• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ২০, ২০১৯, ০৬:৩৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২১, ২০১৯, ০১:২৭ এএম

ইতিহাসে নারী

ওরা এসেছিলো তিমির রাতের ঘোচাতে অন্ধকার

ওরা এসেছিলো তিমির রাতের ঘোচাতে অন্ধকার

কৃষিভিত্তিক সভ্যতার এই বিশ্বে কৃষি নির্ভরতার সাথে আর যে বিষয়টি মানুষের মগজের কোষে জায়গা করে নেয় তা হলো উর্বরতা। এ উর্বরতা শুধু মাঠে নয় । নারীর মধ্যেও মানুষ উর্বরতা দেখতে শুরু করে। বাঙালির চিরায়ত উৎসব  চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক মেলার মধ্য দিয়ে উর্বরতা চিন্তার প্রকাশটা গুরুত্বের সাথে দেখা যায়। চড়ক মেলায় চড়কটা চান্দ্র মাসের প্রতীক আর চড়ক গাছটা পৌরুষের প্রতীক এমন কি চড়ক গাছের নীচের গঠনটাও পুরুষাঙ্গের আকৃতির।বিশেষত ফসল ওঠার সাথে এসব উৎসবের সম্পর্কের যোগ বিষয়টাও উর্বরতা চিন্তার প্রকাশ। অর্থাৎ বহু আগে থেকেই নারীক দেখা হয় সন্তান উৎপাদনের মূল ভুমিকায়। 

সাম্প্রতিক গবেষণায় বাংলাদেশের বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক ও প্রাচীন ইতিহাস গবেষক মাসুম খান সুস্পষ্টভাবেই কৃষিভিত্তিক প্রাচীন সভ্যতার উৎসরণে নারীদের ভূমিকার বিস্তারিত উপস্থাপন দিয়েছেন। একই সত্যের উপস্থাপন দেখিয়েছেন মানব সভ্যতার সূচনা পট, মিশরীয় সভ্যতার উৎকর্ষের ক্ষেত্রেও। এক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক দেবতত্ত্বের পরিণতির বিপরীতে উঠে এসেছে দেবীতত্ত্বের পরিপূর্ণ আবির্ভাব (বৈদিক ভারত- সূর্য দেবতার উৎস, বিকাশ ও পরিণতি)। তাঁর অপর একটি গবেষণা পত্রে (স্যোম রসতত্ত্বের ভিত্তিতে বৈদিক জনবসতি বিন্যাস) দেখিয়েছেন দেবীরূপে নারীর আবর্তনের বিষয়টি যে শুধুই কাল্পনিক নয় বরং যৌক্তিক এবং নারী তাঁর কৃষ্টির বিকাশের দ্বারা সভ্য সমাজে কি করে ধর্মতত্ত্বের প্রাণ হিসেবে দেবীরূপ প্রাপ্ত হয়েছেন। অথচ পরবর্তীতে সমাজে নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের নানা অনাচারকে বৈধতা দিতে ব্যবহার করা হয়েছে এই ধর্মকেই। অপব্যাখ্যা আর ধর্মীয় অনুশাসনের বিকৃতকরণের মধ্যদিয়ে নারীকে বিক্ষত করা হয়েছে বার বার।

আদিকাল থেকেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে নারীকে সংসারের গন্ডিতে আবদ্ধ করে, নারীর ক্ষমতার বিকাশকে অবরুদ্ধ রেখে তাঁর শক্তিকে  কুক্ষিগত করাটাই ছিলো পৌরুষের কারিশমা। আজো এ দৃষ্টি রণাঙ্গন থেকে সমাজ সংস্কার বিশেষ করে প্রাচীন যুদ্ধকলায় যোগ্যতা, সামর্থ্য, বীরত্ব ছিল পৌরুষের অপর নাম। অপরদিকে নারীদের নমনীয় শারীরিক গঠন ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অধিকাংশ সময়ই তাদেরকে দুর্বল হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে নারীর বৈশিষ্ট্যকে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। অথচ তলোয়ার চালানো বা তীর-ধনুকে লক্ষ্যভেদ করা, নেতৃত্ব প্রদান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কিংবা আর্থ-বানিজ্যিক ক্ষেত্র-- এই প্রতিটি স্তরে নারী যুগে যুগে তার কৃতিত্বের স্মরণীয় ইতিহাস গাঁথা রচনা করেছে। 

