ মহামারির দেবতা ‘নারগল' এর পূজা করা হত।বাংলায় বসন্তের দেবী ‘শীতলা’ও কলেরা মহামারির দেবী ‘ওলা' র ইতিহাস বহুল প্রচলিত। সাহিত্য গ্রন্থে এসব দেব দেবীর নাম আজও টিকে আছে। ইবনে বতুতার বর্ণনায় বাংলায় মহামরি সংঘটনের উল্লেখ রয়েছে,তবে সেটা কলেরা নাকি প্লেগ তার উল্লেখ নেই। মোগল ইতিহাস গ্রন্থ ‘তুজুক- ই- জাহাঙ্গীর’ এ সম্রাটের এক আমিরের স্ত্রীর ভাষ্যে বাংলায় সংক্রামক রোগের প্রকোপের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে রোগাক্রান্ত একটি ইঁদুর শিকার করে একটা বিড়াল মারা গেলে বিড়ালটির সংস্পর্শে আসা সকলে একে একে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয় এবং সেই আমির পত্নী নিজেকে রোগ থেকে বাঁচাতে প্রাসাদ ছেড়ে আমবাগানে থাকতে শুরু করেন।

সাহিত্যে সংক্রামক রোগ ও মহামারির বিবরণ: বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বসন্ত মহামারির বিবরণ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘চতুরঙ্গ' উপন্যাসে প্লেগ রোগের  ছড়িয়ে পড়ার বর্ণনা করেছেন। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত' উপন্যাসে ভারতবর্ষ থেকে বার্মা যাওয়ার পথে জাহাজে উঠার আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে যার বর্তমান সময়ের সাথে অনেক মিল রয়েছে। ‘পন্ডিতমশায়’ উপন্যাসে গ্রামের একমাত্র পানীয় জলের উৎস পুকুরে কলেরা রোগীর  কাপড় ধোয়ায় পুরো গ্রামে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার কথা বলা হয়েছে ।অর্থাৎ এসব রোগ জীবাণু অনেক আগে থেকে মানুষের সাথে বসবাস করে আসছে, যে কারণে সাহিত্যেও এর বর্ণনা উপস্থিত।মহামারির শিক্ষা: পৃথিবীর উৎপত্তি সংক্রান্ত ইতিহাসের শিক্ষা যা বলে তাতে পৃথিবী সৃষ্টির পর প্রথমে উদ্ভিদ,পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রাণী এবং সবশেষে মানুষের আগমণ।তাই পৃথিবীতে মানুষসহ সকল প্রাণীর বসবাসের সমান অধিকার থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই সত্যিটা অস্বীকার করে যতবার মানুষ পৃথিবীতে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে ততবারই প্রকৃতি পাল্টা প্রতিশোধ নিয়েছে। এ যেন প্রকৃতির অদৃশ্য লড়াই !

এই লড়াইয়ের বিনিময়ে অল্প সময়ের জন্য হলেও মানব সভ্যতাকে অস্ত্র (ভ্যাক্সিন) তৈরির প্রচেষ্টায় ব্যস্ত রেখে, প্রকৃতি ও জীবজন্তু তাদের নিজস্ব আলয়ে বিচরণের অপরিসীম আনন্দ উপভোগ করছে। জনাকীর্ণ শহরে পাখির কলরব,কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ডলফিনের নাচা-নাচি,আকাশপথ কয়েকমাস কম ব্যবহৃত হওয়ায় আকাশের নীলরঙা সৌন্দর্যের বাহার যেন প্রকৃতির সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রতিফলিত হচ্ছে ।যেন চিৎকার করে বলতে চাচ্ছে এখনও সময় আছে,উন্নয়নের নামে নিষ্ঠুরতা বন্ধ করো।যদি এখনও প্রকৃতির প্রতি সুবিচার করা না হয় তবে একদিন সমুদ্রের পশ্চাদপসারণ এবং নদীবাহিত পলি দ্বারা সৃষ্ট এই ব-দ্বীপের অধিকাংশ যে আবার সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে না তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই!

শিক্ষার্থী (এম. এ), ইতিহাস বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।