• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২২, ২০১৯, ০৫:০০ পিএম

ব্রেক্সিট: টিউলিপও ভোট দিতে গিয়েছিলেন

ব্রেক্সিট: টিউলিপও ভোট দিতে গিয়েছিলেন

 

১৯৭৩ ইউরোপ এবং ইউকে যুক্ত হয়েছে এবং ২০১৬ সালের গণভোটের আগ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের ঐতিহাসিক ভোটের পর বেক্সিট কীভাবে হলে ভাল হয় তা নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে রাজনৈতিক মহলে । বেক্সিট কেন্দ্র করে বিদায় নিতে হয়েছিল ডেভিড ক্যামরনকে, এরপর দায়িত্বে এসেছেন থেরেসা মে। দায়িত্বভার পাওয়ার পর থেকে বেক্সিট ইস্যু নিয়ে প্রায় প্রতিদিনের আলাপ আলোচনা এবং বিভিন্ন বৈঠকের মাধ্যমে যে খসড়া চুক্তি প্রস্তাবিত ছিল সেই চুক্তিটি গত ১৫ জানুয়ারী পার্লামেন্টের ভোটাভুটিতে হেরে যায়। তবে যে বিশাল ব্যবধানে খসড়া প্রস্তাবটিতে হেরেছে তাতে থেরেসা মের নিজ দলের ১১৮ জন এমপি খসড়াটির বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। চুক্তিটির বিপক্ষে ভোট পড়েছে ৪৩২ এবং পক্ষে ছিল ২০২ টি। এটি বিস্মিত করেছে গোটা বিশ্বকে। এত ব্যাপক ব্যবধানে হেরে যাওয়ার পর বিরোধী দল আঙ্গুল তুলেছে থেরেসা মের দিকে এবং পরদিন অর্থাৎ বুধবার ডাকা হয় অনাস্থা ভোটের। এতে অংশগ্রহণ করেন ৬৩১ জন এমপি, তারমধ্যে থেরেসা মে’র সরকারের প্রতি সমর্থন জানান ৩২৫ জন এমপি এবং অনাস্থা জানান ৩০৬ জন, ১৯ ভোটের ব্যবধানে টিকে যায় থেরেসার সরকার। বিরোধীদল যতই থেরেসা মে কে অযোগ্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করুক না কেন, অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, পার্লামেন্ট সদস্যরা থেরেসা মের সরকার পরিবর্তন চায় না , তারা চায় খসড়া চুক্তির পরিবর্তন অথবা দ্বিতীয় গণভোট।
উল্লেখ্য যে, ১৫ জানুয়ারি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভোট দিতে এসেছেন টিউলিপ সিদ্দিকীও। অসুস্থ শরীর নিয়ে ভোট দিতে এসেছেন, যা নজর কেড়েছে পার্লামেন্ট সদস্য থেকে শুরু করে সব মিডিয়ার। হ্যামস্টেট এবং কিলবার্নের এম পি টিউলিপ সিদ্দিকী যিনি ভোটের দিন প্রমাণ করেছেন তার ব্যক্তিগত জীবনের থেকে দেশ এবং দেশের মানুষের মূল্য তার কাছে অনেক, ঠিক তার নানার মত তার দেশ প্রেম এবং মানুষের প্রতি তার ভালবাসা দেখে বিস্মিত হয়েছেন অনেকে। গর্ভকালীন নানা জটিলতার কারণে ডাক্তার তাকে সিজার করার ডেড দিয়ে ছিল ১৪/১৫ জানুয়ারী, কিন্তু তিনি ডাক্তারকে অনুরোধ করে দুই দিন পিছিয়েছেন পার্লামেন্টের ভোটের জন্য। শুধু ভোট দিয়ে উনি চলে যাননি, ভোটের ফলাফলের পর পার্লামেন্টে যে আলোচনা হয়েছিল তাতেও তিনি হুইল চেয়ারে বসে অংশগ্রহণ করেছেন।
