• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৩১, ২০১৯, ০৯:৪৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৩, ২০১৯, ০৮:৩৪ পিএম

বিএসএমএমইউতে আলোর মুখ দেখেনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস

বিএসএমএমইউতে আলোর মুখ দেখেনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস

২১ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অভ্যন্তরে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু আলোর মুখ দেখছে না।

অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক মানসিকতার অধিকারী ও প্রভাবশালী চিকিৎসকদের কাছে ১৯৯৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বারবার হার মেনেছে বিএসএমএমইউ-এর নয়জন ভিসি। পেশাগতভাবে এসব চিকিৎসকরা আবার নামজাদা এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীও বটে। তারা ঢাকার নামি-দামি, ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস, টেস্ট-অপারেশন বাণিজ্য করে বিপুল অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর প্রাইভেট প্র্যাকটিসকে বিএসএমএমইউ-এর ভাষায় বলা হয় ‘ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস’। যার সময় হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত অফিস সময় শেষে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও কিছু সিনিয়র চিকিৎসকদের মতে, ‘ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস’ চালু হলে যেমন উচ্চমূল্যে বেসরকারি হাসপাতালে রোগীকে যেতে হবে না, তেমনি অযাচিত পরীক্ষা-নীরিক্ষাসহ চিকিৎসা ব্যয় থেকে মুক্তি মিলবে। তেমনি চিকিৎসক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় সৎপথেই বাড়বে। শিক্ষার্থীরাও উপকৃত হবেন।

ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালু করতে বিএসএমএমইউ-এর বর্তমান উপাচার্য ও বিশিষ্ট নিউরো সার্জন অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া সম্প্রতি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এ নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। যার সভাপতি অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। গত কয়েক মাসে কমিটি তিনবারেরও বেশি বৈঠকে বসেছেন। কিন্তু ওই অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক মানসিকতার অধিকারী ও প্রভাবশালী চিকিৎসকদের বাধার মুখে পড়েছে এবারের উদ্যোগও।

এসব বৈঠকে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন চিকিৎসক জাগরণকে জানান, যেসব চিকিৎসক সৎ ও আন্তরিকভাবে সেবার বিনিময়ে জীবন-ধারণ করতে চান, তারা সমস্যা করছেন না। এসব চিকিৎসকদের বেশিরভাগ নিম্ন-মধ্য সারির। উচ্চসারিরও কিছু আছেন। কিন্তু যেসব উচ্চসারির চিকিৎসক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোটা দাগের বেতনসহ অন্যান্য সুবিধা ভোগ করেন। আবার বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে মোটা দাগের ভিজিট নিয়ে অযাচিত টেস্ট-অপারেশন করিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আর্থিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেন। সেখান থেকে তারা মাসে মাসে মোটা অঙ্কের অর্থ কামিয়ে নিচ্ছেন।  নানা অজুহাত উপস্থাপন করে তারা ইনস্টিটিশনাল প্র্যাকটিসকে অন্ধকারে ঠেলছেন। এমন চক্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি অধ্যাপক এমএ কাদেরীর আমলেও স্বক্রিয় ছিল, এখনও আছে।

অধ্যাপক এমএ কাদেরী প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালুর বিষয়ে। তিনি সুবিধা করতে পারেননি। পরবর্তীতে প্রত্যেক ভিসি-ই কমবেশি চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।  অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্তও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। 

চিকিৎসকরা জানান, বিগত ভিসি অধ্যাপক কামরুল হাসান খানকে ভিসি হিসেবে নিয়োগের অন্যতম শর্ত ছিল এই ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালু করা। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

