• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জুন ১৫, ২০১৯, ০২:১৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১৫, ২০১৯, ০২:২৮ পিএম

আষাঢ়স্য দিনে

‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর‍‍’

‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর‍‍’

 ষড়ঋতুর দেশ আমাদের বাংলাদেশ। এখানে ছয়টি ঋতুর মধ্যে যেসব ঋতু মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে বর্ষা তার মধ্যে অন্যতম।  প্রকৃতি চেতনা  মানসলোকে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। কৃষি নির্ভর দেশ বর্ষার উপরে খুবই নির্ভরশীল। ফসলের অঙ্কুরোদগমে বর্ষার প্রভাব অকল্পনীয়। বৃষ্টির মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে বৃক্ষের মতো ভেজা,কাকভেজা প্রকৃতি। পুকুরের জলে অনুরণন তোলা,হুডভেজা রিক্সায় ভেজা নগরীর দৃশ্য , পাতাভেজা শহর যেন সজীব হয়ে ওঠে।

এই বৃষ্টির জন্য মেঘা রানী কূলো বের করে  ছড়া কেটে বলা হয় ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে,ধান দেবো মেপে’ বা ‘মেঘারানী মেঘা রানী দে বৃষ্টি দে পানি’, আবার কাধারে বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হলে-গ্রামের কিশোরকিশোরীরা বৃষ্টিতে ভিজে দলবেধে গাইতে থাকে-‘লেবুর পাতায় করমচা,যা বৃষ্টি দূরে যা।’ বরষার প্রশস্তি গীতের অন্ত নেই। যে জন্য ঋতু বৈচিত্র্যের প্রভাবটা এখানে একটু বেশি দৃষ্টিগোচর হয়। বর্ষা মানেই বিরহ,বর্ষা মানেই দুরন্ত কৈশোরে চলে যাওয়া। জানালার পাশে বসে টিনের চালে বেটোফেনের সুর সাধা। প্রাচীনকাল থেকেই বর্ষাবন্দনা বাঙালি কবিদের চেতনালোকে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিরহে নিমজ্জিত কবিরা লিখেছেন তাদের অমর কাব্যগাথা:

‘এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইলো বাটে।
আঙ্গিনার মাঝে বঁধূয়া ভিজিছে
দেখিয়া পরাণ ফাটে’
(চণ্ডীদাস)

একইভাবে দেখি প্রাচীণ আরেক কবির লেখা বর্ষণ মুখর দিনে বিরহের সুর নিহিত আরেকটি কবিতা :
‘এ সখি হামারি দুখের নাহিকো্ ওর।
এ ভরা বাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দির মোর’
(বিদ্যাপতি)

দুই প্রাচীন কবির  কবিতা পড়ে বর্ষা নিয়ে পাঠকের মনে নব চেতনার অনুরণন ঘটে।মহাকাব্যের যুগের মহাকবি থেকে শুরু করে মধ্যযুগের কালিদাস পুরো কাব্য আখ্যানের মধ্যে ঋতুকেন্দ্রিক ভালবাসার যে আকিঞ্চণ পাঠকের জন্য রেখে গেছেন, তাতে তো এই বর্ষায় মন ঘরে থাকার কথা নয়।‘মেঘদূত’-এর কথাই যদি বলি, কী এমন ঘটনা অথচ বর্ণনা ও উপস্থাপনের ঘনঘটায় সেখানে বিরহ কতোটা প্রবল, কতোটা প্রকট তা পাঠক মাত্রই জানেন। যক্ষকে নির্বাসন দেয়া হলে উজ্জয়িনী নগরীতে বসবাসরত স্ত্রী’র জন্য তার সোমত্ত বিরহ জাগ্রত হয়ে ওঠে। যে করেই হোক,  প্রিয়তমা স্ত্রী’র সঙ্গে তার তখন যোগাযোগ করা চাই-ই চাই।

 কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? দূর তো আর কম নয়! তাছাড়া নির্বাসিত জীবনে সে কীভাবে স্ত্রী’র সঙ্গে যোগাযোগ করবে? এই মনোযাতনার ভেতরে আষাঢ়ের প্রথম দিনে তিনি দেখলেন একখানা মেঘ। মেঘকে জানালেন দুঃখের কথা, বিরহের কথা, পীড়িত হৃদয়ের কথা। মেঘ যক্ষের কথা শুনে দয়াবান হলো। যক্ষ মেঘের মাধ্যমে প্রিয়তমা স্ত্রী’র উদ্দেশ্যে একখানা চিঠি লিখলেন। মেঘকে দূত করে এই যে বার্তা প্রেরণ, এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে সংস্কৃত সাহিত্যে ‘মেঘদূতম’ কাব্যটি শুধু শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদারই হয়ে ওঠেনি, বরং বিশ্বের তাবৎ ভালোবাসার মানুষের কাছে এটি হয়ে উঠেছে প্রেমের মূর্ত প্রকাশ। 

আষাঢ় এলেই গ্রামবাংলার শাশ্বত চিত্র চোখের চতুষ্কোণে বিম্বিত হয়ে ওঠে।টিনের চালের উপরে আকাশ থেকে নেমে আসা জলধারার টপটপ শব্দ, সারাদিন ধরে একটানা বৃষ্টিতে গাছের ডালে ভেজা কাকের অসহায় বসে থাকা, অথবা কিশোরীর চুল থেকে ঝড়া মুক্তদানার মতো বৃষ্টির জল পড়ার শব্দ একটু কান পাতলেই কিন্তু শোনা যায়। কচুর পাতার ভেতর বৃষ্টির জল নিয়ে খেলা করা দূরন্ত শৈশব সে তো এই বর্ষাকালের জন্যই।অথচ আজ তাকে খুঁজে পাওয়া ভার! এসব কিছুর পরেও বর্ষাকাল মানেই বিরহ, বর্ষাকাল মানেই কবিতার অনন্ত প্রহর।

মধুসূদন তার কবিতায় বর্ষা এনেছেন প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসেবে।বর্ষার প্রকৃতি আর মানব প্রকৃতি এখানে একাকার। যার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন দেবতাগণও। ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় তিনি বিম্বিত করেছেন যক্ষের বিরহী অন্তরের বারতা। যার মধ্য থেকে উত্থিত হয়েছে গভীর গর্জন, নদীর উত্তাল ঢেউয়ের আছড়ে পরা কল্লোল। তিনি লিখেছেন :
‘গভীর গর্জ্জন সদা করে জলধর,
উথলিল নদ-নদী ধরণী উপর।
রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে,
দানবাদি, দেব, যক্ষ সুখিত অন্তরে।’
(বিবিধ কাব্য)

এক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বর্ষাবন্দনা’ আপনাকে মনে করিয়ে দেবে বর্ষা  বুঝি শেষ হবার নয়। চির যৌবনা বর্ষা অনন্তকাল ধরে কাব্যের ভেতরে-বাইরে যে ভূমিকা রেখেছে, সবগুলো ঋতু মিলেও তা বোধহয় সম্ভব হচ্ছে না।প্রাচীণ কবিদের মতো এ কালের কবি রবীন্দ্রনাথ অপার বিস্ময় ও অতল রহস্যময় বলে মনে করেছেন বিশ্ব প্রকৃতিকে। তিনি ঋতুচক্রের মধ্যেও খুঁজে পেয়েছেন নির্বাধ গতিশীলতা। তার বর্ষার গানেও এই ঋতু চেতনার পরিচয় মেলে। আপন ভাবকল্পনা ও মনের রঙে তিনি বর্ষাকে দেখতে চেয়েছেন, অনুভব করেছেন বর্ষার সঙ্গে অন্তর্লীন সম্পর্ক। ‘জীবন স্মৃতিতে’ কবি তার কাব্যে বর্ষা এবং যৌবনে শরতের ভাবনার প্রভেদ দেখাতে গিয়ে বলেছেন, ‘সেই বাল্যকালের বর্ষা ও এইযৌবনকালের শরতের মধ্যে প্রভেদ এই দেখিতেছি যে, সেই বর্ষার দিনে বাহিরের প্রকৃতিই অত্যন্ত নিবিড় হইয়া আমাকে ফিরিয়া দাঁড়াইয়াছে,তাহার সমস্ত দলবল সাজসজ্জা এবং বাজনা-বাদ্য লইয়া মহাসমারোহে আমাকে সঙ্গদান করিয়াছে।

