• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ৫, ২০১৯, ০৩:৫০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ৫, ২০১৯, ০৩:৫২ পিএম

সরগরম নগর-বন্দর-গ্রাম

সরগরম নগর-বন্দর-গ্রাম
প্রিয়জনের ফিরে আসার আনন্দে মুখর ৬৮ হাজার গ্রাম
 এক মাসে ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন দেড় লাখ কোটি টাকা
 জাকাত ও ফিতরা বাবদ খরচ হয় প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা

কি আসে যায় একটানা বৃষ্টি। এই বৃষ্টির মধ্যে থেমে নেই আনন্দ। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঈদ উৎসবে মেতেছে মানুষ। সেই আবহমান কাল থেকে বাঙালির ঈদ মানে গ্রামের দিকে, প্রিয়জনের দিকে অবিরাম ছুঁটে চলা। এবারও লাখ লাখ মানুষ ঈদ করতে ঢাকা শহর ত্যাগ করেছেন। তবে ঈদকে ঘিরে গ্রামে উৎসব- আয়োজন হ্রাস পেলেও কমেনি মানুষের বাড়ি ফেরার আকুলতা। প্রিয়জনের ফিরে আসার আনন্দে তাই মুখর বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রাম।  

ঈদকে আনন্দময় করে তুলতে অনেক গ্রামে আয়োজন করা হয় আনন্দ মেলা। এসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার হাড়িয়ার কুটি ইউনিয়নের ডাঙ্গারহাট মেলা, বদরগঞ্জ উপজেলার লালদীঘি মেলা, নীলফামারীর সৈয়দপুর মেলা ও দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায় চৌমুহনী মেলা। সে সঙ্গে কুড়িগ্রামের ধরলা নদীর পাড়ে বসে ভাওয়াইয়া গানের আসর। কোনো কোনো এলাকায় বসে কবিগানের আসর। রাতভর চলে এসব আসর। এবারও ছোট-বড়ো পরিসরে এ ধরনের আয়োজন করা হয়েছে।

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম আর আশপাশের এলাকার মানুষ ঈদ উদযাপন করে ঐতিহ্যবাহী নানা আয়োজনে। এবারও চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে গেছে  মেজবানি মাংসের ঘ্রাণ। 

খুলনার কোনো কোনো গ্রামে ঈদে হয় জামাই মেলা। দীঘলিয়া উপজেলার ব্রহ্মগাতী গ্রামের সুতিরকুল ঈদগাহ মাঠে হয় তেমনি এক ঈদমেলা। ঈদের দিন ভোর থেকে শুরু হয়ে মেলা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মেলা পরিচিতি পেয়েছে ‘জামাই মেলা’ হিসেবে। এ গ্রামে বেড়াতে আসা জামাইরা ঈদগাহে ঈদের জামাতে অংশ নেয়ার পর ঢোকেন মেলায়। জামাই মেলায় বিক্রি হয় বড় বড় সাইজের মাছ এবং বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন। গ্রামে আসা জামাইদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়-কে কত বড় সাইজের মাছ ও কত বেশি পরিমাণ মিষ্টি নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবেন। 

সিলেট অঞ্চলের ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি পিঠা ‘হান্দেশ’ আর ‘নুন গড়া’। প্রাচীন ঐতিহ্যের এ পিঠা এখনও সিলেটের ঘরে ঘরে সমাদৃত হলেও হারিয়ে যাচ্ছে ঈদ উপলক্ষে ষাঁড়ের লড়াই ও মুরগির লড়াই আয়োজনের রীতি। 

ঈদে পাড়া-মহল্লায় বসে যায় গানের আসর। আয়োজন করা হয় পালাগান ও কবির লড়াই। কোথাও হা-ডু-ডু, কোথাও আবার প্রীতি খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলছে। তাই কোথাও কোথাও প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে। 

বেড়েছে টাকার প্রবাহ
ঈদকে কেন্দ্র করে এবারও দেশের অর্থনীতিতে বেড়েছে টাকার প্রবাহ। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, এক মাসে ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন হয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি। প্রতিবছর ১৫ ভাগ হারে বাড়ছে বলে জানিয়েছে দোকান মালিক সমিতি। নিত্যপণ্য, পোশাক, বিনোদন ও পরিবহন খাতে ব্যয় হচ্ছে এই অর্থ।

ঈদুল ফিতর মানেই নতুন জামা। শুধু ছোটদের নয়, পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য কেনা হয় নতুন পোশাক। তাই ঈদ অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে পোশাকের বাজার। এ সময় পোশাকের বেচাকেনা তিন থেকে চারগুণ বেড়ে যায়। এবার ঈদে পোশাক বিক্রির পরিমাণ ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। 

