• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: এপ্রিল ৯, ২০১৯, ০৭:৫১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৩, ২০১৯, ০৮:৪৫ পিএম

পাহাড়ে আয়োজন চলছে ‘বৈসাবি’র

পাহাড়ে আয়োজন চলছে ‘বৈসাবি’র

পুরানো বছরকে পেছনে ফেলে আসে নতুন বছর । পাহাড়ের আদিবাসী পল্লীর আদিবাসীরা নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে  আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠে। প্রতিবছর আদিবাসীদের ঘরে “বৈসাবি” আসে নতুন সাজে, ভিন্ন আমেজ নিয়ে। বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে পার্বত্য জেলায় শুরু হয় আনন্দের বন্যা। দিন বদলের স্বপ্ন দেখা আদিবাসীদের অন্তরে জেগে ওঠে পরিবর্তনের নতুন  আবাহন  । দেশের অন্যতম পর্যটন শহর বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ির প্রধান প্রধান আদিবাসী সম্প্রদায় বিশেষ করে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা জাতীগোষ্ঠি পুরানো বর্ষকে বিদায় ও নবর্বষকে স্বাগত জানিয়ে বর্ষবরণ উৎসব উদযাপন করে। তাদের বর্ষবরণ আমাদের বাঙ্গালীদের থেকে ভিন্ন ধরনের। বান্দরবান পার্বত্য জেলায় সংখ্যাঘরিষ্ঠ আদিবাসী মারমা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় চাকমা ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় ত্রিপুরা স¤প্রদায়ের বসবাস। 
চাকমা স¯প্রদায়রা এই উৎসবকে বিঝু, মারমারা সাংগ্রাই এবং ত্রিপুরারা বৈসু বা বৈসুক বলে। ত্রিপুরাদের বৈসুর (বৈ), মারমাদের সাংগ্রায়ের (সা) চাকমাদের বিঝুর (বি) থেকে বৈসাবি। সাংগ্রাই বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ্যেও এই সময় বিষু নামক পূজা এবং আসামে অহমীয়াদের মধ্যে বিহু উৎসব উদ্যাপিত হয়। মূলত: বিষু শব্দটি থেকে চাকমাদের বিঝু, ত্রিপুরাদের বৈসু এবং অহমায়ীদের বিহু শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে বলে মনে হয়। বাংলায় বর্ষের শেষ দিনটিকে চৈত্র সংক্রান্তি বলে। সংক্রান্তি শব্দটি মারমাদের সাংগ্রাই শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে বলে মনে করেন ভাষা বিজ্ঞানীরা। আরাকানীরাও সাংগ্রাই উদ্যাপন করে। বার্মা (মায়ানমার) ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, লাওস,ভারত এই সকল বৌদ্ধ অনুসারি বসবাসরত দেশগুলিতে ইংরেজী এপ্রিল মাসের ১৩ ও ১৪ তারিখ ঐ সময় এই জাতীয় উৎসব শুরু হয় এবং তাই অনেকে বৈশাখ মাসে (পূর্ণিমা দিনে) গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্বপ্রাপ্তি এবং পরিনির্বান প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে এই উৎসব শুরু হয়েছে বলে মনে করেন। আর এই উৎসবকে সামনে রেখে  তিন পার্বত্য জেলা হয়ে উঠে উৎসব নগরী। আদিবাসীরা কর্মের সন্ধানে দেশের যে প্রান্তে থাকুক