• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩০, ২০১৯, ০৯:১৯ পিএম

ঠাকুরগাঁওয়ের ছোট বালিয়া জামে মসজিদ স্থাপত্যশৈলীর এক নিদর্শন

ঠাকুরগাঁওয়ের ছোট বালিয়া জামে মসজিদ স্থাপত্যশৈলীর এক নিদর্শন

 

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ছোট বালিয়া জামে মসজিদ স্থাপত্য শৈলীর এক বিরল নিদর্শন। দীর্ঘদিন পড়ে থাকার পর  স্থানীয়রা মসজিদটি ব্যবহার উপযোগী করে সংস্কার করেছেন। ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ছোট বালিয়া গ্রামে মসজিদটি অবস্থিত।

এ মসজিদ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে নানা মতামত রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো কোনো এক অমাবস্যার রাতে জ্বীনেরা এই এলাকার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এলাকাটি পছন্দ করে । তারপর তারা মাটিতে নেমে এসে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করে।

কিন্তু গম্বুজ তৈরির আগেই ভোর হয়ে যাওয়ায় কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে যায়। ফলে গম্বুজ ছাড়া এ অসাধারণ কারুকার্যময় মসজিদটি তৈরি হয়। মসজিদটি নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের এমনই ভাষ্য। তবে ছাদ ও গম্বুজ ছাড়া মসজিদটি ১০০ বছর দাঁড়িয়ে থাকার পর তার পূর্ণতা পায় স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতেই।

আবার আরেকটি মত হলো- স্থানীয় জমিদার গুলমতি চৌধুরানী এ মসজিদের নির্মাতা। তার স্বামীর নাম মেহের বকস। অনেকের মতে, তিনিই এ মসজিদ নির্মাণ শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন তথ্য মিলিয়ে মসজিদটির সম্ভাব্য বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৮ বছর। মসজিদের গায়ে খোদাই করা তারিখ অনুসারে এটি তৈরি হয় ১৩১৭ বঙ্গাব্দে।

জমিদার মেহের বকস চৌধুরী উনবিংশ শতাব্দী শেষ ভাগে বালিয়াতে এক মসজিদ তৈরির পরিকল্পনা করেন । এ জন্য দিল্লি আগ্রা মতান্তরে মুর্শিদাবাদ থেকে স্থাপত্য শিল্পীদের আনা হয় । মুঘল স্থাপত্যের রীতি অনুযায়ী এ মসজিদ তৈরির কাজ ছিল অনেক জটিল ও সময় সাপেক্ষ । এর প্রধান স্থাপত্য শিল্পীর  মৃত্যু হলে এর নির্মাণের কাজ কিছুদিনের জন্য থেমে যায় ।

মেহের বকস স্থানীয় কারিগরদের সহায়তায় পুনরায়  এর কাজ শুরু করেন। কিন্তু স্থানীয়রা এর গম্বুজ নির্মাণে ব্যর্থ হন । ১৯১০ সালে মেহের বকস চৌধুরী মারা যান। মেহের বকসের মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই মসজিদটি নির্মাণের আবারও উদ্যোগ নেন। কিন্তু  নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগে তিনিও মারা যান। ফলে প্রায় ১০০ বছর গম্বুজ ছাড়াই মসজিদটি দাঁড়িয়ে থাকে।

এক পর্যায়ে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা মসজিদটি ধ্বংস হতে শুরু করে। দেয়ালে জন্ম নেয় বিভিন্ন গাছপালা ও শৈবাল। মসজিদে ফাটলও দেখা দেয়। অবশেষে মেহের বকস চৌধুরীর প্রোপৌত্রি তসরিফা খাতুনের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউটের কারিগরি সহায়তায় ২০১০ সালে বালিয়া মসজিদের সংস্কার কাজ শুরু হয় ।

একই সঙ্গে আর্কিটেক্ট সৈয়দ আবু সুফিয়ানের নকশায় নতুন ভাবে গম্বুজ নির্মাণ করা হয় । গাছ, শৈবাল, ছত্রাক, ধুলোয় ঢাকা ভবনটির বিভিন্ন অংশের যথাযথ নথিভুক্তির জন্য আংশিকভাবে ‘শুষ্ক পরিষ্করণ’ (ড্রাই ক্লিনিং) করা হয়। দেয়ালের ফাটল ও গর্তগুলো পূর্ণ করার জন্য ব্যবহার করা হয় ফ্লুরো সিলিকেট-জাতীয় অজৈব লবণ।

এ পদ্ধতি প্রয়োগের আগে দেয়াল ও ভিত্তিতে ঢুকে যাওয়া শিকড় সরানোর জন্য সালফিউরিক এসিড প্রয়োগ করা হয়। সেই সঙ্গে সাধারণ পানি, ফুটন্ত পানি, হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও পেন্টা ক্লোরো ফেনল ব্যবহার করে ভবনের দেয়ালে জমে থাকা ধুলো, শ্যাওলা, ছত্রাক, লবণ অপসারণ করা হয়। ছয় মাস কাজ করার পর শেষ হয় প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর নির্মাণ কাজ।

২০১০ সাল থেকে এ মসজিদে মুসল্লিরা নামাজ আদায় শুরু করেন। তবে মসজিদটির মূল নকশার কাজ এখনো অসমাপ্ত রয়েছে।  সমতল ভূমি থেকে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উঁচু প্লাটফর্মের ওপর পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি ও উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আয়তাকার কমপ্লেক্স মসজিদটি অবস্থিত । আয়তাকার কমপ্লেক্স সিঁড়িসহ প্রবেশপথ, খোলা চত্বর ও মূলভবন বা নামাজ ঘর এই তিন অংশে বিভক্ত ।

এর মধ্যে মূল ভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্ত । প্লাটফর্ম হতে মসজিদটির ছাদ ১৭ ফুট উঁচু । মসজিদের ছাদে একই সাইজের তিনটি গম্বুজ ও আটটি মিনার রয়েছে। যার মধ্যে চার কোণের চারটি মিনার বড় এবং বাকী চারটি ছোট ।
 
ভিত্তিসহ পুরো মসজিদটি চুন-সুরকির মর্টার এবং হাতে পোড়ানো ইট দিয়ে তৈরি। ইটে কোনো অলঙ্করণ না থাকলেও মসজিদের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে ইট কেটে কলস, ঘণ্টা, ডিশ, বাটি, আমলকি,পদ্ম ইত্যাদি নকশা তৈরি করা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও চারুকলার শিল্পী কামরুজ্জামান চৌধুরী জানান, মসজিদটির রং ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির আরও কাজ করা হবে। মসজিদটির ছাদের চারপাশে নির্মাণ করা হবে সুদৃশ্য চারটি মিনার। কাজ সম্পন্ন হলে তখন এর সৌন্দর্য হবে নয়নাভিরাম।

মসজিদ নির্মাণ কমিটির সভাপতি আনছারুল হক চৌধুরী জানান, মসজিদ পুননির্মাণের খরচ গ্রামবাসীসহ এলাকার মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

এসসি/বিএস