যুগে যুগে এমন কিছু সাহসী নারীর আবির্ভাব ঘটেছে যারা সম্মুখ সমরে পরাজিত করেছেন বহু বীরকে। যাদের নেতৃত্ব তাক লাগিয়ে দিয়েছিল প্রাচীন বিশ্বকে। কালের স্রোতে তারা নিজেদের অমর করে রেখেছেন। অহংকারী পুরুষেরা অনেক সময় তাদেরকে হেয় করেছেন আর পরিণতিতে অবধারিতভাবেই পতন স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। আজ তেমনই কয়েকজন নারীর গল্প জেনে নেয়া যাক।

♦ খাদিজা বিনতে খালিদ/বিবি খাদিজা (রাঃ)
পুরুষ শাষিত সমাজ ব্যবস্থার আগ্রাসন এবং নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিকভাবে নানা কর্মকাণ্ডের অংশগ্রহণের সুযোগ না দেয়ার অপসংস্কৃতি ভেঙে মক্কার বুকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খাদিজা বিনতে খালিদ, যিনি ছিলেন বিশ্ব নবী হযরত মুহহহদ (সঃ) সহধর্মীনি। শুধু তাই নয়, তিনিই ছিলেন সেই নারী যার সাথে জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপ‚র্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন নবীজী। তার হতে বর্ণিত নবী মুহম্মদের অনেক হাদীস ও নির্দেশনা আস্থার সাথে ইসলামের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। 

পুরুষের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে নারীমুক্তির কণ্ঠস্বরগুলো যদি শরীয়ত বিরোধী হবে তাহলে কেন তাকে নিজের সহধর্মীনি হিসেবে চেয়েছিলেন বিশ্ব মানবতার আদির্শ নবী মুহম্মদ? এথেকে সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যায় প্রকৃতপক্ষে ইসলাম নারীদের অবরুদ্ধ করার নীতি শিক্ষা দেয় কি না। বলা হয়, নবীজীর এমন অনেক রণ কৌশল, ইসলাম প্রচার এমনকি ব্যবস্থাপনা কাজে একজন আদর্শ সহকারী এবং একজন প্রকৃত বন্ধু ছিলেন হযরত খাদিজা (রাঃ)। নবীজীর অনুপস্থিতিতে তার কাছে কেউ কোন পরামর্শের জন্য আসলে তা একমাত্র বিবি খাদিজারই দেয়া গ্রাহ্য ছিলো। তিনি ছাড়া পবিত্র বাণীর সংকলনেও বেগ পেতে হত মুসলমদের।

♦ নুসাইবাহ বিনতে কাহ'হাব
তাঁর প্রকৃত নাম নুসাইবাহ বিনতে কাহ'হাব আল আনসারিয়াহ (রাঃ)। ইসলাম প্রচারে বাধা সৃষ্টির লক্ষে বহুবার মুসলমানদের ধ্বংসের চেষ্টা চালিয়েছে কাফিররা। এর মাঝে একাধিকবার সেগুলো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। জীবদ্ধশায় আল্লাহর রাস‚ল নবী মুহম্মদ (সঃ) যতগুলো গুরুত্বপ‚র্ণ যুদ্ধ করেছেন সেগুলোতে শুধু হযরত আবু বকর, আলী, ওসমান বা ওমরের মত বীর ও বিশ্বস্তরা ছিলেন না। ছিলেন বহু নারী সাহাবীও। ৫২ বছর বয়সেও তিনি রণাঙ্গনে লড়েছেন। ইসলামের প্রথম যুগেই মুসলিম হয়েছিলেন । তিনি তার স্বামীর সাথে আকাবার বায়াতে অংশ নেন । ইতিহাসে উল্লেখ আছে ৭৩ জন পুরুষ এবং ২ জন মহিলা এই বায়াতে অংশ নেন । উম্মে আমারা (রাঃ) তাদের একজন। 

