• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৬, ২০২০, ০৬:১০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৬, ২০২০, ০৬:২২ পিএম

সন্দেহপ্রবণতা : কারণ ও প্রতিকার

সন্দেহপ্রবণতা : কারণ ও প্রতিকার

ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে চোখ আটকে গেল ড. রুবানা হকের ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে। বলছিলেন একইসাথে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর-তিক্ত, সবচেয়ে রোমান্টিক-নিরস, সুন্দর-কুৎসিত, দৃঢ় আর সবচেয়ে জটিল একটি সম্পর্ক পারিবারিক সম্পর্ক বা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কথা। এত সুন্দর করে, সহজভাবে তিনি এমন একটি জটিল এবং কঠিন বিষয় এত সহজভাবে তুলে ধরলেন যে অবাক হয়ে শুনলাম। উপলব্ধি করলাম।

এককথায় তিনি বলে গেলেন যে কিভাবে খুব জটিল সম্পর্কও সুন্দর ও সুখের হতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর আর মধুর সম্পর্ক। আথচ নিজেদের কিছু ভুলে কিংবা অসচেতনতায় অথবা অবহেলায় এই সুন্দর সম্পর্ক কতটা তিক্ত হতে পারে তা আমাদের চারপাশে দেখতে পাই। একই ছাদের নীচে বসবাস করেও তাঁরা থাকেন যোজন যোজন দূরে। দ্বন্দ্ব-কলহ লেগে থাকে সবসময় যার প্রভাব পরে সন্তানের ওপর। তাঁরা নিজেদের অজান্তেই সন্তানকে হতাশা আর অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছেন। এই সব পরিবারের সন্তানেরা পিতা-মাতার এইসব দ্বন্দ্ব-কলহ দেখতে দেখতে মানসিক ভাবে বিপর্যন্ত হয়ে পড়ছে, হতাশা আর গ্লানি তাদের করছে বিপথগামী। অথচ, একটু নিজেদের সচেতনতায়, বোঝাপড়ায় পরিবারটি হতে পারে সুখি-সুন্দর। হতে পারে অন্যান্যদের কাছে আদর্শ।

আমি বোদ্ধা নই, নই জ্ঞানী। আমি মহামুর্খদের মধ্যে একজন। তবে, মুর্খ হই আর যা-ই হই না কেন, দাম্পত্য বা পারিবারিক জীবন থেকে দূরে আছি বলেই স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের আচরণের কিছু অসামঞ্জস্যতা, কিছু ভুল, কিছু দুর্বলতা নিরপেক্ষভাবে আমার চোখে ধরা পরে- সেগুলোই তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। বলে রাখা ভালো যে আমি নারীবাদী নই, নই নারীর শত্রু। পুরুষ বিদ্বেষীও নই। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষ হচ্ছেন আমার বাবা। আমার শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি আমার পুত্র-কন্যা। কাজেই একজন কন্যা-জায়া-জননী হিসেবে নিরপেক্ষভাবে, এবং, ড. রুবানা হকের এই বক্তব্যের সূত্র ধরে-ই কিছু বলতে সাহস করছি। যাতে একটি পরিবার হয়ে ওঠে স্বর্গ। পারিবারিক সম্পদ বা সম্পত্তির কথা না, বলতে চাইছি পারিবারিক সম্পর্কের কথা। যে কোনো সম্পর্কের সবচাইতে মূল্যবান ‘ভিত’ হচ্ছে “বিশ্বাস”। যেটা যে-কোনো সম্পর্কেই অত্যন্ত জরুরি। আমার স্বল্প জ্ঞানে মনে হয় বিশ্বাস না থাকলে সেখানে সম্পর্কের অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বাস যখন থাকে না তখন দেখা দেয় ‘সন্দেহপ্রবণতা’।

হ্যাঁ, বলছিলাম সন্দেহপ্রবণতা বা সন্দেহ বাতিকগ্রস্ততার কথা। সন্দেহপ্রবণতা এমন একটি ঘুণ যা শুধু নিজেকেই ধ্বংস করে না, চারপাশের সবাইকেই এক চরম পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। এই একটি মাত্র বৈশিষ্টের উপস্থিতিতে আমরা হতে পারি চরম ঘৃণিত, আবার এই বৈশিষ্টের অনুপস্থিতিতে অথবা নিয়ন্ত্রণের কারণে আমরা সবার কাছে হতে পারি অনুকরণীয়, আদর্শ। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মাঝামাঝি যে নেতিবাচক অনুভূতি, কু-চিন্তা আমাদের অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেটাই মুলত: সন্দেহ। এই অহেতুক, অমুলক সন্দেহের কোনো নির্দিষ্ট কারণ থাকেনা। প্রতিনিয়ত আধুনিকতার নামে আমরা যান্ত্রিক আর একঘেয়ে জীবন যাপন করছি। ব্যস্ততা বৃদ্ধির সাথে সাথে হতাশা, অন্তর্দন্দ্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে সন্দেহ। আগের দিনে স্বামী অফিস থেকে ফিরে বাচ্চাদের পড়াশোনা আর স্ত্রীর সাথে গল্প করে সময় কাটাতেন, কিন্তু এখন স্বামী বাইরে থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন মোবাইলে- ফেসবুকে বা গুগলের রাজ্যে। ফলে সারাদিন অপেক্ষায় থাকা স্ত্রীর মনের হতাশাগুলো আক্ষেপে পরিণত হতে থাকে, তৈরী হয় দুরত্ব। ক্রমশ: তারা দূরে সরতে থাকেন। একই কথা স্বামীর ক্ষেত্রেও। সারাদিন অফিস থেকে ফিরে হয়ত দেখেন স্ত্রী তখন মোবাইলে - বান্ধবীদের সাথে চ্যাটিং বা ইউটিউবে রান্না শেখায় অথবা ফেসবুকে ব্যস্ত।