উদাহরণ দিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থোপেডিক্স বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক বলেন, বেসরকারি হাসপাতাল বা প্রাইভেট চেম্বারে যে চিকিৎসক রোগী প্রতি ভিজিট নেন ১ হাজার টাকা, সে চিকিৎসক ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের আওতায় আসলে রোগী প্রতি ১ হাজার টাকা করে নিতে পারবেন না। তাছাড়া বেশকিছু  চিকিৎসক আছেন, যারা ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের আওতায় আসলে রোগীদের অযাচিত টেস্ট-অপারেশনও করতে পারবেন না। এই চিকিৎসকরা বেসরকারি হাসপাতালে প্র্যাকটিস করে অযাচিত টেস্ট-অপারেশন দিয়ে প্রতিমাসে মোটা দাগের অর্থ হাতাচ্ছেন। যার কোনো হিসাব-কিতাব নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের একজন অধ্যাপক জাগরণকে জানান, টেস্ট-অপারেশনের কথা বাদ দিলাম। বাইরে ১ হাজার টাকা ভিজিট নিয়ে কেউ যদি দৈনিক রোগী দেখেন ৩০জন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের আওতায় আসলে সেই চিকিৎসককে রোগী আরও বেশি দেখতে হবে সেই পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে। এ জন্য হয়তো এক শ্রেণীর চিকিৎসক পদ্ধতিটির বিরোধিতা করছেন।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বশীল একটি সূত্রের ভাষ্যমতে, কোনো চিকিৎসককেই বলা হচ্ছে না যে, বাধ্যতামূলক ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের আওতায় আসতে হবে। তারপরও কিছু প্রভাবশালী চিকিৎসক এর জোরালো বিরোধিতা করেই যাচ্ছেন। তারা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এটা চালু হলে তো চিকিৎসক, রোগী, বিশ্ববিদ্যালয়- সবারই উপকার। প্রতিদিন চিকিৎসকরা যা আয় করবেন, তার ছোট্ট একটি অংশ আসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে। যে মানের চিকিৎসক রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালে দেখান হাজার টাকায়, সে মানের চিকিৎসক এখানে পাবেন তার অর্ধেক বা আরও কম খরচে। একইভাবে টেস্ট, অপারেশনসহ সবকিছু নিতে পারবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। যা বাইরের হাসপাতাল থেকে করিয়ে খরচ বেশি যাচ্ছে দ্বিগুণ থেকে ক্ষেত্র বিশেষ ৮-১০গুণ।

সূত্রটি আরও বলছে, যদি চিকিৎসক মনে করেন তিনি ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস শেষে বাইরে রোগী দেখবেন, অপারেশন করবেন সেটাও পারবেন।

তার ধারণা, ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালু হলে সাধারণ মানুষ যখন কম খরচে এখান থেকে সেবা পাওয়া শুরু করবেন, তার প্রভাবে বেসরকারি হাসপাতালে রোগী কমে যাবে। সম্ভাব্য এই ক্ষতি এড়াতে প্রভাবশালী বেসরকারি হাসপাতালগুলো ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস বিরোধী চিকিৎসকদের লেলিয়ে দিয়ে থাকতে পারে। কেননা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকদের ব্যবহার করেই বেশকিছু বেসরকারি হাসপাতাল মোটা দাগের অর্থ উপার্জন করছে মাসে মাসে। এসব বেসরকারি হাসপাতালের নিজস্ব চিকিৎসক নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক জাগরণকে বলেন, এটা হলে তো শিক্ষার্থীরাও ভীষণ উপকৃত হবেন। তারা দেখবেন- কীভাবে তার শিক্ষক কোন রোগীকে কী চিকিৎসা দিচ্ছেন, কেন দিচ্ছেন, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় কোনো বিচ্যুতি ঘটছে কি-না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এরকম শিক্ষা-ব্যবস্থার পরিধি যা আছে, তা আরও বাড়বে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরও উপকার হবে।

ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস নিয়ে বিএসএমএমইউ-এর ভিসি অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া এখনই বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি নন। রোববার (৩১ মার্চ) তিনি জাগরণকে বলেন, খুব চেষ্টা করছি ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালু করার জন্যে। এটা বাস্তবায়ন হোক, পরে আমরা আপনাদের সাংবাদিকদের নিয়ে বসব, সব জানাব।

আরএম/এসএমএম