• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৫, ২০১৯, ০৬:২৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৫, ২০১৯, ০৬:২৪ পিএম

মানতা সম্প্রদায় : জলে জন্ম , মৃত্যুও জলে

মানতা সম্প্রদায় : জলে জন্ম , মৃত্যুও জলে

মানতা সম্প্রদায়ের মানুষের আজন্ম প্রেম নদীর সঙ্গে, বেঁচে থাকার লড়াইটাও সেই নদীর সঙ্গেই। সামান্য ঝড়ো হাওয়া ওদের মুখ শুকিয়ে দেয়, আগত ঝড় ওদের সামনের দিনগুলোকে বিশাল এক প্রশ্নের মুখোমুখি করিয়ে দেয়। তবুও সেই নদীই তাদের অবলম্বন হয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে।

ইছামতি নদীর এক বাসিন্দা লতা বেগম। বয়স সত্তরোর্ধ্ব। ভাসমান পাড়াটির সবচেয়ে বয়স্ক তিনি। তার জন্মও নৌকাতে। তিনি ঠিক মনে করতে পারেন না। জীবনের এই পড়ন্ত বেলাতে তার প্রত্যাশার কথা জিজ্ঞেস করলে বলেন, একটু ডাঙায় এটা বাড়িতে পা নছড়াইয়া ঘুমাইতে পারতাম। লতা বেগমের সে আশা বুঝি আর পূরণ করবে কে?।

পটুয়াখালী জেলার রাঙাবালী উপজেলার একটি ইউনিয়ন চর মন্তাজ। দ্বীপ ইউনিয়ন চর মন্তাজকে চারিদিক থেকে জড়িয়ে আছে তেঁতুলিয়া নদী। সে নদীর কোনো এক নৌকায় আজ থেকে বিশ কি বাইশ বছর আগে আক্কেল সরদারের কন্যা কোহিনূরের জন্ম। শৈশব, কৈশোর পার করে কোহিনূর বাপের নৌকা ছেড়ে এখন সংসার পেতেছে স্বামী বসারের নৌকায়। কোহিনূরের এক ছেলে, নাম সুজন। ডাল ভাতের আয়োজন দুপুরে। বিকেলে যদি মাছ ধরা পড়ে আর তা বিক্রির পর যদি কিছু বাচে, তবে রাতে মাছ রান্না হবে। ছেলে সুজন আড়ই মাছ খেতে ভালোবাসে। কোহিনূরকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনার ছেলে কি হবে ভবিষ্যতে? উল্টে বসে কোহিনুর। ম্লান হয়ে আসে কোহিনূরের চোখের জ্যোতি, মুখখানা অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলে, ‘জানি না।’

এ জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে তারা। আর ১০ জন স্বাভাবিক মানুষের মতো ডাঙায় বসবাস করতে চায় মানতা সম্প্রদায়ের প্রতিটি মানুষ।

বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বাস করে মানতা সম্প্রদায়ের মানুষেরা। তাদের মতো করে তাদের বাস। আমাদের দেশের প্রধানত উপকূলবর্তী জেলাগুলোর নদীর তীর ধরে হাঁটতে থাকলে দেখা মিলবে সারি সারি নৌকা। প্রতিটি নৌকাতে একটি করে পরিবার, সেসব পরিবারের সমস্ত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না মিশে আছে ঐ ছোট্ট নৌকাটি ঘিরে। এর বাইরে তাদের কোন বৃত্ত নেই। ধর্মে তারা মুসলমান, তবু জীবন যাত্রা বিচিত্র ঢঙে তারা মানতা সম্প্রদায় নামে পরিচিত। জীবিকার প্রধান উপায় মাছ ধরা। জাল, মাইজাল, বড়শি নিয়ে মাছ ধরে পুরুষেরা। নারীরাও এ কাজে কম পটু নন। একটু বয়স হলেই সন্তানেরাও মাছ ধরায় সাহায্য করে বাবা-মাকে। স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠে না বেশির ভাগেরই। পেটের খোড়াক ওেজাগানোর তাগিদটা তাদেও এতই বেশি যে ক্ষুধার কাছে বিদ্যার প্রসঙ্গ থেমে যায়।

তাদের জীবনযাপন, শরীরের গঠন, ভাষার ব্যবহারে বেদেদের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। তাদেরও জন্ম নদীর বুকে, নদীতে বেড়ে ওঠা, নদীতেই মৃত্যু। আবার মৃত্যুর পর লাশগুলো তাই ভেসে যায় নদীর জলে। নয়তো নদীর তীরে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়। নদী কিংবা সমুদ্রের বুকে মাছ ধরার সব উপকরণ নিয়ে তারা ছুটে চলে জীবনের তাগিদে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে তারা মাছ ধরে। বরিশালের কীর্তন খোলার বাঁকে বা পটুয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা গেছে গর্ভবতী মায়েরাও এ পেশার সঙ্গে যুক্ত। ওরা ভেসে চলে বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, মুলাদী, হিজলা, বানারীপাড়া, মাদারীপুরের কালকিনি, পটুয়াখালীর পানপট্টি, চরমনতাজ, গলাচিপা, কালাইয়া, বগা, পাটুয়া, বদনাতলী, উলানিয়াসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদী ও মোহনাগুলোতে। নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে এসব কথা তাদের বললে কোন উত্তর দেয় না কেউ।

