• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ২, ২০১৯, ০৬:৫০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ৩, ২০১৯, ০১:০৬ এএম

মুন্ডাদের বর্ষবরণ উৎসব সিরুয়া বিসুয়া

মুন্ডাদের বর্ষবরণ উৎসব সিরুয়া বিসুয়া
মুন্ডাদের আদিবাসীদের বর্ষবরণ -ছবি : জাগরণ

মুন্ডারাও আদিবাসী মান্দিদের মতো ( যার অর্থ মানুষ) নিজেদের হোরোকো বলে থাকে। তাদের ভাষায় হোরাকো শব্দের অর্থও মানুষ। তবে তারা নিজেদের মুন্ডা হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। মুন্ডা শব্দের অর্থ সম্মানী ও সম্পদশালী মানুষ। এদের আদি নিবাস বিহারের রাঁচিতে। বাংলাদেশে মুন্ডাদের আগমন ও তাদের বসতি বিন্যাসের প্রকৃত তথ্য এ যাবতকালে উৎঘাটিত না হলেও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং উৎখননের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত বিহারে ও রাঁচিতে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে মোটামুটিভাবে তাদের আদি বসতি বিন্যাসের সময়কাল এবং স্থান নিরূপণ করা সম্ভব। সম্ভবত ২০০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে এবং তার পরবর্তীকালে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি মুন্ডা সম্প্রদায়ভুক্ত বিশেষ সংস্কৃতির অধিকারী মানব গোষ্ঠী নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। বিভিন্ন সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, মুন্ডা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী বিদেশি প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত একটি বিচ্ছিন্ন মানব গোষ্ঠীর কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার সূত্র ধরেই তাদের গোষ্ঠী চিন্তা প্রসারিত হয়।

পরবর্তীতে বাংলাদেশে বসবাসরত মুন্ডা সম্প্রদায়ের বিশেষ সংস্কৃতির অধিকারী মানব গোষ্ঠী বাংলাদেশের খুলনা জেলার কয়রা ও ডুমুরিয়া উপজেলা এবং সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা ও তালা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে মুন্ডাদের বসতি বিন্যাসের এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন এলাকায়ও এদের আদি বসতির চিহ্ন মিলে।

জাতিতাত্ত্বিক দিক থেকে ছোট নাগপুরের বৃহত্তর দ্রবিড় উপজাতি হিসাবে উল্লেখ করা হলেও প্রাকৃতিক অর্থে বাংলাদেশের মৌলভী বাজার অঞ্চলের যে সমস্ত মুন্ডাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তাতে বিষয়টি বিশেষ করে তাদের দৈহিক কাঠামোগত বিন্যাস, পরিবেশ, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জেনেটিক ডেরিফের কারণে দ্রাবিড় উপজাতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মী মনে হয়। মুন্ডারা মান্দারি ভাষায় কথা বলে। কোথাও কোথাও তারা কোল নামে পরিচিত। মুন্ডা ভাষাভুক্ত বিভিন্ন উপভাষা উত্তর ও মধ্য ভারতে ব্যবহৃত হয় এবং ২০টি ভাষাভাষির লোকেরা এ ভাষায় কথা বলে। এ সকল ভাষার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সাঁওতালী ভাষা, যা রোমান, দেবনাগরী বাংলা এবং উড়িয়ান লিপিতে লেখা।
মুন্ডা ভাষায় ৪ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী কথা বলে যার একক নাম খেড়োয়াড়ী ভাষা।

বাংলাদেশে অবস্থিত মুন্ডাদের ৭টি গোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায় যেমন, কম্পাট মুন্ডা, খাঙ্গার মুন্ডা, খাড়িয়া মুন্ডা, পাথর মুন্ডা, দেরগে মুন্ডা, সাঙ্কা মুন্ডা এবং মাঙ্কী মুন্ডা। কিন্তু ভারতবর্ষে প্রধানত ১৩ টি মুন্ডা গোষ্ঠীর উল্লেখ রয়েছে।

মুন্ডারা সাধারণত বন-জঙ্গল ও মাটি কাটার সঙ্গে আদিকাল থেকেই সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও মুন্ডারা বিভিন্ন চা বাগানের চা শ্রমিক হিসাবে কর্মরত রয়েছে। মুন্ডাদের মধ্যে অনেক উপগোত্র রয়েছে। মুন্ডারা প্রাথমিক পর্যায়ে বন-জঙ্গল এবং চা শ্রমিক হিসাবে কাজ করলেও পরবর্তী পর্যায়ে তাদের পেশার পরিবর্তন লক্ষণীয়। তারা মাছধরা এবং ছোটখাট ব্যবসায় নিয়োজিত আছে।