উহুদের যুদ্ধে যে নবীজীর দিকে ছুটে আসা একের পর এক শত্রুর ছোড়া তীর ঠিক ঢালের মত নিজের দেহে গেঁথে নিয়েছিলেন, তার বিশ্বস্ত দেহ-বর্মের আড়ালে হেফাজত করেছিলেন নবী মুহম্মদ মুস্তফা (সাঃ) কে। ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি এক হাতে বর্শা ও অন্য হতে তারবারি চালাতে চালাতে শত্রু বাহিনীর ব্য‚হ ভেদ করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন। এতে তাঁর দেহের এগারটি স্থান নিযা ও তরবারির আঘাতে আহত হয়। শুধু তাই নয়, একটি হাত বাহু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতেও তিনি সিদ্ধান্ত থেকে টলেননি। এছাড়াও তিনি হুনায়নের যুদ্ধ, ইয়ামামার যুদ্ধ, বায়আতে রিদওয়ান, খায়বার, মক্কা বিজয় এবং হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় উপস্থিত ছিলেন।

খলীফা উমার (রাঃ) এর খেলাফত কালে একবার গনীমতের মালের মধ্যে কিছু চাদর আসে। তার মধ্যে একটি চাদর ছিল খুবই সুন্দর ও দামী। অনেকে বললেন, এটি খলীফা তনয় আবদুল্লাহর (রা) স্ত্রীকে দেওয়া হোক। অনেকে খলীফার স্ত্রী কুলছুম বিনত আলীকে (রা) কে দেওয়ার কথা বললেন। খলীফা কারো কথায় কান দিলেন না। তিনি বললেন, আমি এ চাদরের সবচেয়ে বেশী হকদার উম্মে আমারাকে মনে করি। এটি তাকেই দেব। কারণ, আমি উহুদের দিন তার সম্পর্কে রাস‚লুল্লাহর (সা) বলতে শুনেছি : “ হে উমর, উহুদের ময়দানে আমি যে দিকেই দৃষ্টিপাত করছিলাম, শুধু উম্মু উমারাকেই লড়তে দেখছিলাম।“ অতপর তিনি চাদরটি তার কাছে পাঠিয়ে দেন।

দামতের শাসক জুডিথ ও সিরিয়ার রাণী জেনোবিয়া

♦ জোয়ান অব আর্ক
পরাধীন ফ্রান্সের মুক্তিদাত্রী বীরকন্যা এবং রূপকথাতুল্য এক নেত্রী জোয়ান অব আর্ক ইংরেজদের সঙ্গে শতবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধে ফ্রান্সের সৈন্যবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন। মিউজ নদীর তীরে দঁরেমি গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে ১৪১২ সালে জন্ম নেন এই বীর নারী। জোয়ান লেখাপড়া জানতেন না। কথিত আছে, মাত্র তের বছর বয়সে মাঠে ভেড়ার পাল চরাবার সময় তিনি দৈববাণী শুনতে পান যে তাঁকে মাতৃভূমির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার ও ফ্রান্সের প্রকৃত রাজাকে ক্ষমতায় পূনর্বহাল করার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। এই দৈববানী তাঁর জীবনকে আমূল পালটে দেয়।

