• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০২০, ০১:৪৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১৫, ২০২০, ০১:৪৬ পিএম

ফেসবুক থেকে

গড়াইপারের গেরিলাদের কথা

গড়াইপারের গেরিলাদের কথা

আমরা ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর রণাঙ্গণের ৮ নম্বর সেক্টরে মিত্রবাহিনীর সাথে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনির বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে ছিলাম। এই দিনেই আমাদের নিশ্চিন্তপুর গ্রামের সহযোদ্ধা, যুদ্ধরত মিত্রবাহিনীর অ্যম্ফিবিয়ান ট্যাংকের গাইড, আর্টিলারির মো: খলিলুর রহমান পাকিস্তানি বাহিনীর মর্টারের আঘাতে শহীদ হন। এলাকাবাসী নিশ্চিন্তপুর ও ডুমাইনের ১০ ও ১৪ই ডিসেম্বরের সমুখ সমরের শহীদ খলিল, শহীদ মফিজ ও শহীদ হাফিজের কথা স্মরণ করছে কি?

১৪ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনির উভচর ট্যাংক গড়াই নদীর পানিতে নামে মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার গঙ্গারামপুুর ঘাট দিয়ে। ট্যাংক পানিতে নামার জন্য গ্রামবাসী কোদাল দিয়ে পাড়ের মাটি কেটে ঢালু পথ তৈরি করে দিয়েছিল। ট্যাংক ডাঙায় ওঠে ফরিদপুর জেলার বালিয়াকান্দি থানার পোটরা গ্রামের চর দিয়ে, অতঃপর ডুমাইনে অবস্থানরত পাকবাহিনীর লক্ষ্যপানে ধাবিত হয়। পেছনে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ভারতীয় বাহিনীর পদাতিক সৈনিকেরা। সামনে গেরিলা যোদ্ধারা, তারা সবাই এই এলাকার, তারা সবাই পথপ্রদর্শক।

সময় তখন বিকেল পাঁচটা, সম্মিলিত মিত্রবাহিনী সমাধিনগর পার হয়ে জাননগর বটতলা এসে থামে কিছুক্ষণের জন্য। ওখানে দুটি তালগাছ ছিল। খলিল ভাই ট্যাংক থেকে কোন কাজে নেমেছিলেন, নামা মাত্রই একটা মর্টারের গোলা তার মাথার খুলি উড়িয়ে নিয়ে যায়। মর্টার ছোড়া হয়েছিল ডুমাইনের মোকাদ্দেস শেখের বিল্ডিংয়ের ছাদে বসানো পাকিস্তানি বাহিনির রকেট লাঞ্চার থেকে। আমাদের রণাঙ্গণে এটাই ছিল পাকিস্তানি বাহিনির শেষ মর্টার শেলিং।

ঢাকায় যখন একই দিনে পকিস্তানি হানাদার ও তাদের আলবদর দোসররা বুদ্ধিজীবী নিধনে মত্ত, মরণ কামড় হেনেছে তারা, ঠিক তখনই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের প্রাক্কালে আমাদের এলাকার যুদ্ধ ছিল রক্তক্ষয়ী ও ভয়াবহ।

মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে ১৪ই ডিসেম্বরে শহীদ খলিল ও ১০ই ডিসেম্বরে শহীদ মফিজ ও শহীদ হাফিজারকে কতোখানি মনে রেখেছি আমরা?

শহীদ বুদ্ধজীবীরাই কতোখানি আছেন আমাদের স্মৃতিতে, মননে?

***

মাহবুবুর রহমান মজনু, আমার গুরুজন, সম্পর্কে মামা। তিনি বলেছেন এই এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার জন্য। আমি তাঁকে বলেছি চেষ্টা করছি মামা, কতোদূর পারবো জানি না। তিনি বলেছেন, ১৭ই ডিসেম্বর আমাদের বাড়িতে তিনি পাকবাহিনির রন্ধনশালার চিহ্ন দেখেছেন।

