• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ৭, ২০১৯, ০৫:৫৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৭, ২০১৯, ০৫:৫৪ পিএম

রবীন্দ্রনাথ : শ্রেনী দৃষ্টিকোন থেকে

অন্য দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ

অন্য দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ

বিপ্লব পূর্ব রাশিয়ায় (তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন) তলস্তয় চর্চার যে সংকট লেনিন চিহ্নিত করেছিলেন, তা ছিলো, সোভিয়েত ইউনিয়নেতিন ধরনের তলস্তয় চর্চা দেখা যায়, এক হচ্ছে সরকারি ফরমায়েশ অনুযায়ি, দুই এক ধরনের প্রশস্তি গাওয়া ও তিন দায় সারা গোছের। তিনিএই সমালোচনার সমালোচনা করেছিলেন এবং বলা যায়, তলস্তয়কে সঠিক মূল্যায়নের উপর দাঁড় করিয়ে ছিলেন। তলস্তায়ের নানান সীমাবদ্ধদিক চিহ্নিত করেও তাঁকে বলে ছিলেন ‘বিপ্লবের দর্পন’।

কথাটা উল্লেখ করলাম এই জন্য যে, আমাদের দেশেও রবীন্দ্র চর্চায় তেমনই কিছু সংকট পরিলক্ষিত হয়। যদিও রবীন্দ্রনাথকে বহু জন বহুভাবে অনেক দেশে অনেক ভাষায় বিশ্লেষণ করেছেন। সেগুলোতে অনেকেই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথকে অপসারণ, সংকীর্ণদৃষ্টিকোণ থেকে বিরোধীতা, দায় সারা গোছের বর্ণনা কিংবা এক ধরনের প্রশস্তি গেয়েছেন। এতে গজদন্ত মিনার বাসী ও কুপমন্ডুকতায়খন্ডিত হয়ে পরেছে রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ নিজেও যা সমর্থন করেননি। আবার একদল মার্গীয় সমালোচক আছেন যারা রবীন্দ্রনাথকে গুটিকয়েকের সম্পদ হিসেবে কুক্ষিগত করে রাখতে চান। তাও রবীন্দ্র চিন্তা বিরোধী।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে গণমানুষের অবস্থান তথা শ্রেণী দৃষ্টিকোণথেকে মার্কসবাদী বিশ্লেষণে পূর্ণঙ্গ বই এর আগে কখনো আমাদের হাতে আসেনি। হায়দার আকবর খান রনো’র ‘রবীন্দ্রনাথ শ্রেণী দৃষ্টিকোণথেকে’ সে অভাব পূরণ করলো। হায়দার আকবর খান রনো’র লেখা-চিন্তা বা ব্যক্তি সাথে পূর্বে পরিচিত না হওয়ার কারণ নেই। তিনি এমনএকজন প্রাজ্ঞ মার্কসবাদী রাজনীতিক যিনি অবলীলায় বিচরণ করেন চিত্র কলার নন্দন তত্ত¡ থেকে সাহিত্যের নন্দন তত্ত¡। রাজনীতি,অর্থনীতি, দর্শন, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের উপর অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। লিখছেন পত্রিকায় নিয়মিত কলাম। অনুবাদ করেছেন অর্থনীতির উপরধ্রুপদী গ্রন্থ। আর সম্পাদনা করছেন মার্কসবাদী তত্ত্বীয় ত্রৈমাসিক ‘কমরেড’। তিনি একই সাথে মার্কসবাদী জননেতা ও তাত্ত্বিক। দীর্ঘ সংগ্রামীজীবনে তিনি বাংলাদেশের অনেক গণসংগ্রামেরই রূপকার, নেতৃত্ব দিয়েছেন একেবারে সামনে থেকে। তাই তাঁর কাছ থেকেই এ বিষয়েপূর্ণাঙ্গ বই আশা করা যায়।