সাদা যুদ্ধ পোশাক পরিধান করে, সাদা ঘোড়ায় চড়ে পঞ্চক্রুশধারী তরবারি হাতে ৪০০০ সৈন্য নিয়ে ১৪২৯ সালের ২৮শে এপ্রিল অবরুদ্ধ নগরী অরলেয়াঁয় প্রবেশ করেন জোয়ান। প্রথম আক্রমণেই তাঁরা জয়লাভ করেন এবং এরপর একের পর এক সাফল্য আসতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর নেতৃত্বে তুরেলবুরুজ শহর উদ্ধার হয়। এর পর পাতে'র যুদ্ধেও ইংরেজরা পরাজিত হয়। জুন মাসে জোয়ান তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে শত্রুদের ব্যূহ ভেদ করে রীইঁ নগরী অধিকার করেন। ফ্রান্সের স্বাধীনতার পর ইংরেজরা জোনকে জব্দ করার ফন্দি আঁটতে থাকে। ফ্রান্সের রাজনৈতিক দল বার্গেন্ডি-কর্মীদের বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা জোয়ানকে আটক করতে সক্ষম হয়। তারপর এক ইংরেজ পাদ্রির অধীনে তাঁর বিচারকাজ চলে। বিচারে তাঁর কার্যকলাপকে প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী আখ্যা দিয়ে তাঁকে 'ডাইনি' সাব্যস্ত করা হয়। আইনে এর শাস্তির বিধান ছিল জীবন্ত পুড়িয়ে মারা। এই রায় অনুসারে জোনকেও তাই ১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ফরাসিরা চিরতরে ফ্রান্সে ইংরেজদের সকল অধিকার ও চিহ্ন মুছে দেয়ার প্রয়াস পায়। পৃথিবীর ইতিহাসে জোয়ান অব আর্ক এক প্রেরণার অনির্বাণ শিখার মত।

ফরাসী অগ্নিকন্যা জোয়ান অব আর্ক

♦ জুডিথ
জুডিথ ৯৬০ খ্রিস্টাব্দে দামোত নগরের শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি প্যাগান (মতভেদে ইহুদি) ধর্মাবলম্বী ছিলেন। আমহারিক ভাষায় তাকে ‘এসাতো’ বলে ডাকা হয়, যার অর্থ আগুন। তিনি এক্সম নগর আক্রমণ করে ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। এক্সম ছিল তৎকালীন ইথিওপিয়ার পবিত্র রাজধানী। জুডিথ একাধারে সব স্মৃতিসৌধ ও গীর্জা ধ্বংস করে এক্সম ও তার আশেপাশের এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করেন। তিনি রাজবংশের সকল সদস্যকে (সেবার রানীর বংশধরদের) হত্যা করে তাদের সম্প‚র্ণ চিহ্ন মুছে দিতে চেষ্টা করেন। তার কর্মকাÐ লোকমুখে বর্ণিত হয়ে আসছে এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলেও তার উল্লেখ রয়েছে। ধারণা করা হয়, তিনি সম্রাটকে হত্যা করে ক্ষমতায় বসেন এবং একটানা চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। উত্তর ইথিওপিয়ার কৃষক স¤প্রদায়ে এখনও তার নির্যাতন ও ইতিহাসের কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। 

♦ ট্র্যু থি ত্রিন বোনদ্বয়
ট্র্যু থি ত্রিন ৩য় শতকের একজন ভিয়েতনামী যোদ্ধা, যিনি চীনের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। তিনি ভিয়েতনামে ‘ঊ’ রাজত্বের সময় সফলভাবে দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। তিনি থান হোয়া প্রদেশের ট্র্যু সন জেলায় জন্মগ্রহণ করেন (বর্তমানে উত্তর ভিয়েতনামে অবস্থিত)। তার জন্মের সময় এলাকাটি চীনের তিন রাজ্যের অন্যতম প‚র্ব ঊ সাম্রাজ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। খুব অল্প বয়সে এতিম হয়ে ত্রিন তার ভাই ও তার স্ত্রীর নিকট দাসীর ন্যায় বেড়ে উঠেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি সেখান থেকে জঙ্গলে পালিয়ে যান। বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রায় ১,০০০ পুরুষ ও নারী সৈনিকের মিলিত বাহিনী গড়ে তোলেন ত্রিন।

