• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ৩০, ২০১৯, ০৬:৪৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১, ২০১৯, ১২:৪৭ এএম

গানে কবিতায় মে দিবস

গানে কবিতায় মে দিবস

সভ্যতার রূপায়ন ঘটেছে শ্রমিকের হাতুড়ির আঘাতে আঘাতে। শ্রম দিয়েই দুনিয়ার অগ্রযাত্রা। শ্রমেই সৃষ্টি। অথচ শ্রমিক তার অধিকার হারা সভ্যতার শুরু থেকেই। ইটের ওপর ইট গেঁথে আকাশচুম্বী প্রাসাদে বসে যখন মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন বোনা হয় ঠিক তখনও শ্রমিকেরা অধিকার আদায়ে বুকের রক্ত ঝরায়। বঞ্চিত খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষদের অধিকার আদায়ের ইতিহাস ১৩২ বছর পেরুল।
হাজার বছরের বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের এদিন বুকের রক্ত ঝরিয়েছিলেন শ্রমিকেরা। মে দিবস, শ্রমিকের জয়গান। সেই গান কতজন কতভাবে প্রকাশ করেছে তা লিখে শেষ করা যাবে না। শ্রমিকের সংগ্রামের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে অনেক লেখক , শিল্পী, গীতিকবি।

 

 তুর্কি মরমি কবি দাদায়েম ঈমাস এ-কথাগুলো বলেছেন (সংগৃহীত)। আর, শ্রমিক-জীবনের সঙ্গে কান্নার সম্পর্ক নিবিড়।‘কাঁদো, যখনি কাঁদতে ইচ্ছে করবে। কান্না শুদ্ধতম আবেগ প্রকাশের সর্বোচ্চ মাধ্যম।
মে’র অধিকার আর মজুরি– মে দিবসের মূলকথা। আর সেসব কথা নানাভাবে উঠে এসেছে মে দিবসের গানে-কবিতায়।
ইতিহাসের পরম্পরায় মহাকাব্যিক দ্যোতনায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে পহেলা মে। মে দিবসকে কেন্দ্র করে বিশ্বসাহিত্যে গীত হয়েছে অসংখ্য গান। পহেলা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতির দিন। কার্ল মার্কস বিশ্বের নিপীড়িত শ্রমিকদের আত্মিকবন্ধনকে দৃঢ় করতে লিখেছেন ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। এই স্লোগান সারা বিশ্বের শ্রমিকদের সঙগ্রামের মূল মন্ত্র। শ্রমিক শ্রেণির জন্য দৃপ্ত শপথে বলীয়ান হওয়ার দিন, শেকল ছেঁড়ার দিন, আনন্দ ও উৎসবের দিন, একই সাথে শোকেরও দিন।

গোড়ার দিকে ফিরে গেলে দেখা যাবে, ১৮৬০ সালে শ্রমিকরা তাদের মজুরি না-কমিয়ে সারা দিনে আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের জন্য দাবি জানান। এ জন্য তারা একটি সংগঠনও তৈরি করেন, পরবর্তীকালে যার নাম হয় আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার। এই সংগঠন শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অবিরত আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। এর পর, ১৮৭১ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ফ্রান্সের প্যারিসে ভার্সাই-এর সেনাদলের সাথে রাস্তায় রাস্তায় রক্তাক্ত সংঘর্ষে পরাজিত হতে থাকে শ্রমিক অধিকারের এই আন্দোলন। এই সময় ফরাসি কমিউনিস্ট এবং পরিবহন কর্মচারী ইউজিন পোটিয়ে রচনা করেন বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলনের গান ‘ইন্টারন্যাশনালে’। 

 