এ বইতে তিনি রবীন্দ্রনাথকে উপস্থিত করেছেন, ‘পাকিস্তানি মানসিকতায় রবীন্দ্রনাথ’, ‘অতি-বাম সংকীর্ণ জায়গা থেকে রবীন্দ্র বিরোধীতা’,‘শিল্প সাহিত্য প্রসঙ্গে মার্কসবাদ’, ‘উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণ’, ‘ রবীন্দ্রকাব্যে ভাববাদ ও বাস্তবমুখিতা’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও রাজনীতি’,‘ধর্ম, জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্র সাহিত্যে নারী’, ‘ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি উপন্যাস’,‘রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি নাটক’, ‘রবীন্দ্র অর্থনৈতিক চিন্তা’, ‘রাশিয়ার চিঠি,তীর্থ দর্শনের অভিজ্ঞতা’ এবং ‘সভ্যতার সংকট’। সমগ্র সাহিত্যকেবিষয় বৈচিত্র্যে অখন্ড দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন তিনি। বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়, লেখকেরই ভাষায়,‘রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলোতে আছে সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবনের চিত্র। কয়েকটি গল্প তো অসাধারণ, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গল্পের অন্যতম। রবীন্দ্রকাব্যেরওকায়েকটি পর্ব দেখা যায়। মানসী থেকে ক্ষণিকা পর্যন্ত রবীন্দ্র রোমান্টিক কবি। এর সঙ্গে মিস্টিসিজম যুক্ত হয়ে এক অনন্য সাধারণ শিল্প সৃষ্টিহয়েছে, যার তুলনা শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, বিশ্বসাহিত্যেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লিরিক কবি। খেয়াথেকে আরম্ভ করে গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, গীতালি হয়ে বলাকা পর্যন্ত কবি আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করেছেন।.....বলাকার পরে পলাতকায়দেখছি কবি ধুলামটির পৃথিবীতে ফিরে আসছেন, এই বাস্তব জগতের মানুষকে দেখছেন গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ মানবচরিত্রও সমাজ বিশ্লেষণ করেছেন। রক্তকরবীর মতো নাটকে সাংকেতিক ফর্মে হলেও তিনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধনলিপ্সা ও মানুষকে যন্ত্র বানানোরব্যবস্থাকে কষাঘাত করেছেন (যদিও পুঁজিবাদ কথাটি উচ্চারিত হয়নি)। অচলায়তন, মুক্তধারা প্রভৃতি নাটকে নিছক সৌন্দর্যই নাই, আরোআছে সামাজিক উদ্দেশ্য। রবীন্দ্রনাথকে তাই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন অল্প কয়েকজন বিদগ্ধ লোকের সম্পদ মনে করা ভুল হবে।’[পৃষ্ঠা ১১]

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য যেমন বঙ্গভঙ্গ করেছিল, কিন্তু পেরে উঠেনি।ঠিক একই সময়ে এখানে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনাও উষ্কানি দিয়ে আসছিল। যার অনিবার্য ফল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। তা যেমন ব্রিটিশ আমলে,তেমনি পাকিস্তান আমলেও। যার রেশ এখনো কোথাও কোথাও দেখা যায়। এই সাম্প্রদায়িকরার অপতৎপরতা চলেছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকেন্দ্র করেও।

রবীন্দ্র নজরুল সম্পর্ককে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি থেকে দেখা হলেও হায়দার আকবর খান রনো’র তার লেখায় বিষয়টিকেখোলসা করেছেন এমন ভাবে যাতে শ্রেণীর উর্ধ্বে সমতার দৃষ্টিতে মানুষ দেখবে বাঙালির বিরলপ্রজ দুই মহান প্রতিভাকে। তিনি লেখেন-‘রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে কী চমৎকার সম্পর্ক ছিল তা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তির স্মৃতিকথায় সেসববিধৃত আছে।....কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে কী বলেছেন, তা দেখা যাক।বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা নয়, পূজা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্ট দেবতাকে পূজা করে। ছেলে বেলা থেকেতার ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধূপ-ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা বন্দনা করে। এ নিয়ে কত লোক কত ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছেন।’[প্রবন্ধ ‘বড় পিরীতি বালির বাধ’, আত্মশক্তি প্রত্রিকা,১৯২৭]


অন্যদিকে কবি নজরুলকে উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু
আয় চলে আয় রে ধূমকেতু,
আধারে বাধ্ অগ্নিসেতু,
দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন!
ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য নজরুল ইসলাম যখন আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সদ্য রচিত‘বসন্ত’ নাটকটি কবি নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন।’[পৃষ্ঠা ৫] পরবর্তীতে নজরুল ইসলামও এ প্রসঙ্গে লিখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।চল্লিশের দশকে এদেশের মার্কসবাদী শিবিরেও যান্ত্রিক অনুকরণে বরীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি, জমিদার ইত্যাদি বলে বর্জন বা বিরোধিতাহাজির করা হয়েছিল। বোঝাই যায় এটা সংকীর্ণ দৃষ্টি ভঙ্গি, মার্কসবাদ সম্মত নয়। এ বইয়ের লেখক সে ভুল ধরিয়ে দেন। এবং অতি-বামসংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রবীন্দ্র বিরোধীদের বিপরীতে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতেও ভুলে যান না যে, এক ধরনের উচ্চশিক্ষিত অতিভক্তওআছে যারা রবীন্দ্রনাথকে সংকীর্ণ পরিসরে আটকে রাখতে আগ্রহী। যাদের চিন্তাও রবীন্দ্র চিন্তা বিরোধী। দৃপ্ততার সাথে উচ্চারণ করেন‘চূড়ান্ত বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ সমগ্র জনগণের কবি, বিশ্ব জনগণের কবি। তিনি নিজেও শেষ জীবনের ইচ্ছা এই ভাবে ব্যক্ত করেছেন-
‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক
 আমি তোমাদেরই লোক।
আর কিছু নয়-
এই হোক শেষ পরিচয়।
[‘পরিচয়’, ‘সেঁজুতি’ কাব্যগ্রন্থ]
 আবার তিনি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তিনি আরো বলছেন-
আমার কবিতা, জানি আমি
গেলেও  বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।
কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।’
[‘জন্মদিনে’, ১০ সংখ্যক, রবীন্দ্র রচনাবলী, খন্ড ২৫, পৃ. ৭৮] [পৃষ্ঠা ১১]