ট্র্যু ত্রিন এই বাহিনীর মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ভিয়েতনামের একটি এলাকা দখল মুক্ত করতে সক্ষম হন এবং নিজেই স্বতন্ত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি অন্তত ৩০টি ঊ আগ্রাসন সম্প‚র্ণ রুখে দেন। লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, তিনি হাতির পিঠে চড়ে, গায়ে সোনার বর্ম পরে, হাতে দু’টি তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে যেতেন। 

♦ নরফোকের রানী ব্যুদিক্বা
ব্যুদিক্বা ছিলেন নরফোকের সাধারণ জনগণের রানী। তিনি রোমান সাম্রাজ্যের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগঠিত বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। তার স্বামী, নরফোকের রাজা যখন মারা যান, তিনি তার রাজ্য যৌথভাবে তার কন্যা ও রোমান সম্রাটের অধীনে ন্যস্ত করে দেন। কিন্তু রোমানরা এই যৌথ শাসন স্বীকার না করে পুরো সাম্রাজ্য দখল করে। ব্যুদিক্বাকে চাবুক মেরে তাড়িয়ে দেয়া হয় আর তার কন্যারা হয় ধর্ষণের শিকার। শেষ পর্যন্ত নরফোক এবং প্রতিবেশী এলাকার জনগণ তাকে নেতা হিসেবে নির্বাচন করে ও তার নেতৃত্বে রোমানদের ওপর হামলা করে। এ যুদ্ধে তার সেনাবাহিনী ব্যাপক সাফল্য পায়। তারা কামুলোডুনম শহর (বর্তমান কোলচেস্টার) সম্প‚র্ণ ধ্বংস করে ফেলেন।

ইতিহাসবিদ কর্নেলিয়ুস টেসাইতাস এর মতে ব্রাইটনরা (নরফোক অধিবাসী) বন্দী গ্রহণ করতে ন্য‚নতম আগ্রহী ছিল না। তারা সরাসরি হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। বলা বাহুল্য, রোমান সৈন্য কর্তৃক নিজ রাজকন্যার সম্মানহানির প্রতিশোধ তারা যথেষ্ট বর্বরতার সাথে গ্রহণ করেছিল। সময়ের পরিহাসে প্রচন্ড সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিদ্রোহী এই রানীর ম‚র্তি এখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতীক হয়ে সেই শহরেরই দাঁড়িয়ে আছে, যা একসময় তিনি নিজেই ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত করেছিলেন।

ট্র্যু থি ত্রিন বোনদ্বয়

♦ প্রথম আরতেমিসিয়া
কারিয়ার প্রথম আরতেমিসিয়া ছিলেন পারস্যের পক্ষ থেকে নিযুক্ত আইওনিয়ার শাসনকর্তা এবং ইতিহাসে উল্লেখিত প্রথম নারী নৌবাহিনী প্রধান। সালামিসের যুদ্ধে তার ভ‚মিকার জন্যে তাকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করা হয়। একমাত্র তিনিই পারস্যের রাজা জারজিসকে সমুদ্রে যুদ্ধ না করে গ্রীক বাহিনীর সাথে স্থলযুদ্ধের পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি সে উপদেশ গ্রহণ না করে জলপথে অগ্রসর হন।

