• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৪, ২০১৯, ০৫:৪৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২৪, ২০১৯, ০৫:৪৪ পিএম

বাঘ বিধবাদের গল্প

বাঘ বিধবাদের গল্প

শোনো তুমি মা বনবিবি

বলিগো তোমারে

অভাগিনি শরণ নেলে

তোমারই চরণে।

(ও মা) তোমারই চরণে…


সুন্দরবনের ত্রাতা বনবিবি। সুন্দরবন ও এর আশপাশের মানুষ বনবিবির নাম নিয়ে তাঁর পূজা দেয়। এরপর তারা বনে প্রবেশ করে। তারপরও অনেক সময় শেষ রক্ষা হয় না। বনজীবীদের স্ত্রীরা যুগ যুগ ধরে বনবিবিকে সন্তুষ্ট রাখতে এ গান গায়। তারপর তারা স্বামীদের বনে পাঠায়। বনজীবীরা যখন বনে যায়, ভয়-ডর ফেলেই যায়। যদিও হঠাৎ বাঘের মুখে পড়লে তাদের করার কিছু থাকে না। সুবিধামতো পড়লে বাঘও বনজীবীদের সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে যায়। তবে সে ঘটনা হাতে গোনা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ভাগ্যহীন মানুষগুলো বাঘের পেটে যায়। যখন এ খবর লোকালয়ে আসে, কান্নাকাটির রোল পড়ে। অথচ দোষী সাব্যস্ত হয় মৃতের স্ত্রী! সমাজ তার নাম দেয় ‘বাঘ বিধবা’। ‘অপয়া’ ‘কুলটা’ ‘রাক্ষস’- তখন অনেক নাম হয় এই বাঘ বিধবাদের।


কারও স্বামী মারা গেলে বউ বিধবা হবে। আর বিধবা তো বিধবাই। এখানে আর এক কাঠি যোগ করে বলা হয়- বাঘ বিধবা। যদি কোনো বিবাহিত পুরুষ বাঘের পেটে চলে যায় তখন বাড়িতে তার স্ত্রী সন্তানের যে তখন কী অবস্থা হয় সেটা বলার মতো নয়। স্ত্রীর তখন সমাজে ঠাঁই হয় না। দুর্ভাগ্যের বিষয় এ অবস্থায় মৃতের ছেলেমেয়েরাও থাকে কমবয়সী। ফলে ছোট ছোট সন্তান নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ান বাঘ বিধবারা। পথের সঙ্গী হিসেবে তখন তারা কাউকে পান না। যেহেতু বাঘের আক্রমণে মৃতদের বনে যাওয়ার অনুমতিপত্র থাকে না তাই তাদের স্ত্রী-সন্তান পরবর্তী সময়ে সরকারি সহযোগিতা থেকেও বঞ্চিত হন। সমাজচ্যুত হয়ে তারা অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন যাপন করতে থাকেন।


সংস্কার না কুসংস্কার
সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামগুলোর একটি বড় অংশ কুসংস্কারের আঁধারে ডুবে আছে। একসময় যখন স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীকে সহমরণে যেতে হতো বাঘ বিধবাদের অবস্থা দেখলে সে কথাই মনে পড়ে। সুন্দরবনে প্রবেশের আগে বনজীবীরা বনবিবির পূজা করে। এটা স্থানীয় সংস্কৃতি। কিন্তু বাকিটা শুধুই কুসংস্কার। যেমন কারও স্বামী সুন্দরবনে গেলে সেই নারী অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না, চুল আঁচড়াতে পারেন না, এমনকি তিনি চুলে তেলও মাখতে পারেন না। স্বামী যত দিন বনে থাকবে তাদের খোলা চুলে চলাফেরা করা বারণ। এ সময় তারা সাবানও ব্যবহার করতে পারেন না; বা কোনো প্রসাধন। রান্নার জন্য মরিচ পোড়াতে পারেন না তারা। সব ধরনের ভাজা-পোড়া তখন বন্ধ। এত কিছু স্ত্রীদের মেনে চলার পরও যখন কারো স্বামী বাঘের আক্রমণে মারা যান তখন সব দোষ গিয়ে পড়ে স্ত্রীর ওপর। সমাজ ধরে নেয় স্ত্রীর ব্রত পালনে কোথাও হয়তো গাফিলতি হয়েছে। তাই স্বামীর মৃত্যুর পর সমস্ত দায় তাকে বহন করতে হয়।


