• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০১৯, ১০:০২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ৯, ২০১৯, ১০:০২ পিএম

সরকারি হাসপাতাল বিমুখ ধনিক শ্রেণি

সরকারি হাসপাতাল বিমুখ ধনিক শ্রেণি

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, চিকিৎসকের কাছ থেকে সময় না পাওয়া, অব্যবস্থাপনা, হয়রানি, মান নিয়ে প্রশ্ন ও কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে একটি বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠী সরকারি হাসপাতাল বিমুখ। আগের চেয়ে এখন সরকারি হাসপাতালগুলোয় উন্নত চিকিৎসা, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষ চিকিৎসকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হলেও ওই ধনিক শ্রেণি ঘুরে ফিরে যাচ্ছেন নামিদামি বেসরকারি হাসপাতালে, নয়ত বিদেশে, যেখানে অঢেল বা মাত্রাতিরিক্ত অর্থব্যয়ে মিলছে চিকিৎসা সেবা।

নিয়মিত বেসরকারি হাসপাতালে যান এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বহির্বিভাগ থেকে শুরু করে অপারেশন, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ), করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ), বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষার ইউনিট, জরুরি বিভাগসহ এমন কোনো বিভাগ নেই, যেখান থেকে চিকিৎসা নিতে হয়রানি হতে হয় না। হয় রোগীর চাপ থাকে মারাত্মক, কিন্তু সেই তুলনায় চিকিৎসকসহ অন্য লোকবল থাকে না, চিকিৎসাসেবার পরিবেশ নোংরা, দীর্ঘ সিরিয়াল থাকে, নয়ত ভর্তির অতি প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও সিট পাওয়া যায় না বা একে-তাকে দিয়ে একের পর এক তদবির করানো, স্বাস্থ্যকর্মীদের আদব-কায়দাজনিত সমস্যা- সরকারি হাসপাতালের এসব স্বাভাবিক দৃশ্য। অর্থ বেশি লাগলেও এসব দিক থেকে বেসরকারি হাসপাতালই পছন্দ করেন অনেকে। তবে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউট, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ইনস্টিটিউটসহ কিছু সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও স্বায়ত্বশাসিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) তারা যান। এর কারণ- ওই সব ভোগান্তি এসব প্রতিষ্ঠানে তুলনামূলক কম।

একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন নুসরান জাহান লিপি। গত আগস্ট মাসে তার মা আফসানা শিউলিকে নিয়ে যান কিডনি ডায়ালাইসিস করাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। তিনি বললেন, এত বাজে অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। মানুষের হুড়োহুড়ি, বিশৃঙ্খলা দেখে আমিই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি, মাকে আর কী দেখাব? এক দেশে টাকা জমা দিতে হয়, আরেক দেশে সিরিয়াল লেখানো, আরেক দেশে লাইন ধরে অবস্থান করা- মানে কী যে বলব, ভয়ংকর অবস্থা। পরে আমি বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হই।

তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলে ডায়ালাইসিস খরচ কম এটা স্বজনদের মাধ্যমে শুনে গিয়েছিলাম। কিন্তু খরচ কম বলে তো অমন পরিবেশে চিকিৎসা নিতে পারি না।

সম্প্রতি খাট থেকে পড়ে মাথায় চোট পায় সরকারি চাকরিজীবী রফিকুল ইসলামের সাড়ে তিন বছরের ছেলে রানা। রানাকে নিয়ে রাজধানীর কলেজ গেটের বাসা থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসেন তার স্ত্রী জলি। তখন রফিকুল অফিস থেকে ফিরছিলেন সোহরাওয়ার্দীর উদ্দেশে। 
জলি হাসপাতালে পৌঁছার ৩০ মিনিট পর রফিকুল পৌঁছে দেখেন রানা ব্যথায় কান্নাকাটি করছে, জলি তাকে কোলে নিয়ে জরুরি বিভাগের দরজায় সিরিয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। এ অবস্থা ভালো না লাগায় রফিকুল চলে যান আসাদ গেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। রফিকুল ইসলাম বললেন, বুঝেন বিষয়টা, আমার স্ত্রী ৩০ মিনিট আহত বাচ্চাটাকে নিয়ে দাঁড়ানো, কিন্তু সেই তুলনায় সাড়া নেই হাসপাতালের। সহ্য হচ্ছিল না। আমি সরকারি চাকরি করি, সেই পরিচয়ও দিই। কিন্তু ডাক্তাররা কার কথা শুনবে, এত মানুষ আর হৈ চৈ। আসলে ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি আছে অনেক। কম পয়সা লাগে বলে বাচ্চাকে তো আর কষ্ট দিতে পারি না।