৪৮০ খ্রিস্টপ‚র্বাব্দে পাঁচটি জাহাজের প্রধান হিসেবে আরতেমিসিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে গ্রীকরা তার বিশেষ রণতরী দখলের খুব কাছাকাছি চলে আসে। সেই সময় বাঁচার জন্য তিনি একটি দারুণ ফন্দি আঁটেন। তিনি নিজের একটি জাহাজ নিয়ে পারস্য বাহিনীর আরেকটি জাহাজে আক্রমণ করেন, যাতে গ্রীকরা ধরে নেয় আরতেমিসিয়া তাদের পক্ষে। অন্য জাহাজটি ডুবিয়ে দিতেই গ্রীক বাহিনী তার নৌবাহিনীকে ছেড়ে অন্য দিকে মন দেয়। এদিকে কাছেই এক পাহাড়ের চ‚ড়া থেকে এই দৃশ্য দেখে জারজিস মনে করেন আরতেমিসিয়া শত্রু জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছেন এবং তার সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। জারজিস তার যুদ্ধ কৌশলে এতই মুগ্ধ হন যে তিনি বলেন,“আমার পুরুষেরা সব মেয়েমানুষ হয়ে গেছে আর মেয়েরা পুরুষ হয়ে উঠেছে”। আরতেমিসিয়া অন্য জেনারেলদের পরামর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে জারজিসকে এশিয়া মাইনরে পিছিয়ে যাওয়ার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে পারস্যের সবচেয়ে বড় পরাজয় ঘটে।

♦ ফু হাও
ফু হাও ছিলেন চীনের সাং রাজবংশের রাজা উ ডিং এর স্ত্রী, যিনি ১২৫০ থেকে ১১৯০ খ্রিস্টপ‚র্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন এবং সফল নারী সেনাপতি সম্ভবত তিনিই। তিনি একইসাথে সর্বোচ্চ প‚জারী এবং সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, সে সময়ের জন্যে যা ছিল এক অভিনব ব্যাপার। ইয়িনঝুতে (সাং রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ, ইয়িন) তার সমাধি সব সম্পদসহ সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়েছে। সমাধিতে পাওয়া গেছে নানা রকম অস্ত্র ও সমরসজ্জা। আধুনিক পন্ডিতেরা ম‚লত সাং রাজবংশের ওরাকল অর্থাৎ হাড়ের তৈরি শিল্প নিদর্শনে পাওয়া লেখা প্রাচীন লিপি থেকে তার কথা জানতে পারেন।

প্রাচীন চিত্রে তাকে বহু সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দিতে দেখানো হয়েছে। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান অধিনায়ক। বহু প্রজন্ম ধরে টু-ফ্যাং গোত্র সাং সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছে। ফু হাও অবশেষে তাদেরকে একক যুদ্ধে এমনভাবে পরাজিত করেন যে, আর কখনোই তারা সাং সাম্রাজ্যের জন্যে হুমকি হয়ে উঠতে পারেনি। এরপর তিনি প্রতিবেশী ইয়ি, কিয়াং এবং বা-ফ্যাং এর বিরুদ্ধে আরো বড় অভিযান চালান এবং বিশাল সাফল্য অর্জন করেন। বিশেষ করে ‘বা’ এর যুদ্ধ ছিল চীনের ইতিহাসে পাওয়া প্রাচীনতম বড় মাপের গেরিলা হামলা। এই যুদ্ধের বর্ণনায় বা-ফ্যাং বাহিনীকে মরণফাঁদে ডেকে আনতে ফু হাও’র বিশেষ সমরকৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রায় ১৩,০০০ সৈন্য নিয়ে তিনি তার সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর নেতা ছিলেন।

♦ প্রথম আহহোতেপ
প্রথম আহহোতেপ মিশরের নতুন রাজত্ব্ প্রতিষ্ঠাকালে একজন গুরুত্বপ‚র্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ধারণা করা হয়, অষ্টাদশ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তিনিই কেন্দ্রীয় ভ‚মিকা পালন করেন। তার বাবার মৃত্যুর পর রাজপ্রতিভ‚ হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী জীবনযাপন করেছেন। মিশরে হিসকোস বাহিনীর আগ্রাসনের পর তিনি তার দুই ছেলে কামোসে এবং আহমোসের মাধ্যমে সমগ্র মিশরকে একত্রিত করেন। হিসকোস হানাদারদের মিসর থেকে বিতাড়িত করতে তিনিই ছিলেন মূল চালিকাশক্তি।

মিসরীয় ঐতিহাসিকেরা সেই সময়ে প্রথম আহহোতেপের ভ‚মিকার ভ‚য়সী প্রশংসা করেছেন। বলা হয়, তিনিই মিসরের রীতিনীতি, নিয়ম-কানুন বাস্তবায়িত করেছেন এবং মিশরের যত্ন নিয়েছেন। তিনি সৈন্যদের দেখভাল করেছেন, প্রহরী হয়ে দেশের রক্ষা করেছেন, পলাতকদের মাতৃভ‚মিতে ফিরিয়ে এনেছেন। যারা দেশ পরিত্যাগ করেছে তাদেরকেও পুনরায় একত্র করেছেন। মিসরের উত্তরাংশে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন ও তার বিদ্রোহীদের বহিষ্কার করেছেন।মৃত্যুর পর তাকে ‘যোদ্ধা রানী’ হিসেবে সম্মানিত করা হয়। হিসকোসদের বিতাড়িত করতে তার ভ‚মিকার স্বীকৃতি স্বরূপ তার পুত্র তাকে ‘অর্ডার অব ভেলর’ প্রদান করেন। মাছি আকৃতির এই নেকলেস তার সমাধিক্ষেত্র থেকে পাওয়া গেছে। এছাড়া অন্যান্য অস্ত্রের সাথে একটি খোদাই করা কুঠার পাওয়া গেছে, যেখানে দেখানো হয়েছে প্রথম আহমোসে এর আঘাতে এক হিসকোস সৈন্য লুটিয়ে পড়ছে।

সাং রাজবংশের রাণী ফু হাও এবং নরফোকের রানী ব্যুদিক্বা

♦ জেনোবিয়া
সেপটিমা জেনোবিয়া ২৫০ সাল থেকে প্রায় ২৭৫ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন। সমরাস্ত্রে সজ্জিত জেনোবিয়া ঘোড়ার পিঠে চড়ে তার সেনাবাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতেন। জেনোবিয়ার স্বামী অডেনথাস ছিলেন রোম নিযুক্ত সিরিয়ার শাসনকর্তা। তার মৃত্যুর পর জেনোবিয়া শাসক পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু তিনি রোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে সিরিয়ার আশেপাশের অঞ্চল এবং মিসরীয় বিদ্রোহ দমন করে মিসর দখল করেন। এ সময় মিসর পুনর্দখলের চেষ্টায় রোমের সম্রাট ক্লডিয়াসের সৈন্যবাহিনী তার কাছে চ‚ড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। ফলে এশিয়া মাইনরের একটি বড় অংশ থেকে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

আর্মেনিয়া, আরব ও পারস্য তার সাথে মিত্রতা স্থাপন করে এবং তিনি নিজেকে উত্তরাধিকার স‚ত্রে মিশরের রানী ঘোষণা করেন। ধীরে ধীরে জেনোবিয়া রোমান সাম্রাজ্যের সম্প‚র্ণ প‚র্বাঞ্চল নিজ শাসনের অধীনে নিয়ে আসেন এবং রোমকে অগ্রাহ্য করে নিজের রাজত্বের সীমানা বৃদ্ধি করেন। ক্লডিয়াসের উত্তরস‚রী সম্রাট অরেলিয়ান জেনোবিয়াকে পরাজিত করতে তার সবচেয়ে অভিজ্ঞ সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে। তারপরও দীর্ঘ চার বছরের যুদ্ধ আর অবরোধের পর অবশেষে রাজধানী শহর পালমায়রার পতন ঘটে।

