ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের রাস্তাটা পের হয়ে রবীন্দ্র সরোবরে যেতে একটু এগোলেই সুদৃশ্য ওভারব্রিজ। ওভারব্রিজে দাঁড়াতেই কানে এসে আছড়ে পড়ে সোঁদা মাটির গন্ধমাখা সুরের মুর্ছনা। মুগ্ধ করা সে সুর শুনে পা থেমে যায়। এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে মন মাতানো সুরের ধারা ক্রমশ ঘন হয়ে আসতে থাকে। পাগল করা বাঁশির সুর কানে অনুরণন তোলে। খুঁজতে খুঁজতে চোখে আসে এক ক্ষুদে বংশীবাদকের অবয়ব। বিভিন্ন পরিচিত আকর্ষণীয় গানের সুরে পথচারীকে মুগ্ধ করে সে বাঁশি বিক্রি করছে। সাথে তার কথাও শুনছে সবাই মনযোগ দিয়ে। পথের ধারে সাজানো আসর তার । আসরের পাশেই পাশেই ছোট বড় বাঁশির পসার। মুগ্ধ দর্শক-শ্রোতাদের সারি। এন্ড্রয়েড ফোনে কেউ ছবি তুলছে, কেউবা ভিডিও করছে বংশীবাদকের বাদন শুনে।
্এই কিশোর বংশীবাদকের ধ্যান-জ্ঞান সবই বাঁশী । বাজানোর সময়ে তার কোন কিছুর দিকে ভ্রুক্ষেপ থাকে না। এর মধ্যে তার বাঁশিতে বেজে ওঠে রাধারমনের সেই বিখ্যাত গান- ‘আমারে আসিবার কথা কইয়া মান করে রাই আছো যে ঘুমাইয়া।’ এরপর ‘নিধুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে’... বা ‘গাড়ি চলে না চলে না’... এমন জনপ্রিয় নানা গানের সুর তুলছে বাঁশিতে । ছোট ছোট আঙুলে তুলছে বিশদ। এর মধ্যে একটু আলাপ হয়। এই বংশীবালকের নাম শাহাদাত মিয়া।‘বংশীবালক’ নামেই স্কুলে তার পরিচিতি। থাকে রায়েরবাজারে। পড়াশুনা জাফরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র সে। নিজে বাঁশি বাজিয়ে পড়াশুনার খরচ চালান । সংসার চালাতেও সাহায্য করেন বাবাকে। মাত্র আট বছর বয়সে সে উপার্জন শিখেছে। তাকে শিখতে হয়েছে। বাড়িতে সংকটের কারনে তাকে বাঁশি ধরতে হয়েছে। তবে বংশীবালক শাহাদাত বলেছে ভিন্ন কথা।
বাঁশীতে ডাকে বলেই সে বাঁশি বাজায় । এ ডাক অন্য কেউ শুনে না। শুধু সে একাই শুনে। শাহাদাত বলেন, যেকোন মানুষের চেষ্টা থাকলেই সে বাঁশি বাজাতে পারে।’ বংশীবালক শাহাদাতের বাবা রাজু মিয়া কাছেই বসেছিলেন। তিনি নিজেও একজন বংশীবাদক। বেশ আগে থেকে তিনি ঢাকার রায়ের বাজার এলাকায় বাঁশী বাজাতেন ও বিক্রি করতেন। বাঁশি অন্তঃপ্রান তার জীবন। তবে তার সন্তান জন্ম নেয়ার পর তিনি ভাবেননি যে যে তার সন্তান বংশীবাদক হবে। কিন্তু — ঘটনাক্রমে তাই হয়েছে। শাহাদাত ছোটবেলা থেকেই বাঁশি বাজাতে শুরু করে। তখন থেকেই ওর হাত পরিপক্ক হতে শুরু করে। এখন ছেলের বাদন শুনে তার বাদ্য শুনতে চায় না কেউ। দুজনেই রায়ের বাজারে বাঁশি বিক্রি করেন। রাজু মিয়া বলেন, ওর বাদনের প্রশংসা সবার মুখে। সবাই ওর বাদনের প্রশংসা করে। তাতে আমার বুক গর্বে ভরে ওঠে। কত কষ্ট করছি এই ঢাকা শহরে । তবু বাঁশী ছাড়ি নাই। আমি যা করতে পারিনি আমার ছেলে সেটা করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু শাহাদাতকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়ার কথা বললে শাহাদাত জানায়, আমি বড় অইয়া এসব গান আর বাজাবো না। চৌরাসিয়ার মতো সুর বাজাবো। মানুষ সে সুরে আরো মুগ্ধ হবে।’
শাহদাত বলে , বাঁশি অল্প টাকায় কিনে বাজানো যায়, মানুষের প্রানের মধ্যে অনুরণন তোলা যায়। তাই বাঁশির মতো যন্ত্র আর দ্বিতীয়টি নেই । উপস্থিত সবাইকে সে একটা বাঁশি কিনতে অনুরোধ করে। তার সংগ্রহের বাঁশির মূল্য বাঁশির মূল্য পঞ্চাশ থেকে আড়াই হাজার টাকা । স্থানীয় ভাবে শাহাদাতের পরিচিতি এখনই অনেক। সবাই তাকে বংশীবাদক হিসাবেই চিনে। নবীনবরণ, পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান, পয়লা বৈশাখ, জাতীয় অনুষ্ঠানের যেকোন দিবসের যেকোনো আয়োজনে শাহদাত আমন্ত্রণ পায় বাঁশী বাজানোর। সে বাঁশী বাজায়। বাঁশী তার জীবন প্রান। সব সময় তার হাতে বাঁশী থাকেই। ঘুমের সময়ও পাশে তার বাঁশি থাকে। বলেন তার বাবা রাজু মিয়া। শাহাদাতের বাবা রাজু মিয়ার গল্প শুনতে শুনতে উঠে পড়া। সূর্য তখন পাটে নেমেছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। কাচপোকা খুঁজছে আশ্রয়। শাহদাত ও রাজু মিয়া দোকান গোছায়। বাঁশী হাতে শাহাদাত বাজায় আমারে আসিবার কথা কইয়া.... তার বাঁশীর সুরের মুর্চ্ছনায় মনের হয় নগরীর টাওয়ার গুলো ভেঙে যাবে। দূরে যাই। তবু শাহাদাতের মনোহর বাঁশির শব্দ যেন শহরের অলিতে গলিতে ঘুরতে থাকে।
/ডিজি