না কেন, বর্ষবরণের এই টানা উৎসবকে কেন্দ্র করে শতব্যস্ততা উপেক্ষা করে নিজ নিজ মাতৃগৃহে অবস্থান করে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে পার্বত্য জেলাগুলোতে দেশি-বিদেশী পর্যটক  এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদ কর্মিদের ভিড় চোখে পড়ার মত। বান্দরবান, রাঙ্গামাটি,খাগড়াছড়ির পার্বত্য জেলার সব উপজেলার বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় উৎসব উদযাপন করে ।


বৈসু: 
ত্রিপুরাদের বৈসু প্রধানত সামাজিক উৎসব। বিশেষত আদিবাসী ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বসবাস খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়। বর্তমানে বান্দরবানে বসবাসরত ত্রিপুরারা খ্রিস্ট অনুসারি হলেও তারা এক সময় সনাতন হিন্দু ধর্মের আনুসারি ছিল। বিশ্বের অন্যান্য ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জাতিগোষ্ঠীর ন্যায় ত্রিপুরাদেরও নিজস্ব একটি বর্ষপঞ্জী রয়েছে। যা ত্রিপুরাব্দ বা ত্রিপুরা সন নামে পরিচিত। ত্রিপুরাদের এই বর্ষ উদ্যাপনের নাম বুইসুক, বৈসু বা বিষু নামে পরিচিত তারা নববর্ষের দিনকে “বিসিকাতাল”বলে। ত্রিপুরা মহারাজ হামতরফা ত্রিপুরা সন বা ত্রিপুরাব্দের প্রবর্তন করেন। রাজমালায় উল্লেখ্য আছে যে, ত্রিপুরা মহারাজ হামতরফার রাজত্বকালে ত্রিপুরারা সমৃদ্ধির চরম গৌরবময় শিখরে আরোহন করেছিলেন এবং সেই সময়কালকে পৃথিবীর বুকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি ত্রিপুরাব্দের প্রবর্তন করেন।
ত্রিপুরা’রা বাংলা বর্ষের শেষ দিনকে বৈসুমা বা বৈসুকমা, তার আগের দিনটিকে হারি বৈসু এবং নববর্ষের প্রথম দিনটিকে ‘আতাদাক’ বলে। হরি বৈসুকের দিন তারা ভিন্ন ধরনের ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। গরু, শুকর, মহিষ, ছাগলসহ গৃহপালিত পশুদের খুব ভোরে ঘর থেকে ছেড়ে দেয়। ছেলে-মেয়েরা নতুন কাপড় পরে এ ঘর থেকে ঐ ঘরে ঘুরে বেড়ায়। ত্রিপুরারা বৈসুমা দিনে তাদের বাড়ীতে অতিথিদের নানা ধরনের মদ, পিঠা, পাঁচন ও পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করে। ঐ দিন ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা নদী থেকে জল এনে তাদের নানা-নানী, দাদা-দাদী স্থানীয় গুরু জনদেরকে স্নান করিয়ে তাদের নিকট আর্শীবাদ গ্রহন করে। বৈসুর সময় ত্রিপুরা গরাইয়া নাচের শিল্পীরা পাহাড়ি পল্লীর ঘরে ঘরে তাদের ঐতিহ্যবাহী গরাইয়া নৃত্য পরিবেশন করে।  
সাংগ্রাই: 
পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান পার্বত্য জেলার মারমাদের এবং কক্সবাজারের রাখাইনদের অন্যতম প্রধান উৎসব সাংগ্রাই। মারমা’রা তাদের বর্ষ শেষে তেংখুং মাসের শেষ দিকে এবং নববর্ষের কোসুং বা কাসুং মাসের প্রথমে সাংগ্রাই উৎসব উদ্যাপন করে। এ সময় বান্দরবান ও কক্সবাজার শহরে তরুন তরুণীরা পানি খেলা উৎসব এর আয়োজন করে। পানি খেলা উৎসবের সময় তরুণীরা নির্ধারিত মঞ্চে অবস্থান করে। চারিদিকে সঙ্গীতের মূর্ছনা থাকে। তরুণীদের সামনে বিভিন্ন পাত্রে বা জলাধারে জল রাখা থাকে। ঐ সময় তরুণেরা জলভর্তি পাত্র নিয়ে দলে দলে এসে বলে ‘সাংগ্রাইংতে মিলে মিশে পানি খেলা খেলি ও ভাই সকলে ও বোন সকলে এসো একত্রে আনন্দ করি’। লেঃ লেঃ লেঃ.. লেঃ .. মংরো মংরোঃ.. মংরো মংরো, পেং পাদাউশে পোওয়াংরে লা সাংগ্রে, ক্যালোঃ মংরো প্যয়ে, (রাঙা পুস্প শোভিত এ মাসে আত্মহারা হয় সাংগ্রের আনন্দে এই শুভ দিনে তুলনাহীন তুমি, প্যান্ডেলে বসে স্বাগত জানাও, সাংগ্রেং এর জল হীম শীতল সুন্দরী তুমি অপূর্ব) শহরের অলিতে-গলিতে এই ধরনের গান গেয়ে আদিবাসীরা এক অপরকে পানি বর্ষন করে জলকেলী বা পানি উৎসবে মেতে উঠছে। এক একজন তরুণ একজন তরুণীর দেহে জল ছিটায়। আর ঐ তরুণীও ঐ তরুণের দেহে পাল্টা জল ছিটিয়ে তার প্রতি উত্তর দেয়। এভাবে তরুণ- তরুণীদের পানি ছিটানো দিয়ে খেলার মাধ্যমে পানি খেলা উৎসব উদযাপিত হয়। তাছাড়া কুস্তি খেলা, নৌকা বাইচ, গিলা খেলা, কড়ি খেলা ও লাটিম খেলার আয়োজন করা হয় । বর্ষের প্রথম দিনটি অর্থাৎ কোসুং বা কাসুং মাসের প্রথম দিনটি যে বার হয়ে থাকে ওই বারে যারা যারা জন্ম  গ্রহণ করেছে  তাদের অনেকে ঐ দিন (কক্সবাজারে) বিনিভাত, পায়েস রেঁধে বন্ধুদের বাড়িতে শুভেচ্ছা স্বরুপ পাঠায়। নতুন কাপড়ে বড়দের নমস্কার করে তারা আর্শিবাদ কামনা করেন, তাদের ধারনা এই দিনে সাংগ্রাইয়ের দিনে সাংগ্রাইয়ং রাজা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। নববর্ষে মারমা আদিবাসীরা বৌদ্ধমন্দিরে গিয়ে বুদ্ধকে প্রণাম জানায় এবং ডাবের পানি, চন্দনের পানি দিয়ে নদীর তীরে বুদ্ধ মূর্তিকে স্নান করান । এরপরে  বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রণাম জানিয়ে তাদের কাছ থেকে পঞ্চশীল এবং আর্শীবাদ গ্রহন করে। সাংগ্রাই অতিক্রম হওয়ার পরবর্তী প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই বোমাং সার্কেলের প্রধান বোমাং রাজা বাহাদুর ঢাক-ঢোল, সানাই ও বাদ্য সহযোগে দেবীদের কাছে পূজা উৎসর্গ করেন। 

বিঝু : 
চাকমা সম্প্রদায়ের বাংলা বর্ষের শেষ দিনটিকে মূল বিঝু, তার আগের দিনটিকে ফুলবিঝু এবং নববর্ষের প্রথম দিনটিকে নতুন বছর বা গোর্জ্যাপোর্জ্যা দিন বলে। চাকমা সম্প্রদায়ের বসবাস রাঙ্গামাটির পার্বত্য জেলায়। চাকমারা এই তিন ধরে এই বিঝু উৎসব পালন করে। ফুল বিঝুর দিনে তরুন-তরুনী এবং শিশুরা নদীতে গিয়ে কলাপাতায় করে ফুল ভাসিয়ে দেয়। অনেক ফুল দিয়ে ঘরদোর সাজায়। পাহাড়ের ছেলেমেয়েরা ‘ঘিলা’ নামক বীচি দিয়ে ঘিলা খেলা, ‘নাধেং’ নামক জাতীয় লাটিম দিয়ে নাধেংখারা, গুদু (হাডুডু) খেলা ইত্যাদি বিভিন্ন খেলা খেলে। অনেকে এই সময়  ‘গেংখুলী’ নামক চারণ কবিদের ডেকে এনে নানান ধরনের পালাগান শোনে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা শহরে বিঝু উপলক্ষে এ সময় চাকমারা নাটকের মঞ্চায়ন ও নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মূলবিঝু দিনটি চাকমাদের  বিঝু দিন। এই দিন সবার ঘরের দরজা অতিথিদের জন্য উন্মুক্ত থাকে । ঘরে ঘরে অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য নানা ধরণের মিষ্টি, পিঠা,পানীয় প্রভৃতি খানা- পিনার আয়োজন করা হয়। ভোর থেকে শিশুরা বাড় বাড়ী ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে ধান ও চালের খুদ ছড়িয়ে মুরগীদেরকে খাবার দিয়ে আসে। নতুন পোষাকে তরুণীরা কলসী দিয়ে নদী থেকে জল এনে নানা-নানী কিংবা দাদা-দাদী স্থানীয় গুরুজনকে স্নান করিয়ে তাদের কাছ থেকে আর্শীবাদ গ্রহন করে। বেলা একটু বাড়তেই অতিথিরা বাড়ী থেকে ও বাড়ীতে এবং এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে দিয়ে আতœীয় ¯^জন ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করে কুশলাদি বিনিময় করে। তাদেরকে ঘরে ঘরে ‘কলা’ পিঠা, ‘সান্যা’ পিঠা,পাহাড়ে জন্মানো এক প্রকার ধানের চাউল দিয়ে ‘বিনি’ পিঠা, (যা আঠালো) নানা ধরনের মিষ্টি পানীয় এবং পাজোন (পাঁচন) দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়। এই সময় ছোট শিশুরা নতুন জামা-কাপড় পরে একে অপরের বাড়ীতে যায় এবং বড়দের প্রণাম করে আর্শীবাদ কামনা করে। মূলবিঝুর দিনে চাকমারা প্রাণী হত্যা করা থেকে বিরত থাকে এবং নব-বিবাহীতরা শ্বশুর বাড়ীতে বেড়াতে যায়। তাদের ঐতিহ্যবাহী লোকসংগিত, গাংগুলি, চান্দবীরা ও সাংস্কৃতি উৎসবে মেতে উঠে। মূলবিঝুর দিনে চাকমাদের সব বাড়ীতে মিষ্টি জাতীয়,টক জাতীয় ইত্যাদি সবজি মিশিয়ে পাঁচন রান্না করা হয়। চাকমাদের বিশ্বাস বছরের শেষ দিন তিতা, মিঠা, খেয়ে বছরকে বিদায় দেওয়া ভাল। এতে বিগত বছরের সাথে বিগত দূর দিনের দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনা দূর হয়ে যায়। নতুন বছর বা গোর্জ্যাপোর্জ্যা দিনে চাকমারা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে আর্শীবাদ কামনা করে। 
শেষ কথা-
বৈসাবি উৎসবের মাধ্যমে অনাগত দিনগুলো মঙ্গলময় হোক। কর্ম-ব্যস্ততার মাঝে আড়ালে থাক সুখ-দুঃখ-গ্ল¬ানি, এই দেশের মাটি উর্বর হোক। ফুলে ফলে ভরে উঠুক পাহাড়ের জুম শস্যতে, পরিমিত বৃষ্টি- জল- হাওয়া বর্ষিত হোক এ ধরনীতে, প্রবাহিত হোক এই দেশের মাটিতে। জাতি ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে এদেশে বসবাসকারী সকল জনগোষ্ঠি, সকল প্রাণীকুল সমঅধিকারে বেঁচে থাকুক, সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাক দেশ, এ প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে আদিবাসীদের নববর্ষ ‘বৈসাবি’র ইতি টানা হয়।