তবে ১৫ জানুয়ারী যারা বিপক্ষে ভোট দিয়েছে তাদের রয়েছে নানা ধরণের ব্যাখ্যা: ‘ফ্রি মুভমেন্ট অপ পিপলস্ ’ বা দুই পক্ষের যে অবাধ যাতায়াত তা আর থাকবে না। বেক্সিট কার্যকর হওয়ার পর ঝক্কি-ঝামেলা বেড়ে যাবে বহুগুণ , ব্রিটেন এবং ইইউ উভয়ের যাতায়াতের ক্ষেত্রে শুরু হবে ভিসা প্রক্রিয়া, কাস্টমস চেকিং এবং সীমন্তে ব্যবস্থা করা হবে কঠোর পাহারা । বিরোধী দলের যুক্তি, ব্রিটেন কখনই ইইউ থেকে আলাদা হতে পারবে না , কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারবে না ইইউ’র সম্মতি ছাড়া এবং ইইউকে ব্রিটেনের চাঁদা দিয়ে যেতেই হবে। ব্রিটেন থেকে যে সব অভিবাসী ইইউতে কর্মরত রয়েছেন এবং ইইউতে থেকে যে সব অভিবাসী ব্রিটেন কর্মরত রয়েছেন, তারা উভয়ই ভিসা , ওয়ার্ক পারমিট সংক্রান্ত জটিলতায় পড়বে বেক্সিট কার্যকর হওয়ার পর। ব্রিটেনে অনেক ব্যবসা গড়ে উঠেছে ইইউ ভিত্তিক। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসার কারণে সেইসব পণ্যের দামও অনেক কম। বেক্সিট কার্যকর হলে বেড়ে যাবে পণ্যের দাম এবং ব্রিটেন পণ্যের সংকটে পড়বে একদিকে , অন্যদিকে কর আরোপ করা হবে চড়া।
কিন্তু মে বলছেন অন্যকথা, বেক্সিটের পর বন্ধ হবে ইইউ’র নাগরিকদের অবাধে ব্রিটেনে আসা এবং চাকুরীর বাজার দখল করা। ইউরোপিয়ান আদালত থেকে মুক্ত হবে ব্রিটেন এবং ইচ্ছেমত আইন প্রণয়ন করতে পারবে ব্রিটেন, পৃথিবীর যেকোন দেশের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের চুক্তি করতে পারবে, সমুদ্র কর্তৃত্ব ফিরে পাবে সর্বোপরি সার্বভৌমত্ব ফিরে পাবে ব্রিটেন। অভিবাসীদের নিয়ে নিজেরাই আইন প্রনয়ণ করতে পারবে যুক্তরাজ্য। মূলত ব্রিটেন ইইউ’র অভিবাসীদের উপর বিরক্তির কারণে ব্রিটেনবাসী বেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছে।
অন্যদিকে রয়েছে আয়ারল্যান্ড ইস্যু। আয়ারল্যান্ডের রয়েছে দুটি ভাগ। উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র। উত্তর আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের অংশ আর আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র ইইউ’র অংশ। দুটো মিলে একটি আলাদা দ্বীপ । এই দুয়ের মধ্যে রয়েছে স্থল পথ আর ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন এবং ইইউ দুই পক্ষের জন্য এটি হবে একমাত্র স্থল সীমান্ত  এবং বেক্সিট কার্যকর হওয়ার পর এই সীমান্তে কাস্টমস বসাতে হবে। পণ্য আমদানীর রপ্তানীর ক্ষেত্রে এই সীমান্তে কাস্টমসের মুখোমুখি হতে হবে । সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে দুই আয়ারল্যান্ডের ভাষা, সংস্কৃতি এক হওয়া সত্তে¦ও দীর্ঘদিন দুই শাখা ছিল দুই দিকে। তবে ইইউর অংশ হওয়ার পর এবং ‘গুড ফ্রাইডে’ নামক একটি চুক্তির মাধ্যমে একে অন্যের সাথে মুক্তভাবে চাকুরী এবং ব্যবসা বাণিজ্য করে গেছেন। বেক্সিট কার্যকর হলে দুই আয়ারল্যান্ডই সংকটে পড়ে যাবে। তবে ব্রিটেনবাসী যেই সুবিধাজনক চুক্তি চাচ্ছে তাতে রাজি নয় ইইউ আর সেকারণেই থেরেসা মের খসড়াচুক্তিও ব্যর্থ হলো। এটি এখন ফিরে এসেছে ব্যাকস্টপের দিকে এবং এই ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি কোন চুক্তিতে পৌঁছাতে না পারে তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাকস্টপই অবলম্বন হতে পারে। ব্যাকস্টপকে এখন উইথড্রয়াল ডিল এর বীমা নীতি হিসাবে দেখা হচ্ছে। এখন চুক্তি ছাড়া যদি বেক্সিট কার্যকর হয় তবে লাভ ক্ষতির হিসেব না করে বের হয়ে