এ পর্যায় লেখক গুরুতর ভাবেই রবীন্দ্রনাথকে আরো সম্যক ভাবে বোঝার জন্য ‘শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে মার্কসবাদ’ প্রসঙ্গের অবতরণ করেন।তবে তা শুধু তত্ত¡ নয়, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বিচারের জন্যই মার্কসবাদের বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন। উপস্থিত করেনমার্কস-এঙ্গেলস-লেলিন-মাও সহ মার্কসবাদী সাহিত্যকদের। যারা এই সাথে যোদ্ধা ও বোদ্ধা। ফলে ক্লান্তি ও ভ্রান্তি ঘটে না। ইতিহাস ওসমাজের ভেতরের ক্রিয়া কি করে তার যুগের শ্রেণী চিন্তা ও সাহিত্যে নির্ধারণী ভূমিকা পালন করে তাও পরিষ্কার হয়ে যায়। আবার তিনি
মার্কসবাদের এও উল্লেখ করেন, বিরুদ্ধ সময়েও শিল্প সাহিত্য এক ধরনের আপেক্ষিক স্বাধীনতাও ভোগ করে। এবং সাহিত্যকে ‘শ্লোগান’আর ‘পোস্টারের’ স্তরে নামিয়ে আনলে চলবে না।

তাই তাঁর লেখা কোনো ভাবেই মার্কসবাদের খন্ডিত বা সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ হয় না। এখানেতিনি সাহিত্যের ভূমিকাও পরিষ্কার করেছেন নানান ভাবে। তিনি মার্কসের একটি উদ্বৃতি দিয়ে বলেন,‘আমরা কি একই ভাবে বলতে পারি নাযে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের পরাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সত্য ফুটে ওঠেছিল রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, মানিক,বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর প্রমুখ উপন্যাস ও গল্প লেখকদের লেখা থেকে?’[পৃষ্ঠা ২১]তিনি লেখেন, ‘গোর্কি আরো বলেছেন-ব্যক্তিগত সৃজনশীলতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে আমরা যদি পেয়ে থাকি অপূর্বভাবে খোদিত ও মসৃণ নতœরাজি, তা হলে সমষ্টিতে জনগণেরমধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল অমসৃণ হীরক।
মহৎ শিল্পীর ব্যক্তিপ্রতিভা ও জনগণের সম্পদ এই দুইয়ের মধ্যকার যে সম্পর্কের কথা গোর্কি তুলে ধরেছেন, তা তো রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গেওখাটে। শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকেও যদি আমরা বিচার করি, তা হলেও দেখব রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের জনগণের মহান সাংস্কৃতিক সম্পকে আহরণকরে তাকে আরো বিকশিত করে বিশ্বসভায় তুলে ধরতে পেরেছিলেন। সংকীর্ণ সৃষ্টিকোণ তেকে রবীন্দ্রনাথকে যারা বুর্জোয়া কবি ইত্যাদি বলেবর্জন করতে চায় তারা মার্কসবাদ সম্পর্কেও যেমন অজ্ঞ, তেমনি রবীন্দ্রপ্রতিভা বা রবীন্দ্রমানসের প্রগতিশীল উপাদান সম্পর্কে কিছুই জানে না
বা বোঝে না।’ [পৃষ্ঠা ২৫]

হায়দার আকবর খান রনো শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথকে বিশ্লেষণে আবশ্যিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথের সময়, তার ইতিহাস, অর্থাৎ‘উনবিংশ শতাব্দীর  বাংলার নবজাগরণ’ প্রসঙ্গটি বিশদ ভাবেই সামনে এনেছেন। অবশ্যই ঐতিহাসিক-দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বিচারে, মার্কসীয়দর্শন যার উপর প্রতিষ্ঠত। রবীন্দ্রসাহিত্য বিচারে অনেক বিশ্লেষকই যা ভুলে যান, ইতিহাসে ধারা যেমন সাহিত্যের ভাষা-নন্দন নির্ধারণ করেতেমনি প্রগতিশীল সাহিত্য ইতিহাসের চরিত্র নির্ধারণেও ভূমিকা রাখে। লেখকের এই প্রকাশ ক্রিয়ায় পাঠক ইতিহাসের সাহিত্য দ্যোতনাও
পাবেন। তাঁর ভাষায়-
‘রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হলে আমাদের অবশ্যই যেতে হবে, বিশেষ করে বুঝতে হবে উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার সমাজ ও ইতিহাসকে। উপরন্তুরবীন্দ্রনাথ শুধু যে কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন তাই-ই নয়, তিনি আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও চিন্তার জগৎকেও (এবং অংশত রাজনীতিকেও)দারুণ ভাবে প্রাভাতি করেছিলেন। যে যুগ ও যে সামাজিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বেড়ে উঠেছিলেন, তার ছাপ পাওয়া যাবেরবীন্দ্রসাহিত্যে। এর সঙ্গে অবশ্যই শ্রেণী কথাটাও যুক্ত করা দরকার। অর্থাৎ যে শ্রেণীর ধ্যান-ধারণা তার মধ্যে কাজ করত সেটাকেও বাদদেয়া যায় না।’[পৃষ্ঠা ২৭]