ফলে একটু একটু বিরক্তি, হতাশা আর ক্ষোভের সমন্বয়ে জন্মাতে থাকে সন্দেহ। এই সন্দেহ আরো মাত্রা ছাডিয়ে যায় যদি সেই স্ত্রী চাকুরিজীবি হন। অথবা বন্ধুবাৎসল হন। আমি বলছি না যে সব চাকুরিজীবি স্ত্রীদের স্বামীরাই সন্দেহপ্রবণ। ব্যতিক্রম সবক্ষেত্রে আছেই। তবে কর্মক্ষেত্রে স্বামীরা নিজেদের যেমন স্বাধীনতা আশা করেন, স্ত্রীদের ক্ষেত্রে সেটা মানতে নারাজ। কর্মক্ষেত্রে স্ত্রীর উচ্চপদস্থতাও স্বামীর হীনমন্নতার কারণ হয়। হাজারো কারণ আছে সন্দেহের কিন্তু বিশেষ দু’একটি কারণ উল্লেখ করছি নারীর প্রতি সন্দেহের: কারো সাহায্য বা সহযোগিতা ছাড়া স্বাবলম্বী হলে, সাজগোজ করলে, হাসিখুশি থাকলে, আন্তরিক বা বন্ধুবাৎসল হলে, অফিসে আন্তরিক হলে, দেরি করে বাড়িতে ফিরলে, কোনো পুরুষ কলিগ বাসায় পৌছে দিলে বা কিছুটা এগিয়ে দিলে, খোঁজ-খবর নিলে, কোনো ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান চেয়ে যোগাযোগ করলে ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো কারণ আছে। আর স্ত্রীদের স্বামীর প্রতি সন্দেহের তো কোনো শেষ নেই। আমি একজন নারী হয়েই বলছি। আসলে কথাটা এভাবে না বলে বলা উচিত দুর্ভাবনার কোনো শেষ নাই। কারণ একজন স্ত্রী যতটা গভীরভাবে ভালোবাসে স্বামীকে ততটাই আঁকড়ে ধরতে চায়। স্ত্রীর চাওয়া এবং পাওয়ার দুরত্বই সন্দেহের মূল কারণ বলে আমার মনে হয়। কখন যে কি নিয়ে সন্দেহ করে বসে তা সে নিজেও বোঝে না। অপূর্ণতা এবং অতৃপ্তিগুলোই মনে সন্দেহের বীজ ছড়ায়। ক্রমে জন্মে সন্দেহের চারাগাছ, একসময় মহীরূহে পরিণত হয় তখন তা আর স্বাভাবিক থাকে না হয়ে পরে অস্বাভাবিক আচরণ। এই অস্বাভাবিকতার মাত্রা বাড়তে বাড়তে পরিণত হয় একজন মানসিক

 

বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতে। প্রতি মুহূর্তে সন্দেহের বীজ লালন করতে করতে সে ভুলে যায় স্বাভাবিক জীবন। যার প্রভাব পরে স্বামী-সন্তান ও পরিবারের অন্যন্য সদস্যদের ওপর। সে পারে না নিজে ভালো থাকতে, পারে না অন্যদের ভলো রাখতে। ধীরে ধীরে সে আক্রান্ত হয় সিজোফ্রেনিয়ায়। সিজোফ্রেনিয়া কি? সিজোফ্রেনিয়া একটি জটিল মানসিক রোগ।সিজোফ্রেনিয়া শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দমূল Skhizein (to Split বা বিভক্ত করা) এবং phrenos (mind বা মন) থেকে। এ রোগের লক্ষণ হচ্ছে চিন্তাধারা (প্রত্যক্ষণ, চিন্তন) এবং অনুভূতি প্রকাশের মধ্যে সঙ্গতি না থাকা। এতে মনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে যায় এবং মস্তিষ্কের বিঘ্ন ঘটে। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগী সে কখনওই বুঝেই না সে অসুস্থ।এই রোগকে অনেক সময় মানসিক রোগের ক্যান্সার হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। (সূত্র: ইন্টারনেট) বিশিষ্ট মনোচিকিৎসক ডা. মোহিত কামালের মতে, “সিজোফ্রেনিয়া মূলত মস্তিষ্কের রোগ। মস্তিষ্কে সমস্যা, বংশগত কারণসহ একাধিক কারণে এই রোগ হতে পারে। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজনদের প্রতি ভ্রান্ত বিশ্বাস, অহেতুক সন্দেহপ্রবণতা (ডিল্যুশন), অবাস্তব চিন্তাভাবনা, হ্যালুসিনেশন (অলীক প্রত্যক্ষণ), অসংলগ্ন কথাবার্তা ইত্যাদি সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ। তাঁর মতে, সিজোফ্রেনিয়া রোগীরা কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, সিজোফ্রেনিয়া রোগ ও রোগী সম্পর্কে আমাদের অনেকেই জানে না। এজন্য কারও ঘরে রোগী থাকলে কেউ বুঝতে পারে না।এই রোগ সম্পর্কে আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি।” ধরণ: আমেরিকান সাইকিয়াটিক এসোসিয়েশন (এপিএ) সিজোফ্রেনিয়াকে নয়টি ভাগে বিভক্ত করেছে।এগুলো হলোঃ- ১. সরল টাইপ ২. হেবিফ্রেনিক টাইপ ৩. ক্যাটাটনিক টাইপ ৪. প্যারানয়েড টাইপ ৫. আনডিফারেনসিয়েটেড টাইপ ৬. শৈশব টাইপ ৭.সিজো-অ্যাফেকটিভ টাইপ ৮.তীব্র-মিশ্র টাইপ ৯.দীর্ঘস্থায়ী মিশ্র টাইপ (সূত্র: উইকিপিডিয়া)। লক্ষণ: সিজোফ্রেনিয়া রোগ ও রোগী সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই সীমিত। এজন্য কারও ঘরে রোগী থাকলে কেউ বুঝতে পারে না। এই রোগ সম্পর্কে আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি। মুলত: সচেতনতার অভাবে বর্তমানে এই রোগ ঘরে ঘরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কীভাবে বুঝবেন কেউ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে, জেনে নেই প্রাথমিক কিছু বিষয় বা লক্ষণ: অকারণে বা অহেতুক সন্দেহ করা, অবিশ্বাস, আবেগপ্রবণ, নিজে নিজে কথা বলা, মৃত্যভয় বা ষড়যন্ত্রের ভয়, হঠাৎ কিছু শুনতে পাওয়া, অবচেতন মনের ভয়, চিন্তাশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এসব লক্ষণ বলে দেয় একজন মানুষ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত।

নিরাময়: চিকিৎসার প্রধান মাধ্যম হল এন্টিসাইকোটিক ওষুধ, যা মূলত ডোপামিন (এবং কখনও কখনও স্টেরোটোনিন) গ্রহণ কার্যক্রমকে অবদমিত করে। সেই সাথে মনোচিকিৎসা এবং বৃত্তিমূলক ও সামাজিক পুনর্বাসনও চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বেশি গুরুতর ক্ষেত্রে, যেখানে নিজের এবং অন্যদের প্রতি ক্ষতির ঝুঁকি থাকে - সেখানে রোগীর অনিচ্ছা থাকলেও হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন হতে পারে, যদিও হাসপাতালে থাকার মেয়াদ এখন আগের থেকে কম হয় এবং হাসপাতালে যেতেও হয় আগের থেকে অনেক কম।তবুও রোগীর বিপজ্জনক কিছু করে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। এই ব্যাধি মূলত চেতনাকে আক্রান্ত করে বলে ধারণা করা হয়, কিন্তু এটা একই সাথে প্রায়শই আচরণ এবং আবেগ গত দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা বৃদ্ধি করে। (সূত্র: উইকিপিডিয়া) পরিশেষে বলতে চাই, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগী সে কখনওই বুঝেই না সে অসুস্থ।

তাই এক্ষেত্রে পরিবারের সচেতন হওয়া প্রয়োজন সবার আগে। লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করে তার প্রতি অবহেলা নয় বরং পরিবারের সদস্যদের সহযোগীতায় এবং আন্তরিকতায় সে আবার সুস্থ জীবন যাপন করতে পারবে। ফিরে আসি ড. রুবানা হকের বক্তব্যে। তিনি বলছিলেন- স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কথা, পারস্পরিক বোঝাপরার কথা, আন্তরিকতার কথা। নিজেদের প্রতি বিশ্বাস, পারস্পরিক শ্রদ্ধা প্রদর্শণ, সহনশীল আচরণ আর বোঝাপড়ার মাধ্যমে খুব জটিল সম্পর্কও খুব সহজ ও সুন্দর হতে পারে। প্রতিটি ঘর, প্রতিটি পরিবারই সন্দেহমুক্ত হোক। হোক সুখের। সবার জন্য শুভ কামনা।

 লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও কলাম লেখক