• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০১৯, ০৬:৫৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ২৪, ২০১৯, ০৭:১৪ পিএম

রূপলাল হাউজ : ইতিহাসের ধূসর পাণ্ডুলিপি

রূপলাল হাউজ : ইতিহাসের ধূসর পাণ্ডুলিপি

রূপলাল হাউজ। ঢাকার ইতিহাসের পুরানো অধ্যায়ের একটি। এর ইটের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে ইতিহাসের এক একটি ঘটনা। যা পড়লে ঢাকার এক সময়ের বিত্তবানদের ইতিহাসের বিভিন্ন কাহিনী স্মৃতির অন্দরে এসে ভিড় করবে। এ বাড়ির সৌন্দর্য, সংস্কৃতি ও রূপলাল দাসের প্রতাপের কারনে ইংরেজ আমলের বড় লাট সাহেব ঢাকায় এসে নিয়ম মাফিক আহসান মঞ্জিলে যাওয়ার কথা থাকলেও উঠেছিলেন রূপলাল হাউজে। রাষ্ট্র ও আমলা তোষনের এগুলো বড় চিহ্ন হলেও এসব তখন জাতে ওঠার বা সমাজে সম্মানিত হওয়ার মূল বিষয় ছিলো। অহংকারের সেইসব সৌধ ভেঙে গেছে। ব্যবসায় এক চেটিয়া রীতি আর কারো একার হাতে নেই। তবু বইয়ের পাতায় এসব কাহিনী এখনও রয়ে গেছে।

ফরাশগঞ্জের শ্যামবাজারের সেই জৌলুসপূর্ণ বাড়ির নাম বললে এখন আর তেমন কেউ চিনে না। দু’ একজন যা বলছে তা নিয়েও  তৈরী হতে থাকে বিভ্রান্তি। কারন, এক একজন এক এক দিকে দেখিয়ে দিয়েছে। আসলে রূপলাল হাউজ এখন আর কেউ চেনে না। অবহেলা-অনাদরে বাড়ির যে শ্রী হয়েছে তাতে কারো বোঝার সাধ্য নেই এই বাড়িটি পুরানো ঢাকার ইতিহাসের একটি অংশ।  এখন রূপলাল হাউস না বলে  মসলার আড়ৎ বললে চেনা সহজ। বাড়িটি যেমন ধংশের মুখোমুখি তেমনই বেদখল মনে হয়।  ভেতরে যেতে বাধা দেয় অনেকেই । তারা ক্যামেরা দেখলে ভয় পায়। ছবি তুলতে গেলে নানা ধরনের প্রশ্ন করে। সবকিছুর পর মনে হবে-রূপলাল হাউজে আসিনি। পুরানো ঢাকার বিস্মৃতির অন্তরালে ঢাকা পড়া  কোন জায়গায় আসিনি , আসিনি এক সময়ের পুরানো ঢাকার জৌলুসপূর্ণ কোন  বাড়িতে । এসেছি, কোন এক মসলার আড়ৎ এ। এই হলো রূপলার হাউজের বর্তমান পরিনতি।

রূপলাল হাউজের পেছনের কথা....

প্রতিপত্তি আর আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশের প্রতীক হিসেবে রূপলাল দাস নির্মাণ করেছিলেন রূপলাল হাউজ। রূপলালের আদি নিবাস বুড়িগঙ্গার ওপারে শোভাড্যা গ্রামে। তার দাদা মথুরানাথ পোদ্দার ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে শুরু করেছিলেন পোদ্দারি ব্যবসা। তিনি তখন বাট্টা দিয়ে টাকা, আধুলি, সিকি ইত্যাদি মুদ্রা ভাঙ্গিয়ে দিতেন। মথুরানাথ তখনকার দিনে প্রতিদিন বাংলা বাজারে রাস্তার উপর চট পেতে টাকা ভাঙানোর দোকান সাজিয়ে বসতেন। তৎকালিন পূর্ববঙ্গে বাংলাবাজার ছিল পয়সা লগ্নি ও টাকা বিনিময়ের কেন্দ্র। মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে মথুরানাথ খুব অল্প সময়ে অসম্ভব সফলতা অর্জন করেন। তখন তিনি রাস্তার দোকান উঠিয়ে বাংলা বাজারে জমি কিনে নিজস্ব দোকান দিয়ে বসেন । পরে তিনি মুদ্রা ভাঙানোর কাজ ছেড়ে দিয়ে লগ্নি ও হুন্ডির কারবারে নামেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মথুরানাথ তৎকালিন একশ টাকায় বছরে ৫৭০ টাকা শোধ নিতেন। ব্যবসার ধারাবাহিক উন্নতির ফলে ক্রমেই মথুরানাথ ঢাকার শ্রেষ্ঠতম ধনাঢ্য হিন্দু ব্যবসায়ীতে রূপান্তরিত হন। ১৮৬০ এর দশকে সামাজিক প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্য যে মথুরানাথের পুত্ররা জমিদারিও কিনতে শুরু করেন। মথুরানাথের ছিল দুই পুত্র। স্বরূপ চন্দ্র দাস এবং মধুসূদন দাস। স্বরূপচন্দ্রের পুত্র (মথুরানাথের পৌত্র) রূপলাল দাস ফরাশগঞ্জে ভিক্টোরিয়ান স্টাইলে একটা বিশাল জমকালো বাড়ি নির্মাণ করেন।
তিনি নিজের নামে এর নাম দেন রূপলাল হাউজ। অধিকাংশ ইতিহাস বেত্তাদের মতে, ঊনিশশতকের ষাটের দশকে রূপলাল আরাতুন নামের এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একটি পুরনো ভবন ক্রয় করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এ ভবনটি মার্টিন এন্ড কোং কোম্পানির একজন স্থপতিকে দিয়ে পুনঃনির্মাণ করেন এবং এর নাম দেন রূপলাল হাউজ। রূপলাল হাউজ সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থাপত্যরীতির দুটি অসমান বস্তুকে বিভক্ত করা একটি দ্বিতল প্রাসাদ। এটি প্রায় ৯১.৪৪ মিটার দীর্ঘ। বাড়িটির পেছনে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গা নদী থেকে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা যেত। রূপলাল হাউজ ঔপনিবেশিক আমলে প্রবর্তিত পরবর্তী রেঁনেসা যুগের ইউরোপীয় স্থাপত্যের এক চমৎকার উদাহরণ। এর গঠন কাঠামো্ ‘উ’ আকৃতির। যার তিন বাহু নগরের দিকে প্রসারিত। মাঝের বাহুটি সবচেয়ে বড়। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮.৩৩ মিটার।