রবীন্দ্রসাহিত্য মানস যে ক্রমেই বদলেছে তা তিনি অনেকভাবেই দেখিয়েছেন। অনেকই রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য পাঠে শুধু মাত্র রোমান্টিকতাই খুঁজেপান বা এই রোমিন্টিকতার জন্যই তাঁর সাহিত্যকে সামান্যিকরণ করতে চান। হায়দার আকবর খান রনো একে ভিন্ন চরিত্রের ও বিশ্ব সাহিত্যেজুরি মেলা ভার উল্লেখ করে বলেন,‘সর্ব শ্রেষ্ঠ প্রলেতারীয় লেখক গোর্কির মতে,খুব সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন যে, বালজাক, তুর্গেনিভ, গোগল, লেসকভ অথবা চেখভের মতো ধ্রæপদী সাহিত্য রোমান্টিক না বাস্তববাদী ছিল।
কারণ সব মহা শিল্পকর্মে রোমান্টিকতা ও বাস্তবতার মিশ্রণ থাকে।’  [পৃষ্ঠা ৫৪]


তিনি আরো উল্লেখ করে বলেন,‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের কিছু ছোঁয়া কোনো কোনো কবিতা বা গদ্য রচনায় দেখা যায়, তবে সেটা কখনো প্রধানবিষয় হয়ে আসেনি। এবং এ কথাও সত্য যে, শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ যে আধ্যাত্ম দ্রষ্টা ঋষিতে পরিণত হয়েছিলেন। তবে জীবন সম্পর্কে স্থুলধর্মীয় চেতনা তাঁকে কখনই আচ্ছন্ন করতে পারেনি। গীতাঞ্জলি পর্বের কিছু ভক্তিরসভিত্তিক কবিতা বাদ দিলে কাব্যে প্রতিফলিত জীবনদর্শন কখনই স্থুল আধ্যাত্মবাদে পরিণত হয়নি।[পৃষ্ঠা ৮০]‘রবীন্দ্রকাব্যে ভাববাদ ও বাস্তবমুখিতা’-এই দীর্ঘ পরিচ্ছেদে তিনি শেষতক রবীন্দ্রনাথের ‘জন্মদিনে’ কাবিতার পূর্বোক্ত চরণ উল্লেখ করে বলেন-এই রবীন্দ্রনাথ ভাবলোকের কবি নন, তিনি আছেন মাটির কাছাকাছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, ভবিষ্যতের সেই প্রলেতারীয় করির জন্যও তিনি রেখে গেছেন এক সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার।’[পৃষ্ঠা ৮১]

সমাজে বাস করে কেউ-ই রাজনীতির উর্ধে নয়। তাই রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাও খতিয়ে দেখা আবশ্যক। তা হবে সাহিত্যের আরেকপাঠ। তবে অনেকে আবার জন বিচ্ছিন্ন মনোভাবে রবীন্দ্রনাথকে নিপাট ভাবালুক হিসেবে গ্রহণ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় একেবারেইআনতে চান না। হায়দার আকরব খান রনো গভীর মমনে তাঁর ষষ্ঠ পরিচ্ছদটাই নির্ধারণ করেছেন ‘রবীন্দ্রনাথ ও রাজনীতি’ শীর্ষকশিরোনামে।

ইতিহাসের অনেক ঘটনা উল্লেখের পাশাপাশি তিনি লেখেন-
‘রবীন্দ্রনাথ গান্ধীকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন, তবে গান্ধীর সকল নীতিকে সমর্থন দিতে পারেন নি।বিশ ও তিরিশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যুদয় এবং মেহনতি শ্রেণীর সংগ্রাম রাজনৈতিক ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বিভিন্ন সূত্র থেকেজানা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ এই ব্যাপারে কৌতুহলী ছিলেন এবং কিছুটা সমর্থনও করতেন। বিশেষ করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথেরভূমিকা ছিল খুব দৃঢ়।....জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রচিত ‘সভ্যতার সংকট’ রবীন্দ্রনাতের রাজনৈতিক দলিলও বটে।’[পৃষ্ঠা ৮৫]তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতা উল্লেখ করে বলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদের দস্যুবৃত্তির বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী কবিতা হচ্ছে ‘আফ্রিকা’কবিতাটি। আশ্চর্য বলিষ্ঠ ভাষায় কবি আফ্রিকা মহাদেধে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ও লুন্ঠনের বর্ণনা দিয়েছেন,....কবি রবীন্দ্রনাথপাশ্চাত্যের কবিতাকে সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আহ্বান জানাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, আফ্রিকার জনগণের কাছে ক্ষমা ভিক্ষাওচাইতে বলছেন।’[পৃষ্ঠা ৯১]