কুর্মিটোলা হাসপাতালে কথা হয় উত্তরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আফরোজা হাসানের সঙ্গে। বহির্বিভাগে তিনি চর্ম চিকিৎসক দেখিয়েছেন। নিজের প্রাইভেট কারে চেপে এ হাসপাতালে তিনি নিয়মিত আসেন। দৈনিক জাগরণকে তিনি বলেন, শুধুমাত্র পরিবেশের কারণে সরকারি হাসপাতালে যাওয়া ছেড়েছিলাম ৪-৫ বছর আগে। একদিন এই হাসপাতালটা দেখতে এসে, সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখে পছন্দ হয়। তারপর এখানে নিয়মিত আসি। আসলে টাকা কম খরচ করে হোক আর টাকা বেশি খরচ করে হোক, কেউই বিশৃঙ্খল ও নোংরা পরিবেশে চিকিৎসা নিতে চায় না। কিছু মানুষ আছেন, যাদের আর্থিক সামর্থ্য খুবই সীমিত, তাদের কথা ভিন্ন।

অধ্যাপক সামন্ত লাল সেন

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের উপদেষ্টা অধ্যাপক সামন্ত লাল সেন দৈনিক জাগরণকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে সরকারি হাসপাতাল। আমাদের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা যে পরিমাণ রোগীর সেবা দিচ্ছেন, তা অকল্পনীয়। পৃথিবীর কোনো দেশে সরকারি চিকিৎসকরা এভাবে সেবা দেন না। একজন রিকশাচালক থেকে শুরু করে উঁচু তলার মানুষ- সবাই সেবা পাচ্ছেন। তবে ধনীদের কথা আলাদা, তাদের কাছে সরকারি হাসপাতাল পছন্দ না-ও হতে পারে। তাদের জন্য বেসরকারি হাসপাতাল আছে। কিন্তু গরিবরা সরকারিতেই আসবে, তাদের ভরসা এটিই।

তিনি বলেন, একটি সরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে রোগী আসেন, যে কারণে পরিবেশ ভাল রাখা অনেক কষ্টের। ২৪ ঘণ্টাই রোগী আসতে থাকে।

অধ্যাপক বদরুল আলম

জাতীয় নিউরো সায়েন্সস ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের যুগ্ম-পরিচালক অধ্যাপক বদরুল আলম বলেন, যে শ্রেণির মানুষ যেসব যুক্তি দেখিয়ে সরকারি হাসপাতালে আসেন না, তাদের কথা সর্বাংশে সত্য নয়। দেশের মানুষকে সরকারি হাসপাতালই বাঁচিয়ে রেখেছে। তবে এটা সত্য যে, সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিতে গেলে কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যেটা হয়ত কারও ধৈর্য্যে কুলায় না। সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার যদি তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে- সরকারি হাসপাতাল থেকেই সর্বোত্তম চিকিৎসা পাচ্ছে দেশের মানুষ।

ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এর মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, জনসংখ্যার সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবার সামঞ্জস্য নেই বলেই একটি শ্রেণীর কাছ থেকে সরকারি হাসপাতাল সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য আসে। এটা ঠিক করতে হলে মহাপরিকল্পনা লাগবে, বাজেট বাড়াতে হবে। একটি সরকারি হাসপাতালকে যে ধরনের বাজেট ও লোকবল দেয়া হয়, সেটা সেই তুলনায় খুবই কম। ফিদেল ক্যাস্ত্রো তার দেশের মোট বাজেটের ৫০ শতাংশ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য দিয়েছিলেন। এরকম করতে হবে। শুধু দাম দিয়ে যন্ত্রপাতি কিনলেই তো হবে না, সেগুলো চালানোর মতো যোগ্য মানুষও লাগবে।

‘সরকার চাইলে সবই সম্ভব’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার যদি এমন একটা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করত যে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব সরকারি হাসপাতালের শয্যায় পরিষ্কার চাদর বিছাতে হবে, দুর্গন্ধ থাকতে পারবে না, ইত্যাদি- তাহলে আস্তে আস্তে অবশ্যই সুফল আসবে। আজ যে দুর্গন্ধের কথা বলে সরকারি হাসপাতালে আসছে না, সে তখন ঠিকই আসবে। 

তিনি আরও বলেন, তবে শুধু সরকারের পক্ষে দেশের মানুষকে পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা দেয়া সম্ভব নয়। এটা পৃথিবীর কোথাও হয় না। এজন্য সরকার বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করে। আমাদের দেশে এমন প্রতিষ্ঠান কম হয়নি। মান বৃদ্ধির জন্য এগুলোর দিকেও নজর দেয়া প্রয়োজন।

আরএম/ এফসি

আরও পড়ুন