 আক্ষেপের সুরে করিম মিয়া বলেন, যেসব নদী আছে তাতেও মাছ নেই। জমিতে ওষুধ দেয় সেই জল নাইমা আসে। মাছ মারা যায়। আমরা তো আর কোন কাজ জানি না। আমাদের কি হবে? কারো কোন জবাব নেই। আবার প্রতিদিনের মতো তারা সারাদিন মাছ ধরে আর দিন শেষে ব্যাটারিচালিত টেপ রেকর্ডার নিয়ে বসে ওরা, পুরনো দিনের সিনেমার গান শোনে তন্ময় হয়ে। কোনো কোনো নৌকায় সৌরবিদ্যুৎ দেখা যায়, দুই তিনটা কম পাওয়ারের লাইট জ্বলে তা দিয়ে। তাদের জীবন যেমন, বিবাহ রীতিও তেমনি অভিনব। পছন্দের কোনো মেয়েকে তার বাবার নৌকা থেকে নিজের নৌকায় তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়! আবার বনিবনা না হলে স্বামী তার স্ত্রীকে বাবার নৌকায় ফের পাঠিয়ে দেন, বাবার নৌকায় এলেই হয়ে যায় তালাক! বর্তমানকালে কিছু কিছু বিবাহ অবশ্য সরকারি খাতায় রেজিস্ট্রি হচ্ছে। কিন্তু মানতা জনপদের কারো জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন হয় না। আবার তাদের বসবাস বাংলাদেশের অসংখ্য নদীতে ছড়ানো-ছিটানো বলে তাদের মোট সংখ্যা হিসেব করাও সম্ভব হয়নি।

স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার পায় মানতা সম্প্রদায়। কিন্তু দেশের নাগরিক হিসেবে অন্যান্য মৌলিক অধিকারগুলো কি ঠিকভাবে পাচ্ছে তারা? সে কথা বলতে পারেনি জেলার কোন কর্তাব্যক্তিও। শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি প্রভৃতি মৌলিক অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত মানতা সম্প্রদায়। খুব বেশি হলে শতকরা চার কি পাঁচ ভাগ ছেলেমেয়ে পায় প্রাথমিক শিক্ষা। বেশির ভাগই তাই অশিক্ষিত থেকে যায় আজীবন, বয়স ১০ কি বারো হলেই বাবা মায়ের পেশা মাছ ধরাকে নিজের পেট চালানোর অবলম্বন করে নেয়। নয়তো খাবার জোটে না প্রতিদিন। এমনিতেই মাও শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে।

মানতা সম্প্রদায়ের বড় একটি সমস্যা খাবার পানি। বিশুদ্ধ খাবার পানির ভীষণ সংকট ওদের মাঝে। কারণ নদীর পানিতেই চলে রান্নাবান্না, বাসন আর কাপড় পরিষ্কার। মলত্যাগও সেখানেই। তাই নিয়মিত পানিবাহিত রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে স্থানীয় সরকারি হাসপাতালমুখী হন মানতারা। কিন্তু চিকিৎসা সেবা মেলে না। আর শহুরে বড় হাসপাতালে চিকিৎসা করাবে সে ক্ষমতা ওদের কোথায়? তাই বাধ্য হয়ে নিজস্ব চিকিৎসায় আশ্রয় গ্রহণ করে তারা, যার ফলাফল হয় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু।

 

 

 

এছাড়া মানবসৃষ্ট জঞ্জালেরও শেষ নেই। এ সমস্যাগুলোই মানতাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবার পথে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। আর সে সমস্যার মূলে আছে মহাজন আর জলদস্যুরা। পুলিশের নানা হয়রানির হাত থেকে সারা বছর মানতাদের রক্ষা করেন মহাজনেরা। নদীতে যখন মাছ থাকে না, মহাজন তাদের কিনে দেন চাল, ডাল আর লবণ। মহাজন তাই হয়ে যান বিপদের বন্ধু। বিপদের সময় বন্ধু সেজে মহাজন সওদার নামে ওই জেলেদের দাদন দিয়ে থাকেন। আর ওই দাদনের বিনিময়ে নিজেকে জিম্মি করেন জেলেরা। কিংবা নৌকা বা জালের প্রয়োজনে মানতারা হাত পাতেন মহাজনের কাছে। আর তাতে আজীবনের জন্য বাঁধা পড়েন সুদের কঠিন শিকলে। দিনান্তে যেটুকু মাছ ধরতে পারেন তার সবটুকু মহাজনের আড়তে দিলেও সে দায় থেকে মুক্তি মেলে না। অন্যদিকে জলদস্যুর আক্রমণে প্রায়ই সর্বস্ব হারাতে হয় তাদের। জান-মালের ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই ওদের।