• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩, ২০২০, ০৯:৫১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ৩, ২০২০, ০৯:৫৩ পিএম

চলছে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ বিরোধী একপেশে প্রচারণা

চলছে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ বিরোধী একপেশে প্রচারণা
হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক-ইন্টারনেট

‘আলেমদের একাংশ ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ বিরোধী মত দিলেও অন্যরা এর পক্ষেই মত দিচ্ছেন’

কুয়েত, ইরান, ইরাক ও পাকিস্তানের মতো মুসলিম দেশে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ আছে। আর বাংলাদেশে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ ব্যবস্থাপনায়— যে মায়ের ছেলে সন্তান তার দুধ কোনও ছেলে শিশুকে এবং যে মায়ের মেয়ে সন্তান তার দুধ মেয়ে শিশুকে দেয়া হবে।

যদিও ওয়াজ-মাহফিলে এসব তথ্য দিচ্ছেন না ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ বিরোধী আলেমরা। তারা একপেশে বক্তব্য দিয়ে শুধু অন্য মায়ের দুধ পান করা শিশুর সঙ্গে ভবিষ্যতে ওই মায়ের সন্তানের বিয়ে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা প্রচার করছেন। এসব প্রচারণা ভাইরাল হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।

ভাইরাল হওয়া এসব ওয়াজ-মাহফিলের একটিতে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। কালিয়াকৈর বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই মাহফিলে রফিক উল্লাহ আনসারী নামক এক বক্তা ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ বিরোধী বক্তব্য রাখেন। এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী মোজাম্মেল হক উপস্থিত থাকায় তা ভাইরাল হয় বেশি। ওই বক্তা তার বক্তব্যের শেষদিকে মুসল্লিদের উদ্দেশে বলেন, ‘সন্তানকে শুধু নিজের আম্মার দুধ পান করাবেন।’ তবে আলেমদের একাংশ ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ বিরোধী মত দিলেও অন্যরা এর পক্ষেই মত দিচ্ছেন।      

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মুহাম্মদ শফিক আহমেদ দৈনিক জাগরণকে বলেন, একজন মা অন্য মায়ের সন্তানকে নিজের বুকের দুধ পান করাতে চাইলে— তা পারবেন। ইসলাম ধর্মে তা বৈধ। তিনি তো তা বিক্রি করছেন না। এমন একটা বৈধ কাজে বাধার সৃষ্টি করা উচিত না।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বৈধ কাজের ফলে যদি অবৈধ কোনও কাজ অর্থাৎ নাজায়েয বিয়ের ঝুঁকির বিষয়টি সামনে চলে আসে তাহলে তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কিন্তু তাই বলে অন্যের সন্তানকে দুধ পান করানোর মতো একটি বৈধ ও মানবিক কাজ করার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করা উচিত নয়।

বিভাগের আরেক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ বলেন, কোন কোন মুসলিম দেশে এই ব্যবস্থা চালু আছে তা আমি জানি না। তবে সেসব দেশে কীভাবে এটি কার্যকর করা হয় এবং আমাদের দেশে কীভাবে করতে চাচ্ছেন— তা সংবাদ সম্মেলন করে আয়োজকরা জানিয়ে দিলেই পারেন। তাহলে আর কোনও ভুল বোঝাবুঝি হবে না। সবাই সব কিছু জানতে পারবে।

এদিকে মাতৃহীন অথবা দুধ পায় না এমন শিশুদের জন্য করা এই ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ বন্ধে আইনি নোটিসও দেয়া হয়েছে। ফলে গত ১ ডিসেম্বর ব্যাংকটি চালু হওয়ার কথা থাকলেও তা করা যায়নি।

ঢাকার মাতুয়াইল শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে এই ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’টি কাজ শুরুর জন্য এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী অধ্যাপক ও ব্যাংকের সমন্বয়কারী ডা. মজিবুর রহমান নিজ উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রাথমিকভাবে এই ব্যাংকে ৫০০ লিটার মায়ের দুধ সংরক্ষণ করা যাবে।

এই ব্যাংকে প্রত্যেক মায়ের দুধ আলাদাভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। আর দুধ পাস্তুরিত করাসহ সংরক্ষণের যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে স্পেন থেকে। ডা. মুজিবুর রহমান এটা স্থাপন করতে সরকারের কাছ থেকে কোনও অর্থ সহায়তা নেননি। নিজে এবং দানশীল ব্যক্তিদের অর্থায়নে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আমাদের নবীজীও দুধ মায়ের দুধ পান করেছেন। তার একজন নয়, একাধিক দুধ মা ছিলেন। তাই ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকেও আমি একটি ভালো উদ্যোগ হিসেবে দেখছি। বহু মা ও শিশু উপকৃত হবেন। তবে যেহেতু কথা উঠেছে তাই আমি মনে করি ইসলামি চিন্তাবিদদের একটি কাউন্সিলের মাধ্যমে এর পদ্ধতিগুলো অনুমোদন করিয়ে নেয়া উচিত 

...............................