প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে নানা ভোগান্তি উপেক্ষা করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্রামের বাড়ি ফিরেন সবাই। তাই ঈদে বাস, ট্রেন, লঞ্চ এমনকি আকাশ পথেও সৃষ্টি হয় বাড়তি চাপ। ঈদে পরিবহনে ভাড়া বাড়ায় লেনদেন হয় অতিরিক্ত অর্থ। 

সারা বছর কর্মব্যস্ততার মাঝে ঈদের ছুটিতে আপন জনকে নিয়ে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ঘুরতে যান বিনোদনপ্রেমীরা। ফলে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে কয়েক গুণ বেড়ে যায় ভ্রমণকারীর সংখ্যা। তাই পরিপূর্ণ থাকে বিভিন্ন হোটেল-মোটেল। যা ঈদে অর্থনীতিতে যোগ করে বাড়তি মাত্রা।

এক হিসেবে দেখা গেছে, ঈদ কেন্দ্র করে ব্যাংকগুলোতে অন্য সময়ের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি লেনদেন হয়। এবারও তাই হয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহও ছিল বেশ ভালোই। জাকাত ও ফিতরা বাবদ খরচ হয় প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও উৎসব ভাতা।

এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেট এই ঈদ অর্থনীতিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। টিভি ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর দোকানগুলোতেও ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।

রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে
প্রবাসীরাও অনেকেই দেশে ফিরেছেন। যারা ফিরতে পারেননি, তারা পাঠিয়েছেন কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এবারও  ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে পরিবার-পরিজনদের আনন্দময় ঈদ উপহার দিতে সঞ্চয় বাড়িয়ে সে অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। সাধারণত রমজান মাস কেন্দ্র করে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য সময় প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাদের আয়ের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ অর্থ দেশে পাঠালেও রমজান মাসে তারা আরও ১০ শতাংশ অর্থ বেশি পাঠান।

প্রবাসীদের মধ্যে বেশিরভাগই শ্রমিক। তাদের পরিবার-পরিজন বাস করেন গ্রামে। ফলে ঈদের কেনাকাটাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ অর্থনীতি বেশ চাঙ্গা হয়। শহর থেকে গ্রাম- সর্বত্রই এখন মানুষের যাবতীয় তৎপরতা ঈদকে ঘিরে। 

ভিনদেশে ঈদ উদযাপন
ঈদে নগরবাসী যখন হাজারটা ঝামেলা উপেক্ষা করে নাড়ির টানে গ্রামে ফিরে যান, তখন অনেকেই আবার ভিনদেশে যান ঈদ করতে। ক্রমে এ সংখ্যা বাড়ছে। বিদেশে ঈদ করতে যাওয়া মানুষের আবার দুটি শ্রেণি রয়েছে। এক শ্রেণির মানুষ যান ইউরোপ-আমেরিকায়, তারা একেবারে উচ্চবিত্ত শ্রেণির। অন্য শ্রেণিটির লক্ষ্য থাকে কাছের দেশ ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি। তাই ঈদের আগে অনেক ট্রাভেল এজেন্সি বিশেষ প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা করে। 

জানা গেছে, সারা বছর ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ দেশের বাইরে যান। এর মধ্যে পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষ ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র্র করে বিদেশে বেড়াতে যান। এবার প্রায় ছয় লাখ মানুষ ঈদ উদযাপনে বিদেশ ভ্রমণে গেছেন। 

রিমোট কেন্দ্রিক বিনোদন
বাইরে যতই বৃষ্টি হোক না কেনো, অন্দরমহলে বিনোদনের ব্যবস্থা তো আছে। যারা বৃষ্টির জন্য বাইরে যেতে পারেননি বা পারেন নাই। তাদের হাতে এখন টিভির রিমোট কন্ট্রোল দখলে।

এবারও দেশের সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশনগুলো তিন থেকে সাত দিনে ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। পিছিয়ে নেই এফএম রেডিও স্টেশনও। দর্শকদের রুচি অনুযায়ী সাজিয়েছেন তাদের অনুষ্ঠানমালা। এরইমধ্যে জাতীয় দৈনিকসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় ম্যাগাজিন পত্রিকা বর্ধিত কলবরে ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করেছে।

নিরাপত্তা জোরদার
ঈদ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রাজধানীসহ সারা দেশে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এবার ঢাকা শহরকে নিরাপত্তা দিচ্ছে সোয়া লাখ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যবৃন্দ। দেশের বিভিন্ন শপিং মলেও ছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

এসএমএম