• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১৪, ২০১৯, ০৭:৪৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১৫, ২০১৯, ০৮:২২ পিএম

‍‍‍‍`পেয়ারার বাড়ি‍‍‍‍` আটঘর-কুড়িয়ানা

‍‍‍‍`পেয়ারার বাড়ি‍‍‍‍` আটঘর-কুড়িয়ানা

জনপদের নাম আটঘর-কুড়িয়ানা। পেয়ারার জন্য দেশব্যাপী এর খ্যাতি।  যে জন্য গ্রামের নাম ছাপিয়ে এর পরিচিতি পেয়ারার গ্রাম হিসাবে চালু হয়েছে মানুষের মুখে মুখে। পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠী থানা সদর থেকে ৮ কি.মি. পূর্ব দিকে এই গ্রামের অবস্থান। যেখানে মাইলের পর মাইল রয়েছে কেবল পেয়ারার বাগান। এখানের সিংহভাগ বাসিন্দার আয়ের একমাত্র উৎস এই পেয়ারা।দক্ষিণ জনপদের এই সরস পেয়ারা বাংলার আপেল বলে খ্যাত।

পেয়ারার মৌসুমে এই জনপদের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মত। দূর- দূরান্ত এলাকা থেকে পাইকার আসে এখানে।  বরিশাল ছাপিয়ে ফরিদপুর হয়ে রাজধানীসহ দেশের অনান্য অঞ্চলেও পৌঁছে যায় এখানের পেয়ারা। ফি বছরের ন্যায় এবারেও একই চিত্র বিরাজ করছে এই জনপদে। অ্যানথ্রোকনোজ (ছিটরোগ) নেই মোটেও, ফলন ভালো এবং দামও বেশ। পেয়ারা চাষীদের ঘরে আনন্দ। তবে রমজান চলে আসায় কিছুটা শঙ্কিত এখানের চাষিরা। বিশেষ করে যারা বাগান সৃজনকালে ঋণ নিয়েছিলেন মহাজনের কাছ থেকে। তারপরও সবকিছু ছাপিয়ে এবারে বরিশাল বিভাগের ৩ উপজেলার প্রায় দুই হাজারাধিক পেয়ারা চাষী অনেকটা নিরুদ্বেগ দিন কাটাচ্ছেন।

ছোট ছোট খাল। দু’পাশে সারি সারি পেয়ারাগাছ। কাঁচা-পাকা টসটসে পেয়ারা ঝুলে আছে। কোনোটা পাকা, কোনোটা কাঁচা। হলুদ আর সবুজের মনকাড়া সমারোহ। গাছের তলায়ও বেশ কিছু পেয়ারা। নৌকায় যেতে পেয়ারার মৃদু ছোঁয়া লাগবে। হাত বাড়িয়ে কিছু পেয়ারা তুলে নিলেও। কেউ কিছু বলবে না। তবে পেয়ারা ক’টাই বা খাওয়া যায়? এটা পেয়ারা চাষীরা বোঝেন,তাই আপ্যায়নে তাদের জুরি নেই। যেমন রস তেমন মিষ্টি। পাকা পেয়ারা তো মুখে দিলেই হলো। সরাসরি গলে পেটে চালান হয়ে যায়।
ইচ্ছে হচ্ছিল পুরো বাগানটাই তুলে নিই। পেয়ারা বাগানের মধ্যে সবজির আবাদ। বিভিন্ন রকম সবজি ঝুলে আছে। শসা, বেগুন, করলা আরো কত কী। কোথাও ছোট ছোট আখ চোখে পড়ল। আখগাছগুলো চিকন। কিন্তু ভয়াবহ রকম মিষ্টি। কয়েকটা খাবার পরে মুখ ফিরে এলো। 

বাগানের মধ্যে ছোট ছোট নালা। সেখানে মাছ ধরছে অনেকে। বড় বড় পুঁটি মাছ চোখে পড়ল। এ এক নৈসর্গিক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। না দেখলে বুঝানো মুশকিল। জায়গাটার নাম আটঘর কুড়িয়ানা। পেয়ারার স্বর্গরাজ্য। দেশী পেয়ারার বেশির ভাগ এখানে উৎপাদিত হয়। সুন্দরবনের মধ্যে যেমন ছোট ছোট খাল আছে। এখানের খালগুলো ও ঠিক সে রকম। 


পেয়ারা বাগান দেখার মুগ্ধতা কাটতে না কাটতেই চমকে যেতে হলো। পানির ওপর অসংখ্য ছোট ছোট নৌকা। নৌকাগুলো পেয়ারায় ভর্তি। এ যেন পানির মধ্যে সবুজ হলুদের হলিখেলা। কাঁচা পেয়ারার রঙ সবুজ। পাকাগুলো হলুদ। সব কেনাবেচাই নৌকার মধ্যে। স্থলের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। ফড়িয়ারা আসছেন পেয়ারা কিনে নৌকায় নিয়ে যাচ্ছেন। ভাসমান এত বড় হাট আর কোথাও বসে না।

