• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০১৯, ০৫:৩৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২৭, ২০১৯, ০৫:৩৬ পিএম

নিজের মশা নিজে মারুন!

নিজের মশা নিজে মারুন!

মানুষ হিসেবে আমাদের সীমাবদ্ধতা হলো, আমরা মাঝে মাঝে খুবই ছোটোখাটো কীটপতঙ্গের কাছে অসহায় হয়ে যাই। বিশাল আকৃতির বাঘ-সিংহ-হাতিকে মানুষ বশ করে, সার্কাসের দলে প্রশিক্ষণ দিয়ে নানা কসরত্ ও অভিনয় করিয়ে নেয়। অথচ সামান্য মশার সঙ্গে পেরে ওঠে না। বর্তমানে এই মশা-ই মানুষের প্রাণকে ব্যাপকভাবে ওষ্ঠাগত করে তুলছে। অনেক ক্ষেত্রে জীবনসংহারের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আসলে মশাকে খুব সামান্য পতঙ্গ মনে হলেও, জীবাণু সংক্রমণকারী এই মশাই পৃথিবীতে সবচেয়ে জীবনঘাতী পতঙ্গ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০ লাখ লোক প্রতিবছর ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ভাবা যায়? পৃথিবীতে ৩ হাজার ৫০০ প্রজাতির মশা উড়ে বেড়াচ্ছে। এইসব মশার শতকরা মাত্র ৬ ভাগ হলো স্ত্রী-মশা এবং এরাই মানুষকে কামড়ায়—মানুষের রক্ত খায়। এই ছয় ভাগের অর্ধেক অর্থাৎ মাত্র তিন পার্সেন্ট মশা মানুষের শরীরে রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঘটায়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই তিন ভাগ মশা মেরে সাফ করতে পারলে লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে! বিজ্ঞানীরা তো বলেই খালাস, কিন্তু মশাটা মারবে কে? আমরা আড্ডা মারি, মানুষ মারি, কিন্তু মশা মারি না! কারণ মারতে পারি না!

মশা অতিক্ষুদ্র হলেও অতি ক্ষমতাধর। এর মতো বিরক্তিকর পতঙ্গ খুব কমই আছে। গ্রামাঞ্চলে একটি প্রবাদ আছে ‘ সতিনের কথা সয় না গায়, মশার কামড় সয় না পায়।’ মশা সুযোগ পেলেই সর্বপ্রথম পা কামড়িয়ে দেয় বা হুল ফুটিয়ে রক্ত চুষে পেট মোটা করে। এর কোনো লজ্জা-শরম নেই, বোধ-বুদ্ধি নেই। মশা এমনই বেপরোয়া প্রাণী যে কিছুতেই তাদের নিরস্ত করা যায় না। ভয় নেই, ডর নেই, ধনী-গরিব বোধ নেই, মানুষের সুখ-দুঃখ এমনকি ভাষাও বোঝে না। বোঝার চেষ্টাও করে না। শোষক শ্রেণির মতো এই পতঙ্গটি কেবল রক্ত চায়, তাজা রক্ত। অধিকাংশ প্রজাতির স্ত্রী-মশা স্তন্যপায়ী প্রাণীর রক্ত পান করে থাকে। যেসব প্রাণীর শরীর থেকে রক্ত শুষে নেয় তা তাদের শরীরের তুলনায় খুবই অল্প, কিন্তু কিছু মশা রোগজীবাণু সংক্রামক। মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, পীতজ্বর, জিকা ভাইরাস প্রভৃতি রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে।