১৮৮৪ সালে সংগঠনটি দিনে কাজের সময় ‘আট ঘণ্টা’ নির্ধারণের জন্য মালিকপক্ষের কাছে সময় বেঁধে দেয়। সময় দেওয়া হয় ১৮৮৬ সালের ১ মে পর্যন্ত। বারবার মালিকপক্ষের কাছে দাবি জানানো হলেও একটুও সাড়া মেলে না। পহেলা মে যতোই এগিয়ে আসছিল, দুই পক্ষের সংঘর্ষ তীব্র হয়ে উঠছিল। পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন লাখ শ্রমিক কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসেন। আন্দোলন চরমে ওঠে। ৩ মে, ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা শিকাগোর হে মার্কেট বাণিজ্যিক এলাকায় জড়ো হওয়া শ্রমিকদের দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিছু পুলিশ সদস্য। এমন সময় হঠাৎ আততায়ীর বোমা বিস্ফোরণে কিছু পুলিশ আহত হন, পরে মারা যান ছয়জন। 

পরে পুলিশও শ্রমিকদের ওপর আক্রমণ চালালে নিহত হন ১১ জন শ্রমিক। পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের হত্যামামলায় অভিযুক্ত করে ছয়জনকে প্রহসনমূলকভাবে দোষী সাব্যস্ত করে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। কিন্তু এই মিথ্যা বিচারের অপরাধ শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। ১৮৯৩ সালের ২৬ জুন ইলিনয় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মিথ্যে ছিল ওই বিচার। পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের ‘দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ’-এর দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়।

সেই থেকে পহেলা মে পালিত হয় শ্রমিকদের আত্মদান আর দাবি আদায়ের দিন হিসেবে। বর্তমানে ৮০টিরও বেশি দেশে মে দিবস মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। বিখ্যাত প্রতিবাদী সংগীত তারকা পিট সিগার ‘টকিং ইউনিয়ন’ গানের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে ন্যায্য অধিকার আদায়ের প্রতি সমর্থন জানান।উল্লেখ্য, শ্রমিকদের প্রতিবাদ ভাঙতে মালিকপক্ষ চাপ সৃষ্টি করতে দ্বিধা করেনি। ধর্মঘটের নেতারা ছিলেন তাদের কাছে সব গোলমালের সূত্র। ফলে শ্রমিকদের দাবির কথা বলেছেন যারা, তারা কঠোর দমননীতির শিকার হয়েছেন। এমনই একজন ছিলেন জো হিল। অভিবাসী শ্রমিক ও সংগীত রচয়িতা জো হিলকে হত্যার অভিযোগে প্রাণদণ্ড দেয়া হয় ১৯১৫ সালে। হিল অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেন বারবার।

 

 তারই নামে রচনা করা হয়েছে একটি গান যা অমরত্বের দাবি করতে পারে। কণ্ঠ দিয়েছেন কিংবদন্তি সংগীত তারকা জোয়ান বায়েজ। ১৮৮৯ সালে জিম কোন্যাল লিখেন রেড ফ্লাগ নামে একটি গান। যার প্রথম চরণ : জনতার পতাকা টকটকে লাল/ ঢেকে রাখে শহীদের লাশ/ শক্ত শীতল তাদের দেহ/ এই পতাকার প্রতি ভাঁজে ভাঁজে / হৃদয়ের রক্ত রাঙায় এই পতাকা।’ এটি একটি দীর্ঘ সংগীত। অসামান্য তার দ্যোতনা। মানুষের বেদনার কথা উঠে এসেছে বর্ণনায়। একইভাবে বব হার্ট, কপল্যান্ড, অ্যাসলেট প্যাটিশ মহান মে দিবস ও শ্রমিকের অধিকার নিয়ে গান লিখেছেন।

মে-দিনের কবিতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন :
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।
চিমনীর মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালোবাসতে।

মে দিবস নিয়ে এমন কবিতা বাংলার আর দ্বিতীয়টি রচনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গাওয়া গান জন হেনরি, গানটিচ অনুবাদ সঙ্গীত হরেও শ্রম মেহনতের কাছে এর যে  আবেদন তা অনন্য। তাই গা্নটি বাইরের হলেও এটা আমাদের শ্রম- মেহনতের মূর্ত প্রতীক বলে মনে হয়। এটি এমন এক গান যা আমাদের চিন্তা জগতকে মুহূর্তে নাড়িয়ে দেয়, আলোড়ন তোলে যা পরিষ্কার একটি মহাসড়কের দিকে আহ্বান করে, যেখানে মানুষের মুক্তিই চূড়ান্ত কথা। অমর সেই গান :