কথা হলো পেয়ারাচাষি নরেশের সাথে। মুখজোড়া তার চওড়া হাসি। ব্যাপার কী? নরেশ বললেন, পেয়ারার বাম্পার ফলন হয়েছে। এবার পোকায়ও ধরেনি। তার খুশি উপচে পড়ছে। কিছু পেয়ারা বেছে হাতে তুলে দিলেন। না নিয়েও পারা গেল না। এমন   আন্তরিকতাকে উপভোগ করি কিভাবে? পেয়ারায় কামড় দিতেই রসে মুখ ভরে গেল। ভাবলাম, অনেকে এখানের পেয়ারাকে বাংলার আপেল বলে। নেহায়েতই কথাটা ভুল নয়।

উৎপত্তির কথা
 কবে এই জনপদে পেয়ারার চাষ শুরু হয়েছিল তানিয়ে দুটি মিথ প্রচলিত এখানে। শ্রুতি অনুযায়ী তা প্রায় দুই শতাধিক বছর আগের কথা। তীর্থ করতে এখানেরকোন একজন ভারতের  বিহার রাজ্যের গয়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে এই ফল দেখে চাষ সম্পর্কে অবগত হয়ে বীজ এনে বপন করেছিলেন আটঘর-কুড়িয়ানাতে। গয়া থেকে আনা বীজবপন করে গাছ এবং গাছ থেকে ফল পাবার পর, এর নাম রাখা হয়েছিল গয়া। সেখান থেকে অপভ্রশং হয়ে স্থানীয়রা এখন এই ফলকে গইয়া নামে ডাকেন। উৎপত্তির অপর কাহিনী সম্পর্কে আটঘর গ্রামের প্রবীণ পেয়ারা চাষী নিখিল মন্ডল জানালেন, আন্দাকুল গ্রামের পূর্ণচন্দ্র মন্ডল কাশীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে সর্বপ্রথম তিনিই পেয়ারার বীজ নিয়ে আসেন এই এলাকায়। সেই বীজ থেকে যেসব গাছউৎপন্ন হয়েছে এবং ঐ গাছে উৎপাদিত পেয়ারা এখনো পূণ্যমন্ডলী পেয়ারা নামে পরিচিতি। এইপেয়ারাটির গায়ে কমলালেবুর মত শির আঁকা আছে। খেতে বেশ সুস্বাদু, ভেতরে লালচে ধরণের এবং সুগন্ধযুক্ত। এই হিসেব অনুযায়ী প্রায় পৌঁনে দুইশ বছরের কাছাকাছি হতে পারে এখানের পেয়ারা চাষের বয়স। পূণ্যচন্দ্র মন্ডলের নাতি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নির্মল চন্দ্র মন্ডল(৮০) জানালেন, তার পিতার লাগানো শতাধিক বছরের পুরানো বাগান এখনো বিদ্যমান।

যেভাবে হয় পেয়ারার চাষ
 সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় পেয়ারা চাষ হয়ে থাকে। বীজ থেকে চারা উৎপন্ন করে কান্দি কেটে আট হাত দূরত্বে, একত্রে দুটো করে চারা লাগানোহয়। তিনবছরের মধ্যে গাছে ফল ধরে। এই গাছ একশো থেকে সোয়াশো বছর বেঁচে থাকে এবং মুত্যুর আগ পর্যন্ত ফল দেয়। প্রতি বছর দুই বার করে বাগান নিড়াতে হয়। অগ্রহায়ণ পৌষমাসে মাটির প্রলেপ দিতে হয় সব কান্দিতে। ফাল্গুন মাসের দখিনা বাতাস বইতে শুরু করলে গাছে নতুন পাতা গজাতে থাকে। ফাল্গুন এবং চৈত্র এই দুই মাসে ফুল থেকে ফল বের হয়। পহেলা শ্রাবণ থেকে পূর্ণাঙ্গ ফল পাড়তে শুরু করেন চাষীরা। শ্রাবণ মাসের পুরোটা সময় প্রতিদিনই পেয়ারা সংগ্রহ করতে পারেন। বিশেষ করে পুরানো গাছের ফুল দেরিতে আসে বলে ফলও দেরিতে হয়। তবে পুরানো গাছের পেয়ারা চারা গাছের পেয়ারার চেয়ে বেশী সুস্বাদু হয়।


চাষাবাদের এলাকা
 বর্তমানে বানারীপাড়া উপজেলার নরেরকাঠি, শৈতকাঠি এবং করিবকাঠিতে ১৩ হেক্টর জমিতে; ঝালকাঠী সদর উপজেলার শতাদশকাঠি, ভিমরুলী, কাপড়কাঠি মিলিয়ে ২৮ হেক্টর জমিতে এবং স্বরূপকাঠি উপজেলায় পেয়ারা চাষ হয় ৭০৩ হেক্টর জমিতে। স্বরূপকাঠি উপজেলার পেয়ারা বাগানকে আবার ৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। কুড়িয়ানাতে ২৮৯ হেক্টর,ধলহার ২৬০ হেক্টর, গণপতিকাঠি ৬১ হেক্টর, মাদ্রায় ৪০ হেক্টর, মুসলিমপাড়ায় ৪২ হেক্টর এবং জলাবাড়িতে ১১ হেক্টর জমিতে পেয়ার চাষ হয়ে থাকে। এখান থেকে সারাদেশে যায় আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারা। 

শেষ কথা

দিন দিন পেয়ারার চাষ বাড়ছে, বাড়ছে নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র। ইতিমধ্যে ঝালকাঠীর ভীমরুলি পেয়ারার আরেকটি বিক্রয় কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে আরো পসারিত হবে বলে সবার ধারনা।

 

ডিজি