এ ভবনটির ছাদ নির্মিত হয়েছিল কোরিনথীয় স্টাইলে। এর উপরে রয়েছে পেডিমেন্ট। যা রেঁনেসা যুগের পেডিমেন্টের অনুকরণে নির্মিত। দ্বিতীয় তলায় বিভিন্ন আয়তনের মোট ৫০টিরও বেশি কক্ষ রয়েছে। কথিত আছে যে সেই সময়কার বিদেশীগন ঢাকায় আসলে রূপলাল হাউসে ভাড়া করে থাকতেন। সেই যুগে রুম প্রতি ভাড়া প্রদান করতেন ২০০টাকা। এ ঘরের মেঝে ছিল কাঠের। পুরো বাড়ি জুড়ে উত্তর দক্ষিণপাশে রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দা দুটি সেমি কোরিনথীয় স্তম্ভ বা সমায়ত ইটের থামের উপর স্থাপিত। এ স্তম্ভ বা থামসমূহের উপর বিভাজিত, ত্রিপদ খিলান ছিল। তৎকালীন ঢাকার নবাব বাড়ি তথা আহসান মঞ্জিলের সাথে তুলনা করার মতো একমাত্র বাড়ি ছিল রূপলাল হাউজ। গ্রীক স্থাপত্য  শৈলীতে এসেছিল এক অমর নতুনত্ব। তৎকালীন ঢাকার কোনো বাড়িতে এধরনের স্থাপত্য শৈলী ছিলো না।

রূপলাল হাউজের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বাড়ির উপরে মাঝখানে স্থাপিত একটা প্রকান্ড ঘড়ি, যা ঢাকা শহরের সম্মুখভাগের সব নদী বা খাল থেকে দেখা যেত। নৌ-পথে চলাচলকারী মাঝি বা নৌকারোহীগণ এ ঘড়ি দেখে সময় নির্ধারণ করতেন। ১৮৯৭ সালের দিকে হঠাৎ ভূমিকম্পে ঘড়িটি ভেঙে গেলে পরবর্তী সময়ে তা আর মেরামত করা হয়নি। ১৮৮৮ সালে ভারতের ডাইসরয় লর্ড ডাফরিন ঢাকা সফরকালে রূপলাল হাউজে আসেন। তার সম্মানে রূপলাল বল নাচের আয়োজন করেছিলেন। বাংলা ভাষাভাষীদের গর্বের ধন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রূপলাল হাউজে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন।  বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম তার অসাধারণ পরিবেশনায় রূপলাল হাউজ মাতিয়েছিলেন। এক সময় রূপলাল হাউজ থেকে ‘শাস্তি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ হতো। পরবর্তী সময়ে তার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকেই রূপলাল হাউসের জৌলুস কমতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় রূপলালের উত্তরাধিকারীরা কলকাতায় চলে যান।এভাবে  রূপলাল হাউসের ইতিহাসে ক্রমশ ধূলো জমতে থাকে।


 কিন্তু এখন কেমন আছে রূপলাল হাউজ ? ইতিহাসের সাথে বর্তমান রূপলাল হাউজের আকাশ - পাতাল ব্যবধান। দিন দিন দেয়াল থেকে চুন সুড়কির আবরণ খসে পড়ছে। ভবনের অনেকটা অংশ ভেঙেও গিয়েছে। দেয়ালে গজিয়েছে বটগাছ। উপরে ওঠার সিঁড়িগুলো ভেঙে গেছে। এইরকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়ও সেখানে বসবাস করছে বেশ কিছু পরিবার। কিন্তু, ভবনটি সংস্কারের কোন উদ্যোগ কোথাও চোখে পড়েনি না। ভবনের নিচে গড়ে উঠেছে মসলার বাজার।  রূপলাল হাউজের বর্তমান বাসিন্দারা সাধারণত বাইরের কারো সাথে যোগাযোগ করতে চায় না কিংবা আগ্রহ দেখায় না। কারনটা সহজেই অনুমেয়। এটা যতদূর সম্ভব বেদখল হয়ে আছে। সরকার নজর দিলে বাড়িটি জাদুঘর হতে পারতো।

/ডিজি