ক্ষমতাবানদের আয়ের উৎস যেমন বোঝা যায় না, মশার আক্রমণও টের পাওয়া যায় না। এরা মানুষের জীবনে প্রেম আসার মতো নীরবে আসে। মশা কামড়ালেও আমরা সহজে মারতে পারি না। কেন? কারণ, সে প্রথমেই ত্বকের নির্দিষ্ট অংশ অল্পক্ষণের জন্য সামান্য অবশ করে দেয়। রক্ত চুষে নিয়ে উড়ে যাওয়ার পর আমরা চুলকানি অনুভব করে থাপ্পড় মারি, কিন্তু ততক্ষণে মশা চম্পট দেয়। তবে এদের কেউই যে মারা পড়ে না, তেমন নয়। আমাদের সমাজে যেমন একজন অপরাধ করলে অনেক সময় আরেকজনকে শাস্তি পেতে হয়, কোনো কোনো মশাকেও তেমন দুর্ভাগ্যজনক পরিণত বরণ করতে হয়। যে মশা কামড়ে পেট ভরে রক্ত খেয়ে উড়াল দিয়ে চলে যায়, তখন আমরা সজোরে আঘাত হানি। কিন্তু সে ঠিকই পালিয়ে যায়। হয়তো আরেকজন রক্তপিয়াসী মশা কামড়ানোর স্থান খুঁজছে, তার ওপরই থাপ্পড়টা গিয়ে পড়ে। এতে তাকে প্রাণ হারাতে হয়!

এই মশা কিন্তু আমেরিকার মতো অনেক সমৃদ্ধ এবং ঘোরেল কিসিমের। রক্ত চোষার সময় মশা তার শুঁড়ের সাহায্যে লালা ছড়িয়ে দেয় যেন রক্ত জমাট না বাঁধে। তাদের লালায় যে প্রোটিন থাকে তা আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধীব্যবস্থা শনাক্ত করে বহিরাগত শত্রু হিসেবে আক্রমণ করে। এ কারণে আমরা মশার কামড়ে চুলকানি অনুভব করি। আর অ্যাডিশ মশা সহজেই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। কারণ ওরা পেছন দিক থেকে এসে হাতের কনুই বা পায়ের গোড়ালিতে হুল ফোটায়। শোনা যায়, এসব মশা সাধারণত খুব ভোরে বা সন্ধ্যায় কামড়ায়।আমাদের দেশে মশারা কতটুকু কী ব্যাকরণ মেনে চলে সেটা বলা মুশকিল। এদের বেপরোয়া কামড়ের কোনো দিনরাত নেই, সকাল-সন্ধ্যানেই। তাই তো মশা আমাদের দেশে গণশত্রুতে পরিণত হয়েছে। মশার জ্বালায় সবাই অতিষ্ঠ। মশার কারণে রাজধানীর ঘরে শুরু হয়েছেনানা সমস্যা।

মহামান্য হাইকোর্ট পর্যন্ত মশা মারতে রুল জারি করছেন। মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ-বিক্ষোভ-অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র ‘কথার কামান’ দাগানোর পাশাপাশি মশা মারতেও ‘কামান দাগাচ্ছেন।’ যদিও মশা তাতে খুব একটা মরছে না! আসলে মশা মারা কোনো সহজ কাজ নয়। রেসলিংয়ের ফাইটারদের বলুন মিনিটে দশটা লোকের নাক ভেঙে দিতে, তারা সহজেই তা পারবে। কিন্তু তাদের যদি বলেন, মাসে ত্রিশটা মশা মারতে হবে, সেটা তাদের দ্বারা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না!

মশা নিয়ে গত কয়েক মাস ধরেই চলছে নানা আলাপ-আলোচনা। মশা মারতে নেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের উদ্যোগ-আয়োজন। কিন্তু তাতে কোনো ইতিবাচক ফল আসছে না। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। সম্প্রতি প্রতি তিন মিনিটে এক জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন বলে খবর বেরিয়েছে। চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি মশাবাহিত রোগ মহামারির আকার ধারণ করেছে।

মশা কেন বাড়ছে? কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ফগারম্যানদের পরিচালনা ত্রুটিপূর্ণ এবং যে ওষুধ স্প্রে হয়, তা ভেজাল ও নিম্নমানের। কেরোসিনমিশ্রিত। এ ছাড়া ঢাকা শহরের পাড়া-মহল্লার ভেতরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ত্রুটিপূর্ণ থাকায় প্রধান সড়ক ছাড়া অলিগলিসহ প্রায় সব এলাকাই মশার উৎকৃষ্ট প্রজননক্ষেত্র। আসলে শহরের ড্রেন, উন্মুক্ত জলাশয় ও খাল—সবখানেই জলাবদ্ধতা থাকায় সপ্তাহে এক-দুই দিন ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে এটাও হতে পারে যে, ক্রমাগতভাবে একই ধরনের ওষুধ
স্প্রে করতে থাকলে মশার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ওষুধ আর কার্যকর থাকে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। মশার নাকি এসব ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ক্ষমতালাভ করতে খুব বেশি সময় লাগে না।