রবীন্দ্রনাথের শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা স্মরণ রেখেই তিনি বলেন,‘রবীন্দ্রনাথ আসলে বুর্জোয়া শান্তিবাদী ও বুর্জোয়া মানবতাবাদী। এ ব্যাপারেকোনো সন্দেহ নাই। তবু তিনি যে মানবতাবাদের ডাক দিয়েছেন তার মূল্য অপরিসীম। সেইজন্য কমিউনিস্টদের চোখেও তিনি মহৎ।’[পৃষ্ঠা১০৫] তৎকালিন সমাজ ব্যবস্থায় রবীন্দ্রনাথ উচ্চ কোটির মানুষ ছিলেন তা সত্য, তবে তিনি তা ভাঙার ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন এও সত্য।লেখক তাই রবীন্দ্রনাথকে শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে গিয়ে এই দুই সত্যেরই কোনোটারই অপালাপ হতে দেননি। নিপুন বর্ণনা ওসলিল উদাহরণের তিনি প্রতিভাত করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’ কবিতার দুই লাইন-‘এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার।এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমান ভার।’[পৃষ্ঠা ১১০]কিংবা উল্লেখ করেন, “চতুরঙ্গ উপন্যাসে নাস্তিক জগমোহনের মুখ দিয়ে লেখক রবীন্দ্রনাথ বলছেন,‘আর্ত মানুষ মাত্রেই দেবতা, এমনকি হ্যাঁ,আমার এই চামার মুসলমান দেবতা।’ এমন কথা যিনি বলতে পারেন, তিনি সকল ধর্মীয় গন্ডির ঊর্ধ্বে মানবতার উচ্চাসনে অবস্থান
করেন।”[পৃষ্ঠা ১২০]

সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ নারীর যে উচ্চাসন দিয়েছেন তার মধ্যদিয়ে তাঁর ইতিহাস সচেতনতা, উঁচু ব্যক্তিত্ব ভা¯^র হয়। মার্কসবাদীদের নিকটনারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আরো গুরুত্বপূর্ণ। তাই এক্ষেত্রে মার্কসবাদী রাজনীতিক-তাত্তি¡ক হায়দার আকবর খান রনো বিশ্লেষণে ‘রবীন্দ্রসাহিত্যেনারী’ বিষয়টি হয়ে উঠেছে গভীর,তীক্ষè, আরো বেশি হৃদয়গ্রাহী। গদ্য-পদ্য উদাহরণে পূর্ণঙ্গ। তিনি উদৃত করেন, রবীন্দ্রনাথের নারী প্রবন্ধের(কালান্তার গ্রন্থের ) অংশ বিশেষ।‘নবযুগের এই আহ্বান আমাদের মেয়েদের মনে যদি পৌঁছে থাকে তাবে তাদেরর রক্ষণশীল মন যেন বহু যুগের অস্বাস্থ্যকর আবর্জনাকে একান্তআসক্তির সঙ্গে বুকে চেপে না ধরে। তারা যেন মুক্ত করেন হৃদয়কে, উজ্জ্বল করেন বুদ্ধিকে, নিষ্ঠা প্রয়োগ করেন জ্ঞানের তপস্যায়। মনেরাখেন, নির্বিচার অন্ধরক্ষণশীলতা সৃষ্টিশীলতার বিরোধী। সামনে আসছে নতুন সৃষ্টির যুগ।’[পৃষ্ঠা ১৩৯]এবং ‘এইভাবে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নারী মুক্তির যে সংগ্রামের উদ্বোধন করেছিলেন তা পরবর্তীতে আরো তীব্র ও বলিষ্ঠ হয়েছে। তবু এখনোআমাদের সমাজে নারী মুক্তি আসেনি। এজন্য এখনো আমাদের বারবার রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে হবে। রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের যেঋণ, তা অপরিশোধযোগ্য।’[পৃষ্ঠা ১৪১]

মূলত কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের অধিক বিশ্লেষণ হলেও তিনি ছোটগল্পেরও এক সমৃদ্ধ ভান্ডার রেখেগেছেন। শ্রæতি আছে, রবীন্দ্রনাথ কবিতাপাশাপাশি সাহিত্যে ছোটগল্পের জন্যও নোবেল পুরষ্কার পেতে পারতেন। তাই এই বইয়ে ‘ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক শিরোনামেপরিচ্ছেদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যা পাঠকে সমাজ বাস্তবতার নিরিখে রবীন্দ্রনাথকে দেখা ও হৃদঙ্গম করতে সহজ হবে। এবং গুরুত্বপূর্ণও বটে।রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের এই জীবন ঘনিষ্ট নিবিড় পাঠ আর কোথাও পাই না। রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব মূল্যায়নও তাই। এ প্রেক্ষিতে লেখকের মন্তব্য-


‘তাই সাংস্কৃতি জগতের তথাকথিত অভিজাত যে ভদ্রলোকরা রবীন্দ্রনাথকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে গুটিকতকের নিজ¯^ সম্পদ বলে যে দাবিকরে তাদের সেই দাবি সঠিক নয়।’[পৃষ্ঠা ১৪৫]লেখক যুতসইভাবেই বুদ্ধদেব বসুর সাথে রবীন্দ্রনাথের আলাপ চারিতার একটি অংশ তুলে দেন।‘ভেবে দেখলে বুঝতে পারবে আমি যে ছোট ছোট গল্পগুলো লিখেছি, বাঙালি সমাজের বাস্তব জীবনের ছবি তাতেই প্রথম ধরা পড়ে।’[পৃষ্ঠা১৪৫]এবং পরিচ্ছেদ শেষে মন্তব্য করেন যা রবীন্দ্রসাহিত্যের নান্দিপাঠের বহিঃপ্রকাশ-
‘আজ থেকে সত্তর বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রক্ষণশীল সমাজের যে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন তা আজকের সমাজেও আধুনিকও প্রগতিশীল বলে গণ্য হবে।’[পৃষ্ঠা ১৬২]

