• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জুন ১৬, ২০১৯, ০১:০৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১৬, ২০১৯, ০১:১৬ পিএম

‘কতইতো বাজেট হইছে? তেউল্লা শহিদুল তেউল্লাই আছে’ 

‘কতইতো বাজেট হইছে? তেউল্লা শহিদুল তেউল্লাই আছে’ 


অনধিকার চর্চায় একটি প্রচলিত শব্দ আছে ‘অয়েল ইওর ওন মেশিন’, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘নিজের চরকায় তেল দাও’। যা বলে প্রতিপক্ষের পরচর্চা থামানো যায়। তবে পেশাগতভাবেই যারা দীর্ঘদিন ঘানি ঠেলে নিজের চরকা ঘুরিয়ে অন্যকে তেল দিয়ে সহযোগিতা করে আসছেন, তাদের কিন্তু কেউই থামায় না। উন্নত জীবন গড়ার হাতছানিও দেয় না। প্রতি বছর নতুন বাজেট ঘোষণা হয়, কিন্তু এসব বাজেটেও থাকে না তাদের কথা। আলোচনা হয় না সভা-সমাবেশ বা সেমিনারে। গণমাধ্যমেও উঠে আসে না তাদের কষ্ট।

দৈনিক জাগরণে আজ এমন একজন মানুষের কথা তুলে ধরা হচ্ছে, যিনি জীবনে কখনো সুখের দেখা তো দূরের কথা, সুখের হাতছানিও পাননি। জন্মের পর দেখেছেন, বাবার ঘানি ঠেলা। বাবাকে হারানোর পর নিজেও সেই পেশায়ই মনোনিবেশ করেছেন। পাবনার সুজা নগরে জন্ম নেয়া শহিদুলের বয়স এখন ৩৫ এর কোঠায়। জীবন থেকে চলে যাওয়া এই সময়ের প্রায় ২০ বছর ধরে সাধারণ মানুষের মাঝে ঘানি ঠেলে আসল তেল বিক্রয় করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে কিভাবে একটু ঊর্ধ্বতন মহলে এই তেল দিলে (মারলে) নিজের ভাগ্যের চাকা আরো গতিশীল হতো, সে বিষয়ে বড়ই অনভিজ্ঞ শহিদুল। 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের ‘জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ ঘাষণা করা হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। বাজেট নিয়ে এখন পক্ষে-বিপক্ষে চলছে নানা আলোচনা। বাজেট ঘোষণার পর আজ সিপিডি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে- এ বাজেটে ধনীদের বেশি প্রধান্য দেয়া হয়েছে। অনেক সংগঠনের পক্ষ থেকেও এমন দাবি তোলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, সরকারও যদি ধনীদের পাশে থাকে, তাহলে দেশের অসহায় মানুষগুলোর কি হবে? কার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে তারা?

শুক্রবার জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগর সড়কে ঘানিতে নারিকেল ও সরিষা ভাঙ্গিয়ে তেল বিক্রি করার সময় দেখা হলো শহিদুল আলমের সঙ্গে। জানালেন, তার বাবার ইচ্ছে ছিলো, ছেলেকে লেখা-পড়া শিখিয়ে বড় পুলিশ অফিসার বানাবেন। পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত পড়ার পর বাবাকে হারিয়ে নিজেকেই সংসারের ঘানি মাথায় নিলেন। নেমে পড়লেন বাবার ঘানি ঠেলতে। সেই যে ঠেলা শুরু... আজও চলছে।

জানালেন, পাবনার সুজা নগর ছেড়ে আসার কথা। বাবার মৃত্যুর পর চাচাদের অত্যাচারে মায়ের মৃত্যুর পর পৈত্রিক ভিটে-মাটি ছেড়ে পাবনা শহরের পাশে ঠাঁই নিলেন। বেশি দিন থাকতে পারেননি সেখানে। সারা দিন ঘানি ঠেলে ১০০০ টাকা লাভ হলেও ৫০০ টাকা দিয়ে দিতে হতো স্থানীয় প্রভাবশালীদের। এ দিয়ে ঘানির খরচ পুষিয়ে কোন রকম দু মুঠো ভাতের টাকা থাকতো। একসময় তাকে বসানো নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেল। কে কোথায় তাকে বসাবে। কারণ দিনে ৫০০ টাকা। এ নিয়ে দুই পক্ষের মারামারির মধ্যে একদিন রাতের আঁধারে পাবনা ছাড়েন শহিদুল। 

৪ বছর আগে ২০১৪’র শেষের দিকে ঢাকায় এসে মিরপুরের টোলার-বাগের একটি বস্তিতে ওঠেন। এখানে থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘানি ঠেলে তেল বিক্রয় শুরু করেন। বছর খানেক পর এই বস্তির একটি মেয়েকে বিয়ে করেন। স্ত্রীকে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়ে দেন। এভাবেই চলে যায় দু’বছর। তেল বিক্রি থেকে আয়ের সব টাকাই রাখতেন স্ত্রীর কাছে। দুই বছরে প্রায় ৫০ হাজার টাকা জমা রেখেছিলেন। এই টাকা নিয়ে তার স্ত্রী ২০১৭’র জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে (দিন মনে নেই) পালিয়ে দুবাই যান। বাবা-মায়ের পর স্ত্রীও হারালেন শহিদুল। এখন আর তার পিছু টান নেই। শুধুই ঘানি ঠেলে পথ চলা। 

নতুন বাজেটের কথা জিজ্ঞেস করতেই শহিদুল বললেন, ‘সরকার আসে সরকার যায়, আমগো ব্যথা মনে রয়।’ ছন্দ মিলিয়ে কষ্টগুলো যেন বুকের ভেতরেই গেথে রেখেছিলেন। একটু থেমে আবার বললেন- ‘বাজেট-টাজেট দিয়ে আমগো লাভ কি? ১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ঢাকাতেই আছি। কতইতো বাজেট হইছে, আমার ভাগ্যের কি কোন পরিবর্তন হইছে? তেউল্লা শহিদুল তেউল্লাই আছে।’ 

এমএএম/আরআই