আর, এই শরৎকালের মধুর উজ্জ্বল লোকটির মধ্যে যে উৎসব তাহা মানুষের। মেঘ রৌদ্রের লীলাকে পশ্চাতে রাখিয়া সুখ-দুঃখের আন্দোলন মর্মরিত হইয়া উঠিতেছে, নীল আকাশের উপরে মানুষের অনিমেষ দৃষ্টির আবেশটুকু একটা রঙ মাখাইয়াছে এবং বাতাসের সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষাবেগ বহিতেছে।’
কবি যদিও শৈশবের বর্ষার বাইরের রূপ এবং যৌবনে শরতের অন্তরঙ্গ রূপটি দেখেছেন তা সত্ত্বেও দু’টো ঋতুর সঙ্গে তিনি এক ধরনের আত্মীয়তার সম্পর্ক অনুভব না করে পারেন নি। বর্ষার বন্দনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়।’

এমন দিনে কাকে বলা যায়? সে কে? কোথায় তার বাস? তা রবীন্দ্রনাথ যেমন জানতেন, বাঙালি মানস তেমনই জানেন। এমন দিনে যারে বলা যায়, সে কী ঈশ্বর না প্রেম? প্রেমের নামই ঈশ্বর? রবীন্দ্রনাথ বর্ষাবন্দনা কতভাবে যে করেছেন, তার শেষ নেই।

‘ বসন্ত আমাদের মনকে চারিদিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়, বর্ষা তাহাকে এক স্থানে ঘনীভূত করিয়া রাখে।… বর্ষায় আমাদের মনের চারিদিকে বৃষ্টি জলের যবনিকা টানিয়া দেয়, মাথার উপরে মেঘের চাঁদোয়া খাটাইয়া দেয়। চারিদিক হইতে ফিরিয়া আসিয়া এই যবনিকার মধ্যে এই চাঁদোয়ার তলে একত্র হয়। পাখির গানে আমাদের মন উড়াইয়া লইয়া যায়, কিন্তু বর্ষার বজ্রসংগীতে আমাদের মনকে মনের মধ্যে স্তম্ভিত করিয়া রাখে। পাখির গানের মতো এ গান লঘু নহে। ইহা স্তব্ধ করিয়া দেয়, উচ্ছ্বসিত করিয়া তুলে না। অতএব দেখা যাইতেছে, বর্ষাকালে আমাদের ‘আমি’ গাঢ়তর হয়, আর বসন্তকালে সে ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে।’

‘পরিচয়’ গ্রন্থের ‘আষাঢ়’ গদ্যে রবীন্দ্রনাথ ছয় ঋতুর বর্ণভেদ করতে গিয়ে বর্ষাকে ক্ষত্রিয় বর্ণে ফেলেছেন। বলেছেন, ‘বর্ষাকে ক্ষত্রিয় বলিলে দোষের হয় না। অল্পে তাহার সন্তোষ নাই। লড়াই করিয়া সমস্ত আকাশটা দখল করিয়া সে দিক চক্রবর্তী হইয়া বসে।’

‘ক্ষণিকা’র ‘নববর্ষা’ কবিতায় কবি উচ্ছ্বাস ভরে বলেছেন, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ুরের মতো নাচেরে।’ ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে ২ আষাঢ়, ১২৯৯ তারিখের চিঠিতে কবি লিখেছেন, ‘হাজার বছর পূর্বে কালিদাস সেই যে আষাঢ়ের প্রথম দিনকে অভ্যর্থনা করেছিলেন এবং প্রকৃতির সেই রাজসভায় বসে অমর ছন্দে মানবের বিরহ সঙ্গীত গেয়েছিলেন আমার জীবনেও প্রতি বৎসরে সেই আষাঢ়ের প্রথম দিন তার সমস্ত আকাশ জোড়া ঐশ্বর্য নিয়ে উদয় হয়।’ কবির জীবনে ৮১টি আষাঢ় এসেছিল। এর মধ্যে কবি জীবনের গোড়ার দিকের ২০ থেকে ২৫টি আষাঢ় বাদ দিলে প্রতি বছর আষাঢ়েই তিনি গান লিখেছেন। বর্ষা ছিল কবির বেশ কিছু মনোজ্ঞ গান সৃষ্টির উৎস।