রবীন্দ্রসাহিত্য আলোচনায় তাঁর উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে বেশ আলোচনা হলেও তাঁর উপন্যাসে সামগ্রিক-সামাজিক-মানবিক-রাজনৈতিকবিচার-বিশ্লেষণ দুঃপ্রাপ্য। উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ সে সমাজ বাস্তবতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট চিত্রায়ন করেছেন তা তাঁর অন্যান্য সাহিত্যের এরকম ভাবে পাওয়া যায় না। হায়দার আকবর খান রনো রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের যে সারোৎসার উন্মোচন ও বিশ্লেষণ, তা সাহিত্যআলোচনায় বিরল। রবীন্দ্রনাথ যে বিপ্লবী রাজনীতিকে তাঁর শ্রেণী দৃষ্টির বাইরে দেখতে পারেন নি, তার জন্য সমালোচনা করেও রবীন্দ্রউপন্যাসের বিলোল বিন্যাস ‘রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি উপন্যাস’ এই পরিচ্ছেদে পাওয়া যায়। রবীন্দ্র উপন্যাস সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য এখানে প্রণিধান
যোগ্য।‘রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক এবং তিনি মানুষের ধর্মে বিশ্বাস করতেন। তিনি রাজনীতি অপেক্ষা জনগণের নিজস্ব চেষ্টায়মঙ্গলময় সমাজ গড়ার ব্যাপারে অধিক আগ্রহী ছিলেন। তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধী ছিলেন। তিনি বিশ্ব মানবতাবাদের প্রবক্তা। তিনিসর্বপ্রকার ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার অকমানবিক ধর্মীয় সামাজিক প্রথার বিরোধী ছিলেন। রামমোহন-বিদ্যাসাগর আধুনিকতার এবংনারীমুক্তির সপক্ষে যে প্রগতিশীল ভাবধারার সুত্রপাত করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সেই ঐতিহ্যকে বহুদূর অগ্রসর করে নিয়ে যেতে সক্ষমহয়েছিলেন। উপন্যাসেও তার প্রতিফলন পাওয়া যায়।’[পৃষ্ঠা ১৬৮]

নাটকের ক্ষেত্রের রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি যে কতটা বলিষ্ঠ ও তীক্ষè তা হায়দার আকবর খান রনোর ‘রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি নাটক’ শীর্ষকপরিচ্ছেদ পাঠ করলে অনুভাবন করা যায়। নাটকে রবীন্দ্রনাথের অনেক আর্টেস্টিক ও সাংকেতিক দিকও তাঁর বর্ণনায় বাঙ্গম হয়ে ওঠেছে।নাটক বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথের আপত্তি থাকলেও তাঁর তীক্ষè ও মনোজ্ঞ বিন্যাসে তা আর থাকে না। বরং হয়ে ওঠে সাহিত্যেরই আবশ্যিকপাঠ।মুক্তধারা নাটক প্রসঙ্গ করে তাঁর যুক্তি উপস্থাপন করেন ‘নাট্যকার যাই বলুন না কেন, নাটকটি পাঠ করলে যে চিত্রকল্পটি ভেসে আসবে এবংযে চেতনার সৃষ্টি হবে, তা মোটেই অরাজনৈতিক বলে বিবেচিত হতে পারে না।’[পৃষ্ঠা ২০৫]


রক্তকরবী নাটক সম্বন্ধে তিনি খুবই প্রাসঙ্গিক মন্তব্য করেন, যা রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য নাটকেও প্রযোজ্য-‘এখানে একট কথা পুনর্বার উল্লেক করা দরকার যে, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু কোনো তত্ত¡ বিশ্লেষণ করেননি। পুঁজিবাদ শব্দটিও কোথাও নেই, না মূলরচনায়, না এই নাটক সম্পর্কিত নিজস্ব কোনো মন্তব্যে। তার মতো অত বড় মাপের মহান শিল্পীরা শিল্পসৃষ্টির মধ্য দিয়েই বক্তব্য তুলে ধরেনঅনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও প্রাণস্পর্শী করে।’[পৃষ্ঠা ২২৩]রবীন্দ্রবিতর্ক বা রবীন্দ্রনাথকে কুক্ষিগত করে রাখার যে চেষ্টা হয়েছে তা বোধ হয় ‘রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তা’ ঘিরে। অর্থনীতি, বিশেষতরাজনৈতিক অর্থনীতিতে প্রাজ্ঞ হায়দার আকবর খান রনো হাতেই যে এই বিষয়ের সুষ্ঠ সমাধান হবে তা কাক্সিক্ষত। তিনি একে শুধু নিছক
অর্থনীতির কড়চা না রেখে, একে রাজনৈতি অর্থনীতি, ইতিহাসের আলোকে উপস্থাপন, সামগ্রিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন। সেই সাথেঅর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মত উপস্থাপন ও বিভ্রান্তি চিহ্নিত করে সমাধান নির্দেশ করেছেন। ফলে এ নিয়ে আর বোলচালের সুযোগ থাকে না।
তিনি বলেন-