‘নাম তার ছিল জন হেনরি
ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন
হাতুড়ির তালে তালে গান গেয়ে শিল্পী
খুশি মনে কাজ করে রাত-দিন
হো হো হো হো খুশি মনে কাজ করে রাত-দিন।’

 

 

ইজিন পাতিয়েরের  লেখা আঠারোশ’ ছিয়াশির পহেলা মে গানটি মে দিবসের প্রথম গান হিসাবে খ্যাত। সারা বিশ্বের নিপীড়িত শ্রমজীবিরা বেশ গতিশীল এ গানটিকে ব্যবহার করে শ্রমশোষনের হাতিয়ার হিসাবে। যেসব গনসংগীত মানুষের সংগ্রামে প্রেরণা যোগায়। ‘কারখানাতে ক্ষেতখামারে শহর-গাঁয়ে আর পাহাড়ে’; ‘অধিকার কে কাকে দেয়’; মতলুব আররি লেখা ‘লাঞ্ছিত নিপীড়িত মানুষের জয়/ শোষিত মানুষের একতার জয়’; গন শিল্ফী সত্যেন সেনের লেখা ‘মারো জোয়ান হেইয়ো মারো কষে টান/ তালে তালে ঠেলো বৈঠা নদীতে উজান’। নতুন দিনের বার্তাবহ গান ‘জ্বরা মরা শোক দূরে ঠেলে/ সাহসে বাঁধুক প্রাণ/ বোমা বারুদে যুদ্ধ রুখে নতুন সূর্য আনো।’ আরো কয়েকটি গান ‘আমি তো জীবনের জয়গান গাই’; 

 ‘বুক বেঁধে লড়তে হবে/ ভাঙতে হবে দুখ শিকল’; ‘রক্তে ধোয়া মে তোমায় সালাম’; ‘আওয়াজ তুলেছে পহেলা মে’; ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি’; ‘বেলা শুরুর গান’; ‘মাঠে মাঠে সোনালি ধান’; ‘এ লড়াই বাঁচার লড়াই’ ইত্যাদি। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা বিদ্রোহের গানও এ দিবসে বহুল পঠিত হয়।

 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রমজীবী মানুষের কথা স্মরণ করে লিখেছেন ‘সবচেয়ে কম খেয়ে, কম পরে, কম শিখে বাকি সকলের পরিচর্যা করে। সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি-ঝাঁটা খেয়ে মরে। তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।’ অন্যদিকে, গণসঙ্গীত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান গনমানুষের জন্য হলেও অধিকাংশই আফ্রিকার লোক গীতি। কিন্তু শ্রম মেহততের কাছে সব একাকার হয়ে যায়। যাতে মে কালের সীমানা থাকে না। 

 

মে দিবস নিয়ে তিনি লিখেছেন ও গেয়েছেন ‘বলো সাথী সবদিনই আমাদের পয়লা মে দুনিয়ার মজদুর এক হও এই ডাক শুনি যেদিন, সেদিনই মে দিন সাথী সেদিনই মে দিন।’ এ ছাড়া ‘ডিঙা ভাসাও সাগরে’ এবং ‘আলু বেচো ছোলা বেচো, বেচো বাখর খানি’ উল্লেখযোগ্য।
পরিশেষে স্মরণ করছি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুলি-মজুর’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি:

‘হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!’

‘তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান, তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!’ অসামান্য এই লাইন দুটো জানান দেয় শ্রমিকের সম্মান এবং প্রকৃত মর্যাদা।

নান দেয় শ্রমিকের সম্মান এবং প্রকৃত মর্যাদা।