• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২০, ০৭:০৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৯, ২০২০, ০৭:২৫ এএম

অদৃশ্য শয়তানের মরণথাবা

বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস

বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চরম উৎকর্ষ প্রাপ্তি আর আধুনিক মানব সভ্যতার সকল অর্জনই আজ যেন বিবর্ণ। মানুষের অস্তিত্ব যেন বিপন্ন প্রায় কোনো এক প্রাণঘাতী অদৃশ্য শয়তানের আতঙ্কে। পরস্পর বিরোধী রণসংঘাতে বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে আধুনিক মানুষ যখন তার সকল মেধা ও বিদ্যা নিয়ে আত্মমগ্ন একের পর এক বিধ্বংসী সমরাস্ত্র তৈরিতে; বৈশ্বিক কর্তৃত্ব অর্জনের মোহে রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে,জাতিতে-জাতিতে যখন সম্পর্কের টানাপোড়েন-ঠিক তখনই অত্যন্ত নিরবে মনুষ্য বসবাসের উপযোগী পৃথিবী নামক এই একমাত্র জাগতিক সাম্রাজ্যে হানা দিয়েছে সেই রহস্যময় অদৃশ্য শয়তান- নাম তার করোনাভাইরাস (মারস-করভি)। যার প্রতিকার,প্রতিরোধ বা প্রতিষেধক তৈরিতে মানুষের সকল প্রাণন্ত চেষ্টাই একে একে মুখথুবড়ে পড়ছে। মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণে প্রতি মুহূর্তে শুধু দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল। গোটা বিশ্বের কাছে এখন এক প্রাণঘাতী আতঙ্কের নাম এই করোনাভাইরাস।

প্রতি মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে যেমন বিস্তৃত হচ্ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তেমনি প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে প্রাণঘাতী এই অজ্ঞাত ভাইরাসের আক্রমণে মৃত্যুর আতঙ্ক। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া এই রহস্যজনক ভাইরাসটি ধীরে ধীরে তার মরণথাবা বিস্তৃত করছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে।

চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১০৬ জনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সর্বশেষ তথ্য মতে,এতে আক্রান্তের সংখ্যাটাও বাড়ছে হু হু করে যা এরইমধ্যে সাড়ে ৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এই ভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহতা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে চীনসহ বিশ্বের আরও অন্তত ১৫টি দেশে। সিনহুয়া নিউজ/এনএইচকে নিউজ

এদিকে রহস্যময় এই ভাইরাসটিকে এক 'ভয়াল অদৃশ্য শয়তান' নামে আখ্যা দিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় তার দেয়া এই নামটিকে অবশ্য একেবারে ভুল বলা যাবে না।

চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বিশিষ্ট জীবাণু গবেষকদের মতে,সংক্রমণ প্রক্রিয়া ও বাহকের ধরণের ভিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে নিজের মৌলিক গঠন বজায় রেখেই- বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতিতে বিস্ময়কর বৈচিত্র্য সৃষ্টির এক অবিশ্বাস্য ক্ষমতা রয়েছে করোনাভাইরাসের। ক্রমান্বয়ে ভোল পাল্টে অস্বাভাবিক এই ভাইরাসটি নিজেকে একটি অস্থিতিশীল ও অনির্দিষ্ট অবস্থায় রাখতে সক্ষম। ফলে এর সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট এমন কোনো তথ্যই একাট্টা করা সম্ভব হচ্ছে না যার ভিত্তিতে এই ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি করা যেতে পারে বা নির্দিষ্ট করা যেতে পারে চিকিৎসা ব্যবস্থা। তাই বিস্ময়কর ও রহস্যজনক এই ভাইরাসটির প্রতিরোধ ও সংক্রমণ রোধের ব্যর্থতার ভারে উন্মাদ প্রায় আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও জীবাণু বিশেষজ্ঞরা।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংবাদ মাধ্যমের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুসারে জানা গেছে,সম্প্রতি এই ভাইরাসের সংক্রমণ চীনের গণ্ডি পেড়িয়ে পৌঁছে গেছে ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, নেপাল ও মালয়েশিয়ায়। পাশাপাশি এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে ফ্রান্স, জার্মানি, সৌদি আরব, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রেও। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বব্যাপী যে গতিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে,তা সামাল দিতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে গোটা পৃথিবীকে।

চীনের আধা-স্বায়ত্তশাসিত হংকংয়েও এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া উহান থেকে এক নারী যিনি তাইওয়ানে গিয়েছিলেন,তার শরীরেও এই ভাইরাস পাওয়া গেছে। এমন ঘটনা ঘটেছে ম্যাকাওয়ের ক্ষেত্রেও।

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তার লাভ করছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ   • আল জাজিরা

এদিকে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করার পরিকল্পনা করছে হংকং। মঙ্গলবার এক ঘোষণায় অঞ্চলটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) থেকে চীনের সঙ্গে হংকংয়ের ট্রেন ও ফেরি যোগাযোগ স্থগিত করা হবে। অঞ্চলটির নেতা ক্যারি লাম জানিয়েছেন, ভাইরাস যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্যই মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে।

শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য মতে জানা যায়, চীনের প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্ত সন্দেহে চীন-ফেরত ১১ ভারতীয়কে তড়িঘড়ি ভর্তি করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। ভারতে এখন পর্যন্ত ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে কেরালায় ৭ জন, হায়দ্রাবাদে একজন ও বেঙ্গালুরুতে একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এছাড়া কেরালায় ৭৩ জনকে বাড়িতে রেখে নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন সে দেশের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

সর্বশেষ সোমবার (২৭ জানুয়ারি) কলকাতায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এক নারীর মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করেছে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম।

এছাড়া রোববার (২৬ জানুয়ারি) চীন ছাড়াও থাইল্যান্ডে ২ জন এবং যুক্তরাষ্ট্র,জাপান,দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানে একজন করে এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তারা সবাই চীনের উহান শহর থেকে নিজ দেশে ফিরেছিলেন।   এনএইচকে নিউজ

মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও আল জাজিরার প্রকাশিত সংবাদের তথ্য মতে জানা যায়, এদিন থাইল্যান্ডে ১৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগিকে চিহ্নিত করা গেছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৫ জনে,যাদের মাঝে একজনের মৃত্যুর খবরও নিশ্চিত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলস ও ফনেক্স শহরে চলতি সপ্তাহে দুইজনের দেহে করোনাভাইরাসের জীবাণু সনাক্ত করা হয়েছে। এর আগে শিকাগো ও শিয়াটলের মোট ৩ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন।

বাঁ থেকে- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানোম ও চীনের স্টেট কাউন্সিলর ওয়াং ই   • রয়টার্স

তবে আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের আরো বেশি সংখ্যক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন বলে আশঙ্কা করেছেন ন্যাশনাল সেন্টার ফর ইম্যুনাইজেশন এন্ড রেসপিরেটোরি ডিজিসেস (এনসিইআরডি/সিডিসি)-এর পরিচালক ন্যান্সি ম্যাসনিয়ের।

পরিস্থিতি এতটাই প্রকট যে, চীনা নাগরিকদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে শ্রীলঙ্কা। মঙ্গলবার কলম্বোর বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে লঙ্কান স্বাস্থ্যমন্ত্রী পবিত্র ওয়ানিআরসি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে,ভাইরাসটির প্রাথমিক উৎস কোনও প্রাণি হতে পারে। তবে চীনা কর্মকর্তারা মনে করছেন, এর সঙ্গে উহানের একটি সামুদ্রিক খাবারের বাজারের সম্পর্ক রয়েছে। স্থানীয় ওই বাজারে যারা যাতায়াত করেছেন,তাদের মধ্যেই প্রথম এ ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে।

এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ভ্যাক্সিন। তবে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো ও নিয়ন্ত্রণে চীনের সক্ষমতা রয়েছে বলে নিজের দৃঢ় বিশ্বাসের কথা জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানোম।

মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) চীনা রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা শিনহুয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বেইজিংয়ে চীনের স্টেট কাউন্সিলর ওয়াং ই-র সঙ্গে এক বৈঠককালে এমনটা বলেছেন ডব্লিউএইচও’র প্রধান গ্যাব্রেইয়েসুস।

এদিকে নিজ দেশের নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণ স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে চীন। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস নিয়ে সৃষ্ট উদ্বেগ ও আতঙ্ক প্রশমনে এ আহ্বান জানিয়েছে দেশটি।

থার্মাল স্ক্রিনিং   • রয়টার্স

করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর ছাড়াও রাজধানী বেইজিংসহ দেশটির আরো ২৯টি প্রদেশে এ ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে আরো কয়েকটি রাষ্ট্রে এর সংক্রমণ ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। পাশপাশি প্রায় ৫ শতাধিক বাংলাদেশিসহ বহু প্রবাসী আটকে পড়েছেন উহানসহ চীনের বিভিন্ন রাজ্যে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সর্বত্রই যেন এক অজানা আতঙ্কের অশনি সংকেত।

তবে আশার কথা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক উদ্ভাবনে চীন-মার্কিনের মতো ভেদাভেদ ভুলে একযোগে কাজ করছেন বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও জীবাণু গবেষকরা। তাদের বিশ্বাস ইবোলার মত পরাস্ত হবে করোনাও। মানব সভ্যতার হাজার বছরের ইতিহাসে এমন বহুবার নানা প্রলয়ের বিরুদ্ধে লড়াই জিতেই আজ এতদূর এগিয়ে এসেছে পৃথিবী। হয়তো এই করোনাভাইরাসের মত মহাশত্রুর বিরুদ্ধে লড়তেই আবার মহাঐক্যের আকড়ে আবিষ্ট হবে বিশ্ব, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একযোগে লড়বে গোটা পৃথিবীর মানুষ। মানুষে মানুষে নয়, প্রাণঘাতী এই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেই তবে ঘোষিত হোক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

তথ্যসূত্র সহায়ক: রয়টার্স, আল জাজিরা, এনএইচকে নিউজ, সিনহুয়া নিউজ, হু, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এই সময়, ওয়াশিংটন পোস্ট

আরও পড়ুন