জাতীয় তাফসির পরিষদ নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ স্থাপনের বিরোধিতা করছে। তাদের পক্ষ থেকে এটা বন্ধে আইনি নোটিস পাঠানো হয়েছে।  ওই পরিষদের মুখপাত্র মাওলানা আতাউর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, সন্তান না হয়েও একই মায়ের দুধ যারা খান তারা দুধভাই বা দুধবোন। তাদের মধ্যে বিবাহ ইসলামে হারাম। তাই এ ধরনের দুধ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলে ওই হারামের আশঙ্কা থেকে যাবে। সেই কারণেই আমরা এটার বিরোধিতা করছি। তবে যদি ইসলামী চিন্তাবিদদের মাধ্যমে এর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায় তাহলে ভিন্ন কথা।

এর জবাবে ডা. মজিবুর রহমান বলেন, তারা দুধ সম্পর্কের যে কথা বলছেন সেই আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশের ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই আমরা এটা স্থাপন করেছি। প্রথমত, এখানে যে মা দুধ দেবেন তার প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। তাকে আইডি কার্ড দেয়া হবে। সংরক্ষিত দুধ যে শিশুকে দেয়া হবে তার পরিচিতি সংরক্ষণ করা হবে। তাকেও কার্ড দেয়া হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হল— যে মায়ের ছেলে সন্তান তার দুধ কোনও ছেলে শিশুকে দেয়া হবে। আর যে মায়ের মেয়ে সন্তান তার দুধ দেয়া হবে মেয়ে শিশুকে। আর দুধ দানের ব্যাপারে মা এবং তার স্বামীর লিখিত সম্মতি নেয়া হবে। ধর্মীয় কারণে এসব তথ্য দেশের কাজী অফিসগুলোতেও পাঠানো হবে।

তিনি বলেন, এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আগে বিশ্বের অনেক দেশে আমি ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ পরিদর্শন করেছি। কুয়েত, ইরান, ইরাক ও পাকিস্তানের মতো মুসলিম দেশে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ আছে। আমি তাদের নিয়ম দেখে এবং ইসলামী চিন্তাবিদদের সঙ্গে কথা বলে এটা করেছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামি চিন্তাবিদদের সামনেও আমি এটা উপস্থাপন করেছি। আর আমি নিজে মুসলমান। তাই ধর্মীয় কারণে এটা বিরোধিতা করার কোনও কারণ দেখছি না।

জাতীয় তাফসির পরিষদের বিরোধিতা ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এই ব্যাংক নিয়ে একটি গোষ্ঠী ব্যাপক অপপ্রচার চালাচ্ছে। এ ব্যাপারে ইসলাহুল মুসলিমিন পরিষদের চেয়ারম্যান ও কিশোরগঞ্জ শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, আমাদের নবীজীও দুধ মায়ের দুধ পান করেছেন। তার একজন নয়, একাধিক দুধ মা ছিলেন। তাই ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকেও আমি একটি ভালো উদ্যোগ হিসেবে দেখছি। বহু মা ও শিশু উপকৃত হবেন। তবে যেহেতু কথা উঠেছে তাই আমি মনে করি ইসলামি চিন্তাবিদদের একটি কাউন্সিলের মাধ্যমে এর পদ্ধতিগুলো অনুমোদন করিয়ে নেয়া উচিত। কারণ এত ভালো একটি উদ্যোগ কোনও বিতর্কের কারণে বাধাগ্রস্ত হোক তা আমি চাই না। আর আমি শুনেছি কুয়েত, ইরানসহ অনেক মুসলিম দেশে এই ধরনের মিল্ক ব্যাংক আছে। আমাদের এখানে করতেও তাই কোনও অসুবিধা দেখি না।

হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদফতরও দেখছে। তারা মনে করে এই ধরনের ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা আছে। যেসব শিশুর মা নেই, যে মা বুকের দুধ দিতে সক্ষম নন সেই সব শিশুর জন্য এই ধরনের উদ্যোগ অনেক উপকারী হবে।

অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি মাতুয়াইল শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকটি পরিদর্শন করেছি। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এটা উদ্বোধন করার কথা। তবে কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমরা আরো একটু পর্যবেক্ষণ করছি। শিশুর জন্য মায়ের দুধের কোনও বিকল্প নেই। তাই সব নীতি মেনে আমাদের সরকারী নীতি এই ধরনের হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পক্ষে।

ডা. মজিবুর রহমান জানান, এখানে কর্মজীবী মায়েরা তার নিজ শিশুর জন্যও দুধ রেখে যেতে পারবেন। আর এই দুধ ব্যাংকে দুধ জমা রাখা ও গ্রহণের জন্য কোনও অর্থ লাগবে না। প্রয়োজন নিশ্চিত হয়েই শিশুকে দুধ দেয়া হবে। এই ব্যাংকে ৩ মাস থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত দুধ শিশুদের খাওয়ার উপযোগী থাকবে।

তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে এই ব্যাংকটি আমাদের হাসপাতাল কেন্দ্রিক চাহিদা মেটানোর জন্যই স্থাপন করা হয়েছে এবং পরীক্ষামূলকভাবে আমরা সফল হয়েছি।

এমএ/এফসি

আরও পড়ুন