‘অতএব, যারা রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তাকে মার্কসবাদী চিন্তা বা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক চিন্তার উপরে স্থান দিতে চান, তারা বড় ভুলকরছেন। নানা ধরণের শ্রেণী সীমাবন্ধতা সত্তে¡ও রবীন্দ্রনাথ যে মহৎ, একথা আমরা একবারও অস্বীকার করছি না। কিন্তু তাই বলে তারইউটোপিয়ান ও ভ্রান্ত অর্থনৈতিক সামাজি চিন্তাকে অযথা গৌরবান্বিত করবো না। যেটা ভুল, তাকে ভুলই বলতে হবে।রবীন্দ্রনাথের সমবায়ের চিন্তাও অভিনব কিছু নয়। মার্কসের সময়ও সুইস অর্থনীতিবিদ সিসমন্ডি, ফরাসি তাত্ত্বিক প্রুধো ও লুই ব্ল্যা প্রমুখ
পেটিবুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুঁজিবাদবিরোধী ছিলেন। তারা ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান চাননি। পুঁজিবাদের আক্রমণ থেকে পেটিবুর্জোয়ারক্ষুদে সম্পত্তি রক্ষার জন্য তারা সমবায়ের ওপর জোর দিয়েছিলেনে। তাদেরকে মার্কস বলেছিলেন, পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী। রবীন্দ্রনাথেরসঙ্গে কিছুটা মিল পাওয়া যায়, যদিও রবীন্দ্রনাথ সমাজতন্ত্রের ধারণা পর্যন্ত গ্রহণ করেননি।’[পৃষ্ঠা ২৪৪]তাঁর এই নিবিড় ও তাৎর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা সাহিত্যে ব্যবহার আগে দেখা যায় না। এতে কোথাও জাড্য-জড়াও নেই।

রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি বোধহয় বাম পন্থিদের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত বই। কিন্তু এরও এক খন্ডিত - অর্ধমনোষ্ক পাঠ পরিলক্ষিত হয়।রবীন্দ্রনাথের শ্রেণীগত অবস্থান, বোঝাপড়া, দ্ব›দ্ব, বিদ্রোহ ও বিকল্প ভাবনা পরিস্কার করার পরই বোধকরি এর পূর্ণাঙ্গ পাঠ সম্ভব। হায়দারআকবর খান রনো ‘রাশিয়ার চিঠি :তীর্থ দর্শনের অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক রিচ্ছেদটি সেই আলোচনায় পূর্ণাঙ্গ একটি পরিচ্ছেদও বলা যাবে।আবশ্যিক পাঠও বলা যাবে। লেখন দেখিয়েছেন এটি যেমন রবীন্দ্রনাথের পূর্ণবোধের একটি লেখা তেমনি শ্রেণীগত লেখা। রবীন্দ্রনাথ এরপূর্বে এমনটি লিখেননি, তার শ্রেণীর মানুষও চায়নি তিনি সমাজতন্ত্রী দেশে যান। রবীন্দ্রনাথ নিজেও যা স্বীকার করেছেন, আশ্চর্য হয়েছেন।শেষতক বলেছেন ‘তীর্থ দর্শন’। সম্পত্তি বিষেয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য উল্লেখ করে লেখক তার শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ করেন এই ভাবে।“এক চিঠিতে (২৮ ডিসেম্বর, ১৮৪৮) মার্কস বলেছেন, ‘তাদের  (পেটিবুর্জোয়া তাত্তি¡কদের) এই ধরনের ভুলের কারণ এই যে, তাদের নিকটবুর্জোয়া মানুষ হচ্ছে প্রতিটি সমাজের একমাত্র সম্ভবপর ভিত্তি। তারা এমন সমাজের কল্পনাও করতে পারেন না, যেখানে মানুষ বুর্জোয়া
নয়।”[পৃষ্ঠা ২৫৯]