ভাগ্যের বিড়ম্বনা এখানেই শেষ নয়। ‘অপয়া’ অপবাদ পাওয়া এ নারীদের বেশির ভাগেরই ঠাঁই মেলে না শ্বশুরবাড়িতে। সমাজে থেকেও  তাদের ‘একঘরে’ থাকতে হয়। তারা যদি এ সময় যৌন নির্যাতনেরও শিকার হন তাহলে দোষের তীর তাদের দিকেই তাক করা থাকে। বিচারে ধর্ষকের কোনো সাজা হয় না। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ঘটে এমন ঘটনা। একবিংশ শতকের সমস্ত অন্ধকার যেন সেখানে সজাগ পাথরের মতো শুয়ে আছে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ এলাকায় গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন বাঘ বিধবার। তারা বলেছেন, জীবিত থেকেও মৃতের মতো জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। নারী সংঠগন লিডাসের তথ্য মতে, সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় প্রায় সাড়ে এগারোশ বাঘ বিধবা নারী রয়েছেন। ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাঘের আক্রমণে মারা গেছেন এক হাজারেরও বেশি বনজীবী। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাঘের আক্রমণে কারও নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।




কয়েকজন বাঘ বিধবার কথা :
সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার আলোচিত মুখ সোনামণি। তার দুই স্বামীকে জীবন দিতে হয়েছে বাঘের আক্রমণে। তার মুখ দেখলে কেউ ‘শুভ কাজে’ বের হন না বলে তিনি জানান। সোনামণি বলেন, ‘১৯৯৯ সালে আমার স্বামীকে বাঘ ধরে নিয়ে যায়। সে কারণে কোলের এক মাস বয়সী বাচ্চাসহ আমার শাশুড়ি আমাকে তাড়িয়ে দেন। তখন আমাকে বাচ্চা নিয়ে পথে পথে ঘুরতে হয়েছে। পরে আমার দেবর আমাকে বিয়ে করে। ২০০৩ সালে তাকেও বাঘে ধরে। এরপর থেকেই আমাকে অপয়া, অলক্ষ্মী, স্বামীখেকো অপবাদ মাথায় নিয়ে থাকতে হচ্ছে। সকালে উঠে যেন আগে আমার মুখ দেখতে না হয়, তাই শাশুড়ি আমাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন। এ জীবন তো মৃত্যুর মতোই। স্বামী গেল বাঘের পেটে, আমাকেও সে মেরে রেখে গেল।’


বাঘ বিধবা বলি দেশাই বলেন, ‘আমার স্বামী ২০০২ সালে সুন্দরবনে নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়। এ জন্য আমাকেই দায়ী করে নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে সবাই মিলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। আমার বাবা মারা গেছে অনেক আগে। তাই ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে উঠি। এখন নদীতে রেণু পোনা ও কাঁকড়া ধরে সংসার চালাই। কোনো মতে বেঁচে আছি। অনেক কষ্ট করে  ছেলেমেয়েদের বড় করছি।’