আসতে হবে ব্রিটেনকে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা সব মন্ত্রীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পার্লামেন্টের সব এমপিদের ডেকেছেন পবরবর্তী পদক্ষেপ  নিয়ে আলোচনা করার জন্য। অন্যদিকে বেক্সিট ইস্যু নিয়ে কোন আলোচনায় আসতে রাজি নয় বিরোধীদলীয় নেতা জেরিমি করবিন। এনিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন থেরেসা মে এবং বলেছেন, বিরোধী দলের সাথে আলোচনায়  বসার জন্য তার দরজা সব সময় খোলা। তবে জেরেমি করবিনের পক্ষ থেকে খুব একটা পজিটিভ বক্তব্য এখনো আসেনি।
চুক্তির জন্য সংসদীয় অনুমোদন পেতে প্রধানমন্ত্রী নতুন বিলের জন্য সময় পাবে ২৬ ফ্রেবরুয়ারী পর্যন্ত । সরকার যদি তা করতে ব্যর্থ হয় তবে বিলটি সংসদকে অনুচ্ছেদ ৫০এর বর্ধিত করার জন্য অনুমতি দেবে যা ব্রেক্সিটকে বিলম্বিত করবে এবং ইউকে কোন চুক্তি ছাড়াই ইইউ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মিস মোরগান স্কাই নিউজকে বলেছেন, এটি একটি বিদ্বেষমূলক আচরণ যা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা পুরো গোষ্ঠীর সাথে শুরু করেছে।ব্রেক্সিটারের মন্ত্রিপরিষদের লিয়াম ফক্স, অভিযুক্ত এম পিদের ব্যাপারে বিবিসির সাথে সাক্ষাতকারে বলেছেন, বিরুধীরা ব্রেক্সিট প্রক্রিয়াকে হ্যাইজাক করার চেষ্টা করছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্ত জনগণের প্রতিনিধি হয়ে তারা এটা করতে পারে না বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন ফক্স। ২৯ মার্চ চুক্তি ছাড়া ইউকে ইইউ থেকে বের হয়ে আসার বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে।
বিবিসির সহকারী রাজনৈতিক সম্পাদক নর্মান স্মিথ বলেন, যারা প্লেন বি এর অপেক্ষায় আছে, তাদেরকে ‘দীর্ঘ সময় বাস স্টপে আটকা’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, গত সপ্তাহের শেষের দিকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বা গুড ফ্রাইডে চুক্তিটি পুনঃলিখনের জন্য প্রস্তাব করা হলে তারা উভয়ই প্রত্যাখ্যান করেছে। 
অবশেষে বলা যায়, তিনটি বিকল্পপথ খোলা আছে ব্রিটেনের জন্য -১. দ্বিতীয় রেফারেন্ডাম দিতে পারে কিন্ত দ্বিতীয় রেফারেন্ডাম কার্যকর করতে সময় লেগে যেতে পারে এক  বছরেরও বেশী ২. কোন ডিল ছাড়াই কার্যকর হতে পারে বেক্সিট প্রক্রিয়া ৩.  পুরো বেক্সিট প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে দেওয়া।লেবারের স্যার কেয়ার স্টর্মার বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট বাতিল করতে হবে। বেশির ভাগ মানুষের ইচ্ছে আরেকটি গণভোটের। আবার  অনেকের মতে আরেকটি রেফারেন্ডাম হচ্ছে গণতন্ত্রকে অসম্মান করার সামিল। সবার চোখ এখন থেরেসা মে’র দিকে । থেরেসা মে’র সরকার কোনটিকে বেছে নিয়ে অগ্রসর হবেন। তবে পার্লামেন্ট যদি কোন চুক্তি অনুমোদন না দেয়, তবে ২৯ শে মার্চ কোন চুক্তি ছাড়াই ইইউ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। 

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক

 

 

এস_খান