• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৯, ০৭:৩৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৯, ০৭:৪৪ পিএম

অস্ত্রের গ্রাম ‘দারা আদম খেল’

অস্ত্রের গ্রাম ‘দারা আদম খেল’

দারা আদম খেল। পাকিস্তানের একটি উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল। পাখতুন ও আফ্রিদি সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস এখানে। সেভাবে দেখতে গেলে বিশেষ কোনো দর্শনীয় কিছুই নেই দারা আদম খেল-এ। তবে অন্যভাবে এই জায়গা সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র তৈরি ও বিক্রি করাই এই পাহাড়ি গ্রামের বাসিন্দাদের মূল ব্যবসা। বিশেষত, গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলাকারীরা যে অস্ত্র ব্যবহার করেছিল, তা এখানকার কোনো অধিবাসী তৈরি করে দিয়েছিল বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে তখন বলা হয়েছিল। ফলে আমাদের দেশের গণমাধ্যমেও এই গ্রামটির নাম আলোচনায় উঠে এসেছিল।

শান্ত ও নিরিবিলি গ্রামটির মূল রাস্তার পাশে সারি বেঁধে রয়েছে সব অস্ত্রের দোকান। এসব দোকানে খুব অল্প দামেই মেলে রিভলবার, অটোমেটিক পিস্তল, শটগানসহ অত্যাধুনিক কালাশনিকভ রাইফেলও। এছাড়া অত্যাধুনিক যেকোনো অস্ত্রের নকল করা এখানকার কারিগরদের তুড়ির কাজ। এই জায়গাটি পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় অবৈধ অস্ত্র বেচাকেনার বাজার। সারা দেশের সব প্রদেশ থেকে ধাতুর টুকরো সব জমা হয় দারা আদমে। আর তারপর এখানকার কারখানায় সেই দিয়ে তৈরি হয় একে ৪৭, কালাশনিকভের মতো অত্যাধুনিক রাইফেল ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র। যার দাম অন্য সব জায়গার চেয়ে কম। এমনকি একটি স্মার্টফোন কিনতে যা খরচ হয়, তার চেয়ে কমে পাইকারি মূল্যে এখান থেকে অস্ত্র কেনা যাবে। এখানকার অস্ত্র নির্মাণে ব্যবহার হয় হাতে চালিত সাধারণ যন্ত্র। 
গ্রামটির ৭৫ ভাগেরও বেশি জনসংখ্যা অস্ত্র তৈরির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এদের প্রায় সবাই পূর্বপুরুষ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এসব কাজে নিয়োজিত, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরেই চলে আসছে।

দক্ষ কারিগরদের গ্রাম

দারা গ্রামে বর্তমানে আড়াই হাজারেরও বেশি দক্ষ কারিগর রয়েছে। তাদের নির্মিত অস্ত্রের বড় চালানই পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চলে যায়। বিশেষ করে, তালেবানসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ও গোষ্ঠীই এখানকার অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা। 
দারা আদম খেলের কারিগররা বাজারে প্রচলিত যেকোনো অস্ত্র নকল করতে ওস্তাদ। সে হোক ‘বিমানবিধ্বংসী বন্দুক’ কিংবা লুকিয়ে রাখার উপযোগী 'পেন গান'। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এখানকার এক কারিগর বলেন, ‘এমন কোনো অস্ত্র নেই, যা আমরা বানাতে পারি না। আমাদের বিমানবিধ্বংসী মিসাইল এনে দিলে আমরা তাও বানিয়ে দিতে পারব, যার থেকে আসলটার তফাত করা খুবই কঠিন।’

বলা হয়, আগে দেখেনি এমন কোনো রাইফেল দারা গ্রামের কোনো বন্দুক নির্মাতাকে দেয়া হলে ১০ দিনেই তা নকল করে ফেলবেন তিনি। আর প্রথম নকলটি বানানোর পর বাকিগুলো বানাতে প্রতিটির জন্য মাত্র তিন দিন করে সময় নেবেন কারিগররা। তবে অবশ্যই বানানো নকল অস্ত্রগুলোর কর্মদক্ষতা কোনো অংশে আসলগুলোর চেয়ে কম নয়।