কথিত আছে জেনোবিয়ার সঙ্গে মিত্র প্রদেশগুলোর আরও ৯ রানীকে শিকল পরিয়ে রোমের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয়। অরেলিয়ান রাজনীতিতে জেনোবিয়ার প্রভাব কমাতে তাকে টাইবুরে (মতান্তরে রোমে) নির্বাসিত করে। নির্বাসিত হলেও অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, এক রোমান প্রাসাদে তিনি বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। তার কন্যারা রোমান প্রভাবশালী পরিবারে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফলে আরও প্রায় তিন শতাব্দী ধরে রোমান রাজনীতিতে নির্বাসিত জেনোবিয়ার বংশ গুরুত্বপ‚র্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারই বংশধর মাভিয়া ৩৭০ সাল থেকে ৩৮০ সাল পর্যন্ত এক আরব বেদুইন গোত্রের রানী ছিলেন। তিনি রোমান বাহিনীকে পরাজিত করে তার গোত্রের অনুকূলে শান্তি চুক্তি করেন এবং রোমান সম্রাট ভ্যালেন্সের সেনাপ্রধানের সাথে তার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে একটি মজবুত সম্পর্ক স্থাপন করেন।

জর্জিয়ার রাজা জর্জের দুঃসাহসি কন্যা তামারা

♦ তামার, জর্জিয়া
তামার (কারো কারো মতে তামারা) ছিলেন জর্জিয়ান রাজা তৃতীয় জর্জের কন্যা। তামারের বাবা তার মৃত্যুর পর যেকোনো মতানৈক্য ও বিভেদ রোধে জীবদ্দশায় তাকে যুগ্ম শাসক নিয়োজিত করেন এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকার ঘোষণা করেন। তার বাবার মৃত্যুর পর তামার অসামান্য শাসক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। নারী হওয়ার কারণে শুরুতে স্বাভাবিকভাবেই অভিজাত মহলে নানারকম চক্রান্ত ও ক‚টচালের সম্মুখীন হয়েছেন তামার, এমনকি বিদ্রোহের আশঙ্কাও দেখা দেয়। কিন্তু অসামান্য বুদ্ধিমত্তা আর ক‚টনৈতিক দক্ষতায় কোনোরূপ সহিংসতা ছাড়াই তিনি সব অভিযোগকারীদের মনে স্থান করে নেন। প্রজারা ভালোবেসে তাকে ‘রাজাদের রাজা’ ও ‘রানীদের রানী’ উপাধি দিয়েছিলেন।

তামার সামরিক নেতা হিসেবে সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করতেন। সেই সাথে সাহিত্য ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতায় তার বিশেষ ভ‚মিকা ছিল। তার শাসনকালে জর্জিয়া সাম্রাজ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছায়। তার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা মহাকাব্য ‘দ্য নাইট ইন দ্য প্যানথার’স স্কিন’ আজও জর্জিয়ার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে জর্জিয়ার সোনালি যুগ হিসেবে ইতিহাসে যে সময়ের বর্ণনা করা হয়, রানী তামার ছিলেন তার সূতিকাগার।১২০১-১২০৩ সালের মধ্যে জর্জিয়া আর্মেনিয়ার তৎকালীন রাজধানী আনী ও দ্বভিন অধিকার করে নেয়। ১২০৪ সালে তামার তার সেনাবাহিনী নিয়ে ক্বার শহর দখল করেন । একই সময়ে তামার কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণে ত্রেবিজন্ড সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন, বর্তমানে যার রাজধানী ত্রাবজোন তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত। তামার এতটাই জনপ্রিয় ও শক্তিশালী রানী ছিলেন যে তাকে ‘মেপে’ উপাধিতে সম্বোধন করা হতো, যার অর্থ ‘রাজা’ এবং তার স্বামীর উপাধি ছিল ‘রাজসঙ্গী’।

ডিজি                               

লেখক: সহ-সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