• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ২৯, ২০১৯, ০৬:০১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ২৯, ২০১৯, ০৬:০১ পিএম

হাঙ্গেরি থেকে আসছে জুলাইয়ে

রাবেয়া-রোকেয়ার জোড়া ব্রেন আলাদা করা হবে বাংলাদেশেই

রাবেয়া-রোকেয়ার জোড়া ব্রেন আলাদা করা হবে বাংলাদেশেই
জোড়া মস্তিষ্কের (ব্রেন) শিশু রাবেয়া-রোকেয়া

জোড়া মস্তিষ্কের (ব্রেন) শিশু রাবেয়া-রোকেয়ার চূড়ান্ত অপারেশন বাংলাদেশেই করা হবে। এই অপারেশনের মাধ্যমে তাদের আলাদা করা হবে।

রাবেয়া-রোকেয়ার চিকিৎসায় সমন্বয়কারী ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ডা. সামন্ত লাল সেন বুধবার (২৯ মে) বিকালে দৈনিক জাগরণকে বলেন, জুলাই মাসে তারা দেশে ফিরবে। এরপর অপারেশন করা হবে। আমরা ভাবছি ঢাকা সিএমএইচে অপারেশন করার। এটা এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি।

গত ৪ জানুয়ারি থেকে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে অবস্থিত সেইন্ট জোন্স হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ ও মিলিটারি হাসপাতালে সপরিবারে অবস্থান করছে ৩৪ মাস বয়সী রাবেয়া-রোকেয়া। চূড়ান্ত অপারেশনের আগের ধাপ মস্তিষ্কের চামড়া বাড়ানোর অপারেশন গত ৭ ফেব্রুয়ারি সফল হয়েছে হাঙ্গেরির হাসপাতালে। তাছাড়া আরও কিছু ধাপ সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়। হাঙ্গেরিতে তাদের চিকিৎসায় যুক্ত আছেন- হাঙ্গেরির ইন্টারভেনশন নিউরোলজিস্ট ইস্তাভান হুদাক, নিউরোসার্জন অ্যান্ড্রু চকে ও আন্দ্রেস কোকাই।

এক প্রশ্নের জবাবে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, হাঙ্গেরিতে চূড়ান্ত অপারেশন করার কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছিল- হাঙ্গেরিতে আপাতত চিকিৎসা চলবে। করণীয় বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের একজন সিনিয়র চিকিৎসক দৈনিক জাগরণকে জানান, পৃথিবীতে নজির নেই জোড়া মস্তিষ্ক বা ব্রেনের কাউকে আলাদা করার পর বেঁচে আছে। অনেকে ভাবছেন এটা জোড়া মাথা। তা সম্পূর্ণ ভুল। রাবেয়া-রোকেয়ার ব্রেন বা মস্তিষ্ক সংযুক্ত, খুলির সংযুক্ততা তো আছেই। শুধু খুলির সংযুক্ততা হলে চিকিৎসায় সফল হওয়া অনেক সহজ ছিল। এই ঝুঁকি বিদেশি চিকিৎসকরা নেন না। এতে তারা কোনো বিনিয়োগও করেন না। অপারেশনে সফলতার হার যদি ৮০ ভাগ হতো, তাহলে ঠিকই রাবেয়া-রোকেয়ার অপারেশন হাঙ্গেরিতেই করা হতো। 

তিনি আরও বলেন, এখন দেখা গেল, হাঙ্গেরিতে অপারেশন করার পর তারা মৃত্যুবরণ করল, তখন তাদের দেশে আনতে আইনি জটিলতা আছে। তাছাড়া হাঙ্গেরির একটি হাসপাতালে এমন রোগীর মৃত্যুতে সেদেশের প্রচলিত আইনের মুখোমুখিও হতে পারেন বিদেশি চিকিৎসকরা। অন্যদিকে, হাঙ্গেরিতে এই অপারেশন অত্যন্ত ব্যয়বহুল, আনুমানিক ২০ কোটি টাকার মতো। এত টাকা কে দেবেন? তাদের চিকিৎসা চলছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায়। তিনি দিলে সেটা ভিন্ন। যদি না দেন, তাহলে তো বিদেশিরা হাঙ্গেরিতে রেখে তাদের অপারেশন করবেন না। যদি সফলতার হার ৮০ ভাগ হতো, তাহলে প্রধানমন্ত্রী না দিলেও বিদেশিরাই দিতো, তাদের স্বার্থেই। কেননা, পরবর্তীতে তারা রাবেয়া-রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণা করত।