কবি অক্ষয় কুমার বড়ালের কবিতার চিত্রকথা সম্পূর্ণ আলাদা। আলাদা তার বর্ষা ভাবনাও। বর্ষা শুধু যে মাঠঘাট ভরিয়ে দেয় তা নয়। কোথাওনা কোথাও শূন্যতারও সৃষ্টি করে।যখন চারদিক শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি তখন মাঠঘাটে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করে। কবির মনেও সেই শূন্যতা দাগ কাটে। তিনি লেখেন :  
‘ঝরে বৃষ্টি গুঁড়িগুঁড়ি কভু বা ঝর্ঝরে
ছিন্নভিন্ন লঘু মেঘ ভাসিছে আকাশে;
এখনো সুষুপ্ত গ্রাম তরুছায়া ভরে;
স্তব্ধ মাঠে শ্রান্ত পদে শূন্য দিন আসে।’

সাম্য ও প্রেমের কবি কাজী নজরুলের কবিতায় বর্ষা এসেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। বিরহের অন্তঃশীলা তার কবিতায় বিন্যস্ত হয়েছে বিম্বিত বিস্তারে। বাদল দিনের মেঘ তাকেও যক্ষের মতো করেছে বিরহ পাগল। বর্ষাধারাকে তিনি বর্ণনা করেছেন প্রিয়তমার আগমনী বারতা হিসেবে।বাদল ধারা প্রিয়ার আগমনী সুরকে বিদায়ী সুরে পরিণত করেছে। কবি লিখেছেন :


‘বাদল রাতের পাখী।
উড়ে চল যেথা আজো ঝরে জল, নাহিক ফুলের ফাঁকি।’
(চক্রবাক; বাদল রাতের পাখী)

কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বর্ষা তেমন প্রভাব না ফেললেও অমিয় চক্রবর্তী কিংবা বিষ্ণু দে’র কবিতায় বর্ষা এনেছে অন্যমাত্রা। এখানে বর্ষা শুধু প্রেমের প্রতীক নয়। এখানে বৃষ্টি নতুন প্রাণের সঞ্চারক। অমিয় চক্রবর্তীর  ‘বৃষ্টি’ কবিতায় বর্ষা বিম্বিত হয়েছে নতুন রূপে, নতুন কাব্যসুষমায়।


‘অন্ধকার মধ্যদিনে বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে
বৃষ্টি ঝরে রুক্ষ মাঠে, দিগন্তপিয়াসী মাঠে, স্তব্ধ মাঠে,
মরুময় দীর্ঘ তিয়াষার মাঠে, ঝরে বনতলে,
ঘনশ্যামরোমাঞ্চিত মাটির গভীর গূঢ় প্রাণে
শিরায় শিরায় স্নানে, বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে।’
(একমুঠো)

কবি শামসুর রাহমান বৃষ্টির বিলম্বকে তার সৃজন বেদনার সাথে তুলনা করেছেন। তিনি লিখেছেন :


‘টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষীর মতো বড়
ব্যগ্র হয়ে চেয়ে আছি, খাতার পাতায় যদি জড়ো
হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুল, বৃষ্টি। অলস পেনসিল
হাতে, বকমার্কা। পাতা-জোড়া আকাশের খাঁ-খাঁ নীল।’
(দুঃসময়ের মুখোমুখি, অনাবৃষ্টি)

কবি আল মাহমুদ বর্ষাকে দেখেছেন একটু আলাদা করে। তার বর্ষার প্রকৃতি ভিন্নসাজে সজ্জিতা এক ফলবতী নারী। তিনি লিখেছেন :


‘শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়, শেওলাপিছল
আমাদের গরীয়ান গ্রহটির গায়।’
(আরব্যরজনীর রাজহাঁস, আষাঢ়ের রাত্রে)

বাংলা কবিতায় বর্ষা বন্দনা হয়েছে যুগে যুগে। বর্ষা আর বৃষ্টি এখন কবিতার একটি অংশ। বর্ষামঙ্গলের স্তুতি আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সীমাবদ্ধ
নেই। বাংলা সাহিত্যে বর্ষার আকার এখন বিশাল ক্যানভাসজুড়ে।এ কারণেই কিনা জানি না, এই বঙ্গে বর্ষা ঋতু ছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়
বৃষ্টি হয়।