শুরু হলো যেভাবে

এই গ্রামে কবে থেকে অস্ত্র বানানো শুরু হয়, তার সঠিক তথ্য কারো কাছেই নেই। তবে স্থানীয়রা জানান, ১৮৫৭ সালের দিকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী থেকে পলাতক এক সৈনিকের হাত ধরেই দারা গ্রামে অস্ত্র কারখানা স্থাপন ও বিক্রি শুরু হয়। গ্রামের আদিবাসীরা অল্প দিনেই ব্রিটিশ সেনাসদস্যের কাছ থেকে অস্ত্র বানানোর কৌশল জেনে নেন। আর অল্প দিনেই দারার আদম খেল পরিণত হয় অবৈধ অস্ত্র নির্মাণ ও বিক্রির সবচেয়ে বড় বাজারে। ১৯৭৯ সালে রাশিয়া কর্তৃক আফগানিস্তানে হামলার পর আফগানদের মধ্যে অস্ত্রের চাহিদা বেড়ে গেল। আর তখন এই গ্রামই হয়ে উঠল সুলভে উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস।

দারা আলম এক ভয়ংকর জায়গার নাম। একসময় নওয়াজ শরিফের সরকার রাস্তায় রাস্তায় নজরদারি চালালেও তা ‘নামকাওয়াস্তে’। অন্দরে অন্দরে ফুলেফেঁপে উঠছেন অস্ত্র ব্যবসায়ীরা।                                                                                 

অস্ত্রের কাঁচামাল যেভাবে আসে

১৫ বছর আগে গ্রামের কারিগররা অ্যান্টি পারসোনাল মাইনস, সাব-মেশিনগান ও ছোট আকারের কামানসহ রকেট লঞ্চার বানানো শুরু করে। আর এসব অস্ত্র বানানোর প্রযুক্তিগত সহায়তা সরকারই তাদের দিয়েছিল। ১৯৮৮ সালে রাওয়ালপিন্ডির ভারী অস্ত্রের একটি মজুদ স্থান উড়ে গেলে সেখানকার বাদ হয়ে যাওয়া অস্ত্র ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দেয়া হয়। আর সেগুলোই হাত ঘুরে দারা আদম খেলের কারিগরদের হাতে এসে পড়ে। সেই থেকে গ্রামে মাইন, সাব-মেশিনগান ও ছোট আকারের কামান তৈরি শুরু। এছাড়াও সারা দেশের সব প্রদেশ থেকে ধাতুর টুকরো সব জমা হয় দারা আদমে। আর তারপর এখানকার কারখানায় সেই দিয়ে তৈরি হয় একে ৪৭, কালাশনিকভের মতো অত্যাধুনিক রাইফেল ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র, যার দাম অন্য সব জায়গার চেয়ে কম। এমনকি একটি স্মার্টফোন কিনতে যা খরচ হয়, তার চেয়ে কমে একেবারে পাইকারি মূল্যে এখান থেকে অস্ত্র কেনা যাবে। এই দেশে স্মার্টফোনের চেয়েও কেনা সহজ একটি একে-৪৭, কালাশনিকভ রাইফেল!

এক অস্ত্র ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, বাজারে কিনতে গেলে MP5 সাব-মেশিনগানের দাম পড়বে কমপক্ষে ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু দারা আদম খেলে সেটাই আপনি পেয়ে যাবেন মাত্র ৭ হাজার টাকায়, সঙ্গে এক বছরের গ্যারান্টি। কালাশনিকভ রাইফেলের দাম এখানে ৮ হাজার টাকার মতো, যা ভালো স্মার্টফোনের চেয়েও অনেক কম দাম।

শেষ কথা

এখানে বছরের পর বছর এই অস্ত্র ব্যবসা চলছে। এর কোনো লাইসেন্স নেই, এটা অবৈধ। অথচ পাকিস্তান প্রশাসনের কেউ দেখেও দেখে না। আর সে সুযোগেই এই এলাকায় বেড়ে চলেছে জঙ্গিদের আনাগোনা। সব দেখেও চোখ বন্ধ, মুখে কুলুপ সরকারের। হবে নাই-বা কেন? দেশটার নাম যে পাকিস্তান।

ডিজি