অনেক নৃতাত্ত্বিকগণ মনে করেন মুন্ডারাই কোল নামেও পরিচিত। এরা আদিবাসী সাঁতালদেরই একটা প্রশাখা। এতেদর জীবন যাপন, দেহের গঠন, উৎসব, খাদ্যাভ্যাস সবই সাঁওতালদের মতো। কাজ থেকে নাচ-গান এরা নারী পুরুষ সমন্বয় করে। এখনও এরা সনাতনী জীবনে অভ্যস্ত। কিছু কিছু মুন্ডা পরিবারের সদস্যরা আধুনিকতার সামান্য ছোঁয়া পেলেও অধিকাংশই আধুনিকতা থেকে বঞ্চিত। উত্তরবেদকাশী, দক্ষিণ বেদকাশী এই ৩টি ইউনিয়নে মুন্ডাদের নিবাস। জীবন যুদ্ধ তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। নিজের বলতে যা ছিলো কালের বিবর্তনে তা বেহাত হয়ে গেছে। নিজ আদিভ‚মিতে তারা এখন অন্যের প্রজা। মুন্ডা পরিবারের নারী পুরুষ সবাই পরিবারের জীবিকার তাগিদে ঘরে বাইরে কাজ করে। তার পরেও দুঃখ দৈন্য তাদের ছেড়ে যেতে চায়না। পয়লা বৈশাওেখ তাদের রীতি অন্যান্যদের মতোই।

বর্ষবরণ: সিরুয়া বিসুয়া
পয়লা বৈশাখের এ অনুষ্ঠানকে মুন্ডারা বলে সিরুয়া বিসুয়া। খুব ঘটা করে এ উৎসব পালন করে তারা। এ সময় কাজ-কর্ম একদম বন্ধ থাকে। কখনো কখনো মনে হবে এরা সমতলের অন্যান্য আদিবাসীদের মতোই পয়লা বৈশাখ রীতি পালন করে। তবে ভিন্নতা আছে অনেক। যেমন ঋতুভিত্তিক ফসলি উৎসব ছাড়াও প্রতিদিন তাদের ধর্মীয় দেবতা সিং, বোঙ্গা বা সূর্যকে পূজা করে। মুন্ডারা সুর্য দেবতার পূজায় অভ্যস্ত। তাই সকালে স্নান করে এসে বোঙ্গা বা সূর্যের পূজা দিয়ে এরা সবাই মিলে পানতা ভাত খায়। তবে ভিন্নতা হলো দুপুরে তারা তারা ভাতের সঙ্গে খেয়েছে ১২ থেকে ২০ রকমের  তরকারি খায়। ১২ সূচক এজন্যে যে বারো মাসের সমাপ্তির পর এ উৎসব তারা করে। সন্ধ্যায় ঠাকুরকে প্রণাম করে শুরু হয় নিজস্ব মদ চোলাই পান ও নৃত্য গীত আর ভক্তি দিয়ে চলবে নাচগানের আসর।

বৈশাখের মতো চৈত্রের শেষদিন বা সাকরাইনের দিনও মুন্ডা সম্প্রদায় আয়োজন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। ওইদিন তারা শুদ্ধি অভিযান চালায় দলেবলে মিলে। তারা ঝেড়ে, মুছে লেপে বাড়ি ঘর পরিসাকার করে কাদা উৎসবে মমেতে ওঠে। একে অপরকে কাদায় মাখায়। এটা তাদের দেবতার পছন্দ। এরা মধ্যে বুঙ্গা দেবতার নামে এরা কাদা মাটি ধুয়ে বৎসরের আবর্জনা দুঃখ কষ্টকে ধুয়ে নতুন জীবনের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়। এটা তাদের পূর্বপুরুষদের রীতিও। যে যাকে কাদামখে দেয় সে তাকে হাড়িয়া বা নিজ তৈরী মদ পরিবেশন করে। এভাবে তাকে সম্মানিত করা রেয়াজ মুন্ডা সমাজে এখনও রয়েছে। তারা মনে করে এর মধ্য দিয়ে অন্তরের বাঁধন শক্ত হয়,বা ভালো আত্মীয় হয়। চৈত্রের শেষদিন এবং বৈশাখের প্রথম দিনের এ উৎসবকে মুন্ডারা বলে সিরুয়া বিসুয়া।

মুন্ডাদের এ হিসাব সনাতনী। কারণ চান্দ্র মাসকে মাথায় রেখে এরা এই সিরুয়া বিসুয়া উদযাপন করে। আয়োজন করে চৈতালিপূজার। চৈতালি পুজার কারণে সূর্য দেবতা বুঙ্গা রোগ-শোক থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়। বুঙ্গার নামে তাই চৈতালি পূজার আগের রাত থেকে উপোস থাকে পরেরদিন দুপুরে পূজার প্রসাদ দিয়ে উপোস ভাঙ্গাই নিয়ম। রাতে বেল গাছের নীচে সাজিয়ে ধূপ ,দীপ জ্বালিয়ে, পান- সুপারি, দুধ- কলা, ধান দূর্বা,কদমফুল, সিঁদুর, দিয়ে সাজিয়ে  হাড়িয়ার হাড়ির সামনে সবাই গোল হযে বসে বুঙ্গাকে প্রাম করে সমস্বরে গান গেয়ে ওঠে, নাচ শুরু হয়, মাদল ,কাসর বাজে নারীরা তাদের মরদদের মুখে হাড়িয়া তুলে দেয়। অন্যদিকে মানতের হাস, পাঠাঁ বলির মাংস, খিচুড়ি রান্না
হতে থাকে। তার গন্ধ ছড়ায় চারদিকে। নৃত,গীত,বাদ্য সবই চলতে থাকে তখোনও। উৎসবে-নাচ- গান -নেশায় মাতোয়ারা সবাই খিচুড়ি মাংস।