• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ৮, ২০১৯, ০৬:১৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ৮, ২০১৯, ০৬:১৮ পিএম

যেখানে দেখিবে ছাই...

যেখানে দেখিবে ছাই...

 ‘যেখানে  দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই
 পাইলেও পাইতে পার মানিক রতন।’ 
এই আপ্ত বাক্যটিকে সত্যে পরিণত করেছে মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার চারিগ্রাম ও গোবিন্দল ইউনিয়নের শত শত পরিবার। এরা সবাই ছাই থেকে সোনা বের করে জীবন যাপন করেন। সোনা থেকে ছাই , ছাই থেকে সোনা বের করা তেলের সঙ্গে জলের মিশে যাওয়ার মতোই অসম্ভব একটি ব্যাপার। অথচ এ অসম্ভব ব্যাপারটিই এরা সম্ভব করে তুলেছেন মানিকগঞ্জের কয়েকশ’ মেহনতী পরিবার। গত দেড়শ’ বছর ধরে স্বর্ণের দোকানের ছাই পুড়িয়ে সোনা বানিয়ে রুটি রুজির ব্যবস্থা করছেন তারা।

দাদার আমল থেকে সোনা  তৈরির কাজ করছে দাশারহাটি গ্রামের বদরউদ্দিন মিয়ার (৫২) পরিবার। এ ব্যবসার অবস্থা যে খুব ভালো তা নয়। তবে বৃটিশ আামল থেকে পূর্বপুরুষদের পেশার ঘানি টানছে শত শত পরিবার । আগে ছাই কিনে আনার পর স্ত্রী,ছেলে - মেয়ে সবাই বসে ছাই ধুয়ে ফেলতেন। সে দক্ষতাও তাদের আছে। কিন্তু এখন পড়াশুনা করে  তারা একাজ করতে চায় না। বাবাকেও এ পেশা ছাড়তে বলেন। তাদের নাকি  ক্লাসের বন্ধুরা এ নিয়ে বিভিন্ন রকমের কথা বলে। তাদের মান- সম্মানে এগুলো লাগে। বলতে বলতে বদরুদ্দিন মিয়া আরো জানান, ‘সাত পুরুষের পেশা, বললেই কি ছাড়া যায়?’

তিনি জানান, চারিগ্রাম ও গোবিন্দল গ্রামের ৩ হাজারের বেশি লোক এ ছাই থেকে সোনা তৈরির কাজে সরাসরি জড়িত। এ কাজ করেই এখানকার বেশির ভাগ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে।প্রশ্ন জাগতে পারে, কীভাবে? কীভাবে ছাই সোনায় পরিণত হয়। কিংবা এটি আসলেই সত্যি কি-না? এ ব্যাপারে কথা বললে তিনি বলেন, ‘সত্যি তো বটেই। তবে এজন্য বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়।’ সেটা কীভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে বদরুদ্দিন মিয়া একবারে ভেঙেই দিলেন ছাই থেকে সোনা  উদ্ধারের গোপন রহস্য।
তিনি বলেন , স্বর্ণের দোকানের পরিত্যক্ত ছাই কিনে সেগুলোকে প্রথমে পোড়ানো হয়। ছাই পুড়ে ধূলা হয়।  মিহি সেই ধূলোর সঙ্গে সোহাগা, অব্যবহৃত ব্যাটারির সিসা ও পুনট (এক ধরনের ধাতু) দিয়ে ছোট ছোট পিস (দলা)  তৈরি করা হয়।পিসগুলোকে রোদে শুকিয়ে আগুন দিয়ে গলানোর পর সেগুলোকে ঠান্ডা করে ঢেঁকিতে গুঁড়ো করা হয়। তারপর মাটিতে গর্ত করে চুন ও ধানের তুষ মিশিয়ে পোড়ানো হয়। এরপর ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে পানিতে ধুয়ে সিসা আলাদা করা হয়। এর পরের ধাপটিই শেষ ধাপ। একটি পাত্রের মধ্যে নাইট্রিক এসিড দিয়ে সিসা আলাদা করে বের করা হয় মহামূল্যবান সোনা।

  বরুদ্দিন বলেন, ‘আমরা ঢাকাসহ দেশের সব সোনার দোকান থেকে পরিত্যক্ত ছাই-মাটি কিনে আনি। এ ছাই থেকে সোনা  তৈরিকে কেন্দ্র চারিগ্রাম বাজারে একটি স্বর্ণের বাজারও গড়ে উঠেছে। বাজারে প্রায় ৩০/৩৫ টি স্বর্ণের দোকান আছে । জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের  তৈরি সোনা ওরা কিনে বিক্রি করে ।’ এক কথায় বলা যায়, আমরা ছাইকে সোনায় তৈরী করি।
বাজারে সোনার দাম তড়তড় করে বেড়ে গেলেও ইদানিং এ ব্যবসায় মন্দার হাওয়া লেগেছে।  সোনার তৈরীর কারিগর বদর“দ্দিন  বলেন, ‘কেমিক্যালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন লাভ খুব একটা হয় না। সোহাগা আর ব্যাটারির ছাইয়ের দাম বেড়ে গেছে।’ সেইসঙ্গে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো আছে পুলিশি ঝামেলাও। তিনি বলেন, ‘পুলিশ খুব ঝামেলা করে। মাল কিনে আনার সময় তারা আমাদের নানাভাবে হয়রানি করে। টাকা না দিলে মাল আটকে দেয়।’ ব্রিটিশ আমল থেকেই সোনার দোকানের ছাই থেকে সোনা বানানোর কাজ করছে এলাকাবাসী।

দেশের অর্থনীতিতে ভালো ভুমিকা রাখলেও এরা খুব একটা ভালো নেই। সরকার থেকে এরা কোনও সহযোগিতা পাচ্ছে না। উপরন্তু পুলিশ ও চাঁদাবাজরা তাদের নানাভাবে হয়রানি করে।’এ ব্যাপারে প্রশাসনের কাছে আবেদন করা হলেও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি। এ সাড়াটুকু যত তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় ততই  মঙ্গল ছাই থেকে সোনা  তৈরির কারিগরদের জন্য। কারণ তাদের খুব বেশি নয়,এসব উটকো ঝামেলা এড়িয়ে তারা এ ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি বাঁচিয়ে রাখতে চান হাজার বছর। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলার সময় বদরুদ্দিন মিয়া বলেন, ‘ঝামেলা অনেক আছে। কাজ করলে ঝামেলা থাকবেই। তারপরও সবকিছু মিলিয়ে ভালোই আছি।’