তিনি খুব কার্যকর ভাবে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা বিষয়ক অংশ উদ্ধৃত করেন।‘আমি নিজে চোখে না দেখনে কোনোমতে বিশ্বাস করতে পারতুম না যে, অশিক্ষা ও অবমাননার নিম্নতম তল থেকে আজ কেবলমাত্র দশবৎসরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এরা শুধু ক খ গ ঘ শেখায় নি, মনুষত্বে সম্মানিত করেছে। শুধু নিজের জাতকে নয়, অন্য জাতের জন্যও
এদের সমান চেষ্টা।’[পৃষ্ঠা ২৫৫]তিনি বইটি মূল্যায়ন প্রসঙ্গে যা বলেন, তা একই সাথে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে প্রযোজ্য।‘মনে রাখতে হবে যে, রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি, মানবতাবাদী। উদারনৈতিক বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে খুব বেশিদূর যেতে পারেননি। তিনিবিপ্লবী নন। তবু তিনি সোভিয়েত বিপ্লবকে যে স্বাগত জানিয়েছেন সেটা কি কম কথা? সোভিয়েত দেশকে তীর্থস্থান বলা যে সেই কালে কতবড় ঘটনা ছিল এবং সাম্যবাদী আন্দোলনকে কতটা সাহায্য করেছিল তা আজকের যুগে বসে ধারণা করা যাবে না। বাস্তবিকই অনেক
স্ববিরোধিতা ও দূর্বলতা সত্ত্বেও রাশিয়ার চিঠি ছিল প্রগতিশীল ও মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে এক শক্তিশালী হাতিয়ার। সেই জন্য ব্রিটিশসাম্রাজ্যবাদ এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ নিষিদ্ধ করেছিল।’[পৃষ্ঠা ২৬৫]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ অভিবাসন ‘সভ্যতার সংকট’ সত্যিই তার রাজনৈতিক চিন্তার ঠাস বুনন, অবিনশ্বর দলিল। তাই এই বিষয়ে একটি পূর্ণপরিচ্ছেদের বহু দিনের। লেখক একে শুধু বিশ্লেষণ করেননি, প্রাসঙ্গিক উদ্বৃতি দিয়ে পরিচ্ছন্ন ও পরিব্যাপ্ত করেছেন। এক্ষেত্রে মার্কসবাদীরাজনীতিক-তাত্ত্বিক হায়দার আকরব খান রনো মুন্সিয়ানা পুরো বই জুড়েই পাওয়া যাবে। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের নির্মম-নিষ্ঠুর কষাঘাতেজর্জরিত-পীড়িত রবীন্দ্রনাথ তাই মুক্তি দেখেন সোভিয়েতের পথেই। লেখক অত্যান্ত আবশ্যিকতার সাথেই উদ্বৃত করেন, অমিয় চক্রবর্তীতেলেখা (৭ মার্চ, ১৯৩৫) ব্যক্তিগত চিঠির বক্তব্যকে-‘সভ্যতার এই ভিত্তি বদলের প্রয়াস দেখেছিলুম রাশিয়ায় গিয়ে।....মানুষের ইতিহাসের আর কোথাও আনন্দ ও আশার স্থায়ী কারণ দেখিনি।

জানি প্রকান্ড একটি বিপ্লবের উপরে রাশিয়া এই নবযুগের প্রতিষ্ঠান করেছে। কিন্তু এই বিপ্লব মানুষের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও প্রধান রিপুর বিরুদ্ধেবিপ্লব...এ বিপ্লব অনেক দিনের পাপ প্রায়শ্চিত্তের বিধান....এ প্রার্থনা আপনি জাগে যে তাদের এই সাধনা সফল হোক।’[পৃষ্ঠা ২৭১]শেষতক লেখক রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ যে অবয়ব আঁকেন তা খুবই হৃদয়ঙ্গম হয়ে ওঠে যবনিকা পাতে বিশ্লেষণ আর উদ্বৃতি দিয়ে।‘অতীন্দ্রিয় কোনো সত্তা নয়, ধনী দেশ ও পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদের কাছে করুণা ভিক্ষা নয়, মহাকবি আস্থা ঘোষণা করেছেন মানুষের প্রতি।মানুষের মহাকবি মানুষকে শুনিয়েছেন আস্থার বাণী, বলেছেন,‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসেরএকটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।’[পৃষ্ঠা ২৭২]

সাহিত্যিকের সমালোচনা যে একাধারে সাহিত্য সমালোচনা হয়ে উঠতে পারে বা এটা বিপরীত ভাবেও যে সম্পাদন সম্ভব হয় তা হায়দারআকবর খান রনোর ‘রবীন্দ্রনাথ শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে’ তা বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথকে তিনি রবীন্দ্রনাথের অনিষ্ট-ইস্পিত যে জায়গা, গণমানুষ,সেখানেই প্রতিস্থাপন করলেন। একজন মহান সাহিত্যিককে নিয়ে এই ধরনের বই আমাদের কাছে আর দ্বিতীয়টি নেই। অখন্ড জীবন বোধ,ইতিহাস ও রাজনীতি সচেতনতা, সমাজ বাস্তবতা ও শ্রেণী সচেতনতার নিরিখে, একই সাথে আঙ্গিক নিয়ে সুনিবিড়, ঠাস বুননে বইসাহিত্য/সাহিত্যিক সমালোচনায় অভিনব সংযোজনই বলতে হবে। ভাষা গঠন ও শব্দ চয়েন দারুন সংযোমি লেখকের এই বই অবশ্যইসুপাঠ্য। কাব্যিক দ্যোতনায় সহজ সাবলিল বইটি একবার শুরু করলে শেষ না করে উঠা যায় না। আগ্রহী পাঠকমাত্রই এর আবশ্যিকতাওঅনুভব করবেন।

রবীন্দ্রনাথ শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে; হায়দার আকবর খান রনো; প্রচ্ছদ ও স্কেচ: কাজী সাইফুদ্দীন আব্বাস; গণ সংস্কৃতি কেন্দ্র,
২/৪, নবাব হাবীবুল্লাহ রোড, শাহবাগ, ঢাকা। প্রথম সংস্করণ, অক্টোবর, ২০১১; মূল্য-৩৫০টাকা মাত্র;