সেই নৃশংস দিনের কথা আমার মনে আছে। ০৯ ডিসেম্বর ডুমাইন ইউনিয়নের উপকণ্ঠে গড়িয়াদহে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকবাহিনীর খণ্ডযুদ্ধের পরই এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে, প্রাণ বাঁচাতে শিশু, নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ নির্বিশেষে মানুষ ঘরবাড়ি ফেলে পালিয়ে যায়। হানাদার পাক বাহিনী সমস্ত গ্রাম দখল করে নেয়।

আমাদের পরিবার জীবন বাঁচাতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে, গড়াই নদী পার হয়ে, প্রথমে শ্রীপুর থানার নাকোল গ্রামে আমার চাচাতো ভাইয়ের শ্বশুর, সাধু মিঞার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তারপর পাকিস্তানি বাহিনীর শেলিংয়ের শব্দ বেড়ে গেলে, আরও দশ মাইল ভেতরে, শ্রীপুরের পার্শ্ববর্তী খামারপাড়া গ্রামে, আমার বড়ফুপুর বাড়িতে চলে যায় সবাই। মিত্রবাহিনীর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনী পরাজিত হয়। তারপর ১৭ ডিসেম্বর সবাই আবার ফিরে আসে গ্রামে।

তখন গ্রামের উপকণ্ঠে ট্যাংকের চাকার দাগ, নদী তীরবর্তী রাস্তার দুপাশে কাঁকড়ার মতো বসানো স্থলমাইনের মৃত্যুফাঁদ। গ্রামের প্রান্ত পর্যন্ত গাছগাছালি মাটিতে মিশে গেছে। ট্যাংক চলার পথ এসে থেমেছে সেখানে, পড়েছিল দীর্ঘকাল, কোথাও কোথাও বছর খানেক পর্যন্ত।

১৪ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর ফেলা ৩টি বোমার দুটোতে একটি বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে সেখানে কৃত্রিম পুকুরে পরিণত হয়েছে। বোমার আঘাতে কামারখালি ফেরির খালাসি, ডুমাইন গ্রামের ভানু মোল্লার বাড়ির মাটি উঠে পাশের দোতলা টিনের ঘর সম্পূর্ণ মাটিচাপা পড়ে গেছে, ওই ঘরের মধ্যে ভানু মোল্লাও ছিলেন। পরে গ্রামবাসী তাকে ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে উদ্ধার করে। পুকুর ভরাট করে সেখানেই আবার ভানু মোল্লার বাড়ি পুনঃনির্মাণ হয়।

জেলে পাড়ায় অন্য একটি বোমার আঘাতে আরেকটি পুকুর হয়েছিল, এখনকার ডুমাইন ইউনিয়ন কাউন্সিল কার্যালয়ের কাছে রাস্তার মাঝখানে, সেই পুকুর এখনও আছে। জেলে পাড়ার এই পুকুরটিই হলো আমাদের এলাকার মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র অক্ষত স্মৃতি। আর সব কিছু বিস্মৃতির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। বুঝে হোক অথবা না বুঝে, এই পুকুরটি আর ভরাট করা হয়নি, রাস্তাটিই পুকুরের পার দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে।

মিত্র বাহিনীর মিগ বিমান থেকে ফেলা তৃতীয় বোমাটি পড়েছিল কামারখালির চরে, কামারখালি বাজার থেকে বর্তমানের টোল অফিসের অবস্থান পর্যন্ত সুড়ঙ্গ করে পাকিস্তানিদের তৈরি করা এক মাইল দীর্ঘ পাকা বাংকারের একেবারে কাছেই। কিন্তু চরের বালুতে পড়ায় ওটা আর বিস্ফোরিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও কয়েক টন ওজনের বোমাটি ওখানেই পড়েছিল কয়েক বছর।

সবার বাড়িঘরই তখন পুরোপুরি অথবা আংশিক বিধ্বস্ত। বাড়িতে ফিরে দেখলাম, আমাদের ঘরের মেঝেতে পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত বাংকার। মাটি খুঁড়ে ওরা আমাদের উঠোনে রান্নার চুলা বানিয়েছিল। তরকারির খোসা, ভাঙা বাসন কোসন, প্লেটে বাড়া খাবার, আটা, মুরগির কাটা মাথা, রক্ত, ছেড়া কাপড় চোপর পড়ে আছে সারা বাড়িতে।