কাঁদতে কাঁদতে বুলি দাসী বলেন, ‘আমার মতো এমন অনেক মেয়ে আছে, যাদের স্বামী বাঘের হাতে মারা যাওয়ার পর তাদের অপয়া বলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার স্বামীর ছোট ভাইও বাঘের আক্রমণে মারা যায়। তার বউ দিপালিকেও তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’ কমলা রানী মন্ডল বলেন, ‘ স্বামী তো গেছেই, এক দেবরও খোরাক হয়েছে বাদাবনের বাঘের। শ্বশুর বাসুদেব মণ্ডল দুই ছেলেকে বাঘে খাওয়ার সাক্ষী। সন্তানদের বাঘের মুখে রেখে পালিয়ে এসে সেদিন বেঁচে গেছেন তিনি। অথচ এখন চোখ ভেজে না তার।’ সীতা রানীর স্বামীকে বাঘে নিয়েছে বছর সাতেক হলো। তার মতে, বাঘ বিধবারা নিজেদের সমাজে চক্ষুশুল। যে পর্বের শুরু হয় স্বামী বনে যাওয়ার শুরু থেকেই। ওই মুহূর্ত থেকে সব সময় বাঘের কবল থেকে স্বামীকে রক্ষার জন্য প্রার্থনা করেছে তারা। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। 


বাঘ বিধবা : লবণ পানির নির্মম শিকার
দক্ষিণ অঞ্চল যেখানে বীজ বুনলে এক সময় সোনার ফসল ফলত, গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ছিল। কিন্তু লবণ পানির চিংড়ি চাষের কারণে এখানকার মানুষ নব্বইয়ের দশকে কৃষি থেকে উৎখাত হতে থাকে। ভূমিহীন হয়ে যেতে থাকে প্রান্তিক কৃষক। বেকার হয়ে পড়ে বর্গা চাষী ও কৃষি শ্রমিক। বিপদসংকুল সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে থাকে এলাকার মানুষ। পেশা পরিবর্তন করতে থাকে তারা। এভাবেই সুন্দরবনের প্রান্ত সীমায় বনজীবীদের আবাস গড়ে ওঠে। পেশায় তারা সুন্দরবনের জেলে, বাওয়ালী, মৌয়ালী, পোনা সংগ্রহকারী। এ সকল পরিবারের আয়ক্ষম সদস্যরা যারা সুন্দরবনে যান তারা অনেকেই বাঘ ও কুমিরের আক্রমণের শিকার হন এবং মৃত্যুবরণ করেন।


শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন গাবুরা ইউনিয়ন। এই ইউনিয়ের চারপাশে নদী। এই দ্বীপ জনগোষ্ঠীকে সুন্দরবন, নদী এবং লবণাক্ত কৃষি জমির উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়। আইলা দূর্গত গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামের বাঘ বিধবা ময়না বেগম। পরিবারের সদস্য ৩ জন। ময়না বেগম বলেন, ‘লবণ পানির চিংড়ি ঘের না হলে আমি বাঘ বিধবা হতাম না। আমার স্বামী দিন মুজুরের কাজ করত। স্বামী সন্তান নিয়ে খেয়ে পরে চলছিল। এলাকার কৃষি জমিতে দৈনিক কাজ করতে পারত। কিন্তু ১৯৯০ সালের পর থেকে কৃষি জমিতে লবণ পানি তুলে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। ধীরে ধীরে চিংড়ি ঘের বিস্তার লাভ করে। আমার স্বামী কাজ হারাতে থাকে আর কপাল পুড়তে শুরু করে আমার। কোনো কাজ না থাকায় সে সুন্দরবনে মধু কাটতে গিয়েছিল। আর ফেরেনি। এখন নদীতে জাল টেনে চলে আমার জীবন।’


গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামের বাঘ বিধবা খালেদা আক্তার। তিনি বলেন, ‘এলাকায় চিংড়ি ঘের বেড়ে যাওয়ায় আমার স্বামীর কাজের অভাব দেখা দেয়। ফলে বাধ্য হয়ে সে সুন্দরবনে যায়। আমি নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু পেটে যে বড় ক্ষুধা। তারপর থেকেই ৪ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে শুরু হয় আমার কষ্টের জীবন। একমাত্র মৃত্যু পারে এমন জীবন থেকে বাঁচাতে।’