• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: মে ২১, ২০১৯, ০৭:৪৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ২১, ২০১৯, ০৮:৩১ পিএম

হারিয়ে যাচ্ছে কাসিদা

হারিয়ে যাচ্ছে কাসিদা

আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা যত দূর এগিয়েছে আমাদের সংস্কৃতি থেকেও সে সুবাদে হারিয়ে গেছে  অজস্র অনুষঙ্গ। সংস্কৃতির অনেক বিষয় এখন চোখে পড়ে না। কাসিদা এমন এক সাংস্কৃতিক মাধ্যম। দিনে দিনে যা হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের নাগাল থেকে। পুরানো ঢাকার সংস্কৃতি নতুন নয়। অনেক পুরাতন। এসব সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন নবাব বাহাদুররা। তারই ধারাবাহিকতায় রমজান মাসে আমরা পেতাম সংস্কৃতির একটি অসাধারন অনুষঙ্গ কাসিদা। সাহরির আগে ঘুম থেকে জাগাতে এলাকা ভেদে একেক জনের একেকটি দল গান গেয়ে  মানুষকে জাগাতো। এ সময় গানে তারা তুলে ধরতো আল্লাহর যত গুনগান।

কিন্তু এখন জীবন অনেক বদলে গেছে , অনেক গতিশীল হয়েছে। এখন ঘুম থেকে ওঠার জন্য বের হয়েছে এ্যালার্ম ঘড়ি, স্মার্ট ফোন আরো কতো কি। যা সহজেই কাউকে ঘুম থেকে জাগাতে পারে। ফলে পুরানো ঢাকার কাসিদার আসর এখন আর সেভাবে নেই। ‘পবিত্র রমজান মাস আসে কিন্তু সাহরির সময় এখন আর একদল মানুষের কণ্ঠে কাসিদার সুর শোনা যায় না। রোজাদারদের ঘুম ভাঙাতে আর আসে না সেই গানের দল । হারেোনিয়াম , পাখোয়াজ, জিপসিসহ বিভিন্ন যন্ত্রের সমন্বয়ে চলতো গান। মাসজুড়ে  চলতো কাসিদা। সবাই রাত জেগে অপেক্ষা করতো কখন আসবে কাসিদার দল। সেদিন আর নেই। কাসিদার সুরের   অপেক্ষায় থাকে না আর কেউ।’ অথচ কাসিদার আসর বসতো, বিশাল করে করা হতো সে আয়োজন। সব মহল্লা থেকে দল আসতো প্রতিযোগিতা হতো। তাদের পুরস্কার দেয়া হতো। রাতের        নিরবতা ভেঙে পড়তো কাঁচের টাওয়ারের মতো।

অযুত মানুষ ভিড় করতো কাসিদার প্রতিযোগিতা দেখতে। কিছু কিছু এলাকায় এখনও রমজানের সাহরি খাওয়ার আহ্বান নিয়ে মহল্লা মহল্লায় ঘুরে থাকে সীমিত আকারে কাসিদা গায়কের দল। একই সঙ্গে কাসিদা রচয়িতা ও পৃষ্ঠপোষকের সংখ্যাও সীমিত হয়ে গেছে।দিগু বাবু লেনের জুম্মন মিয়া, উর্দু রোডের মঞ্জুর আলম, খাজে দেওয়ান লেনের আবদুস সালাম, নলগোলার মানিক চান ও হোসেনী দালান এলাকার সৈয়দ ফাসীহ হোসেনসহ আরও কিছু দলনেতা কাসিদা টিকিয়ে রেখেছেন।


পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, কাসিদা গাওয়ার প্রচলন কমে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে, এখন মানুষ মুঠোফোনেই সেহরির অ্যালার্ট সেবা পাচ্ছে। টিভিতে, রেডিওতে ইফতার-সেহরিতে নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে।কাসিদা কেন হারিয়ে যাচ্ছে এ প্রশ্নের জবাবে পুরান ঢাকার বিখ্যাত সর্দার বংশের সন্তান হাজী আবদুর রহিম বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক যে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিচ্ছি। আমরা শিকড়কে ভুলে থাকছি।’

কাসিদা একটি ফার্সি শব্দ, যার অর্থ কবিতার ছন্দে কোন প্রিয়জনের প্রশংসা করা। আরবি শব্দ ক্বাসাদ বিবর্তিত হয়ে ফার্সি 'কাসিদা' হয়েছে।
আরবী শব্দ 'ক্কাসদ'  অর্থ নিরেট ও পরিপূর্ণ; মস্তিষ্ক বা মজ্জা; ইচ্ছে করা; আকাঙ্খা; প্রত্যাশা। যে কবিতায় প্রিয়জনের প্রশংসা করা হয় তাদেরকে আরবী-পরিভাষায় 'কাসিদা' বলে।ফার্সিভাষী মোগলদের মাধ্যমে বাংলা অঞ্চলে কাসিদার প্রচলন ঘটে; আর এই সম্পর্কিত প্রাচীনতম তথ্যটি পাওয়া যায়। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কাসিদা সম্পর্কে বলছিলেন, খাজে দেওয়ানের আলম শাহী।  কিছুকাল আগেও রমজান এলেই কাসিদা গাওয়া হতো । পুরান ঢাকায় সাহরির সময় মহল্লা থেকে  মহল্লা গানে গানে মুখরিত হয়ে উঠতো   ।

রোজাদারদের ঘুম ভাঙাতে এ উদ্যোগ ছিলো খুবই অনবদ্য এবং  এটি ছিলো পুরানো ঢাকার একটি  সাংস্কৃতি মাধ্যম । একসময় ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে কাসিদার প্রচলন ছিলো। কাসিদা গানের গবেষকদের মতে, ‘একসময় কাসিদা পুরান ঢাকাবাসীর রোজার একটি অংশ হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি পাড়া-মহল্লার সর্দারদের সহযোগিতায় কাসিদা দল রোজাদারদের রাতে ঘুম থেকে ডেকে তোলার দায়িত্ব পালন করত।সেটা একপর্যায়ে উৎসবে পরিণত হয়।

ঢাকার সেরা কাসিদা দল নিয়ে কাসিদার প্রতিযোগিতা ও সেরা গাইয়েকে পুরস্কার দেয়ার প্রচলনও শুরু হয়। ফলে রমজান মাসে কাসিদা গায়কদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা তৈরি হয়- কোন দল বা কে কার চেয়ে ভালো কাসিদা গাইবেন।’বর্তমানে ঢিমেতালে টিকে আছে পুরান ঢাকার কাসিদা। এখন আর একে রমজানের উৎসব হিসেবে গণ্য করা যায় না। এটা এখন গুটিকতক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তারপরও এর আবেদন অনেক। ঢাকাই সংস্কৃতির অনন্য মাধ্যম কাসিদা।

 ‘ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কাসিদা’ নামে  সম্প্রতি একটি বইও রচনা করা হয়েছে। অনেক তরুন গবেষক গবেষণা করছে কাসিদা নিয়ে।পুরান ঢাকার প্রতিটি মহল্লার বিশিষ্টজনদের উচিত স্বল্প পরিসরে হলেও কাসিদা টিকিয়ে রাখা।’