মশা মারতে নানা উদ্যোগ আয়োজনের কথা শোনা যাচ্ছে। অ্যাডিস মশার বিস্তার ঠেকাতে বিদেশ থেকে মশা কিনে আনার পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর মতে, ‘উলভাটিয়া’ নামের বিশেষ ব্যাকটেরিয়াযুক্ত ওই পুরুষ অ্যাডিস মশা কেনার পরিকল্পনা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মশা কেনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করেছে। কমিটি ইতিমধ্যে কাজও শুরু করেছে।

এই প্রকল্পের পদ্ধতি অনুযায়ী, পুরুষ অ্যাডিস মশার শরীরে ‘ওলভাটিয়া’ নামক ব্যাকটেরিয়া ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। আর ওই পুরুষ মশাটি স্ত্রী অ্যাডিস মশার সংস্রবে গেলে স্ত্রী মশাটিও প্রজননক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। এভাবেই অ্যাডিস মশার বিস্তার রোধ করা যাবে।থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিজিসহ বেশ কয়েকটি দেশ নাকি সফলভাবে এই পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালিয়ে তাদের দেশের অ্যাডিস মশার সংখ্যা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। তবে এই প্রকল্প আমাদের দেশে কতটা কার্যকর হবে, আদৌ কার্যকর হবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে।

রাজধানীতে মশা না মরুক, মশা নিয়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক আলোচনা কিন্তু ঠিকই চলছে। যেমন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘অ্যাডিস মশার বিস্তার ঘটিয়ে মানুষ মারছে সরকার।’ তিনি আরো যোগ করেছেন, ‘যাদের সামান্য মশা মারার মুরোদ নেই, তাদের আর এক মুহূর্ত ক্ষমতায় দেখতে চায় না জনগণ।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, সরকার বিএনপি মারতে পারে অ্যাডিস মশা মারতে পারে না।’ওদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র বলেছেন, ‘ছেলেধরা, সাড়ে তিন লাখ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত একই সূত্রে গাঁথা। সরকার দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞ, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই ষড়যন্ত্রকারীদেরা মোকাবিলা করবে। ডেঙ্গু রোগীদের পাশে থেকে কঠিন জবাব দেওয়ার জন্য সরকার
প্রতিজ্ঞ।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘অ্যাডিস মশার প্রজননক্ষমতা রোহিঙ্গাদের মতো, নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।’ নেতা-নেত্রীদের এ ধরনের বক্তব্য শুনে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু ক্ষুব্ধ হয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মনুষ্য বর্জ্যের মতো মানুষের মুখনিঃসৃত বাণীগুলো ঠেকানোর জন্য মুখের কনডম আবিষ্কার জরুরি।‘কারণ, অ্যাডিস মশার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রজননক্ষমতার তুলনা, ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ছেলেধরা গুজবের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা—এমন মন্তব্য খুবই দুঃখজনক। তাদের এসব বক্তৃতা-বিবৃতিতেই স্পষ্ট যে মানুষের জীবন তাদের কাছে একেবারেই মূল্যহীন।’

আসলে ক্ষুব্ধ হয়ে লাভ নেই। মশা মারার দায়িত্ব অন্যকে দিয়েও খুব একটা ফলাফল আশা করা যায় না। কেউ যদি কারোর ঢাক না-পেটায় তাহলে তো নিজেকেই পেটাতে হয়। নিজের মশা নিজেকেই মারতেই হয়। একে-ওকে-তাকে দায়ী না করে আসুন, আমরা সবাই মিলে নিজের মশা নিজেই মারি।মনে রাখতে হবে যে, মশা ঠেকাতে মশারি আর মশা মারতে হাত বা চড়-থাপ্পড়ই আমাদের একমাত্র ভরসা। আমাদের নেতা-নেত্রীসহ কর্তাব্যক্তিরা দেদার বক্তব্য দেবেন। কিন্তু তাতে রাজনৈতিক বিদ্বেষ বাড়লেও মশক নিধনে মোটেও সহায়ক হবে না। কাজেই আসুন, আরদেরি না করে নিজের মশা নিজে মারুন!

লেখক : রম্যরচয়িতা