গত ৪ জানুয়ারি তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম রাবেয়া-রোকেয়ার মা-বাবার হাতে হাঙ্গেরি যাওয়ার টিকিট তুলে দেন। সেদিন রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে হাঙ্গেরির উদ্দেশে রওনা দেয় রাবেয়া-রোকেয়া, তাদের ৬ বছরের বোন রাফিয়া, বাবা রফিকুল ইসলাম ও মা তাসলিমা খাতুন।

ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, এই অপারেশন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে বিদেশি চিকিৎসকরাও নতুন, আমরাও নতুন।

ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের একজন সিনিয়র চিকিৎসক বলেন, ব্রেন ও খুলি আলাদা করার পর তারা যদিও বেঁচে থাকে, তাহলে শারীরিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যাবে। জিনিসটা তো ব্রেন। আলাদা করার সময় একটা না একটা অঘটন ঘটার আশঙ্কা থেকে যায়। যেমন- প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া, মূত্রনালীর সমস্যা সৃষ্টিসহ নানা ভয় আছে। পরবর্তীতে এটা ভাল করা অত্যন্ত দুরূহ। আমি ভয় পাচ্ছি এ বিষয়টা নিয়ে। যদি মারা যায় সেটা এক বিষয়। কিন্তু যদি কোনো সমস্যা নিয়ে বেঁচে থাকে, সেটা হবে ভয়াবহ কষ্টের।

রাবেয়া-রোকেয়া হাঙ্গেরিতে যাওয়ার পর লন্ডনের অনলাইন মিরর সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, রাবেয়া-রোকেয়াকে দেখাশোনা করছে হাঙ্গেরির টিম অ্যাকশন ফর ডিফেন্সলেস পিপল ফাউন্ডেশন। একশন ফর ডিফেন্সলেস পিপল ফাউন্ডেশনের একজন মুখপাত্র বলেছেন, তিন দফায় অপারেশন করা হবে। প্রথম দফায় এই যমজের ব্রেনের রক্ত সংবহন ব্যবস্থা আলাদা করা হবে। এ কাজটি করবেন নিউরোসার্জন ডা. ইস্তভান হুদাক। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্লাস্টিক সার্জারি ও নিউরোসার্জারি বিভাগে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ও আগস্টে এমন পদ্ধতিতে দুটি সফল অপারেশন করেছেন। এখন এই জমজ জোড়া বোনকে হাঙ্গেরিতে নেয়া হয়েছে গুরুত্ব বিবেচনা করে। তাদের অপারেশন করা হবে অত্যাধুনিক, কার্যকর যন্ত্রপাতি ও ডিভাইস ব্যবহার করে। চূড়ান্ত দফায় ব্রেন ও মাথার খুলি আলাদা করবেন নিউরোসার্জন ডা. আন্দ্রাস কোকাই। 

প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে রাবেয়া-রোকেয়ার প্রথম অপারেশন সম্পন্ন করেন চিকিৎসকরা। এ অপারেশনের মাধ্যমে নতুন একটি রক্তনালী সৃষ্টি করা হয়। অপারেশনের আগে একটি মাত্র রক্তনালী দিয়ে দুই মস্তিষ্ক বা ব্রেনে রক্ত পরিসঞ্চালন হতো। তাদের পূর্ণ সুস্থ করতে দুটি রক্তনালী অপরিহার্য ছিল।

দ্বিতীয় অপারেশন সম্পন্ন হয় ২০১৮ সালের আগস্টে। এ সময় প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে তাদের মাথায় বেলুন পরানো হয়। যার মাধ্যমে চামড়া বৃদ্ধি পায়। চূড়ান্ত অপারেশনের এটি একটি অন্যতম ধাপ ছিল। এই অপারেশনের জন্য ৩০ লাখ টাকারও বেশি ব্যয়ে চিকিৎসা-যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে কিনে আনা হয়।

হাঙ্গেরি ও জার্মানির চিকিৎসকদের নেতৃত্বে এই দুটি অপারেশন সম্পন্ন হয়।

২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তির পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে রাবেয়া-রোকেয়ার চিকিৎসা করা হচ্ছে। তাদের মা-বাবা চাটমোহর উপজেলার আটলংকা গ্রামের স্কুল শিক্ষক রফিকুল ইসলাম ও তাসলিমা খাতুন।

২০১৬ সালের ১৬ জুলাই পাবনা সদরের একটি হাসপাতালে সিজারের মাধ্যমে রাবেয়া-রোকেয়ার জন্ম। তাদের বয়স যখন ৫ দিন, তখন থেকে চিকিৎসার জন্য ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা হয়। সেখানেও তাদের চিকিৎসা দেয়া হয়।

আরএম/ এফসি