• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২১, ০১:১৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২১, ২০২১, ০৪:০৩ পিএম

পরের ভাইরাসটি কেমন হবে?

পরের ভাইরাসটি কেমন হবে?

বাংলাদেশে সংক্রমণের হার যখন কমছে বিশ্বে তখন কার্যকরী ভ্যাকসিনের কার্যক্রমও শুরু হয়ে গেছে। আমি নিজেও যখন দীর্ঘ অস্বাভাবিক জীবনযাত্রা কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্ন দেখছি, ঠিক তখনই বিশ্বের অনেক নামকরা বিজ্ঞানীদেরও গবেষণালব্ধ তত্ত্ব, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস আমার আশাবাদী মনকে বেশ ঘাবড়ে দিচ্ছে। এতো কষ্টে পাড়ি দেওয়া করোনাকালই কি তবে শেষ মহামারী নয়! আমাদের কি তবে আরও ভাইরাস দেখতে হবে?

ইউনাইটেড ন্য়াশন ইনভারোমেন্ট প্রোগ্রামের তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি ৪ মাসে একটি করে নতুন ভাইরাসের জন্ম হয়।  যার ৭৫% আসে বিভিন্ন প্রাণীর শরীর থেকে।

আইইউসিএন এর তথ্যমতে- উন্নয়নের নামে মাত্রাতিরিক্ত নব নিধনের কারণে বন্য প্রাণীরা মানুষের কাছাকাছি চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে, মানুষও চলে যাচ্ছে বন্যদের সংস্পর্শে যা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু মানুষ তার নিজের স্বার্থে প্রাণীদের বাস্তুসংস্থানে প্রবেশ করায় প্রকৃতির নিজস্ব ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষের পরিবেশ সংক্রান্ত স্বার্থপরতা এবং দায়িত্বহীনতার কারণেই করোনা মহামারী এসেছিল।

আরও চমকে দেওয়ার মতো পূর্বাভাস দিলেন ইউনিভার্সিটি অফ লিভারপুলের এপিডেমিওলোজি পপুলেশন হেলথের প্রফেসর মেথিউ বেলিস বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, "করোনার মতো মহামারী আগামীতে যে আরো আসবে তা একরকম অবধারিত। গত ২০ বছরে আমরা ৬টি বড় বড় হুমকির সম্মুখীন হয়েছি সার্স, মার্স, ইবোলা, এভিয়ান, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সোয়াইন ফ্লু এবং কোভিড ১৯। প্রথম ৫টি ভাইরাস এড়াতে পারলেও ৬ নম্বরটির হাত থেকে বাঁচতে পারিনি। এটি মোটেও আমাদের সম্মুখীন হওয়া শেষ মহামারী নয়। সম্ভাবনা অনেক বেশি যে আরও শক্তিশালী কোনো ভাইরাস আামাদের আক্রমণ করবে, কারণ পরিবেশ এবং প্রাণীজগত সম্পর্কে এখনো আমরা পুরোমাত্রায় স্বার্থপর এবং নির্বিকার।"

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রফেসর তার গবেষণায় ভাইরাসের বৈচিত্র বেড়ে যাওয়ার অনেক প্রমাণ পেয়েছেন। গবেষণায় উঠে এসেছে, ইকোসিস্টেমকে বদলে দিয়ে মানুষের নিজের ইচ্ছেমতো কৃষি বা বৃক্ষরোপণ, বন ধ্বংস এবং বন্যপ্রাণীর আবাসভূমিতে মানুষের ঢুকে পড়ার ফলেই ঘন ঘন এবং সহজেই প্রাণী থেকে মানুষে রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।জীব বৈচিত্র কমছে, ভাইরাস বৈচিত্র বাড়ছে মানুষের নানা অচেনা সংক্রমণে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি কেবল বেড়েই যাচ্ছে।

লিভারপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেনিয়ার আন্তর্জাতিক গবাদিপশু গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক ফেভওে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বণ্যপ্রাণীর আবাসস্থল এবং মানুষের নিজের স্বার্থে পশুপালনের ফার্ম-এ দুয়ের মধ্যে  নতুন রোগ ছড়ানো ইন্টারফেস হয়ে উঠতে পারে। বন্যপ্রাণী এবং মানুষ বসবাস করে এমন জায়গায় প্রতিবছর বেশ কয়েকবার নতুন রোগের উদ্ভব হয়। এখন শুধু রাশিয়া কিংবা আফ্রিকা নয়, ইউরোপ বা আমেরিকাতেও এমন হচ্ছে। তাই তার মতে পরবর্তী ভাইরাস আরও অপ্রতিরোধ্য হতেই পারে।

এরকম অসংখ্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব উপাত্তেন পূর্বাভাসের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যেগুলোর মূল কথা প্রায় একই। মানুষ ভয়ংকর বাড়াবাড়ি আচরণ করছে, এই প্রজাতির আচরণ দেখে মনে হয় পৃথিবী নামক গ্রহটি শুধুমাত্র মানবজাতীর জন্যেই তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু যেই সৃষ্টিকর্তা মানুষ তৈরি করেছেন সেই একই সৃষ্টিকর্তা কিন্তু আরও প্রজাতি তৈরি করেছেন। তৈরি করেছেন প্রকৃতি, সমুদ্র-কতো কি! প্রয়োজন আছে বলেই করেছেন।

পৃথিবী অনেক সময় অনেক অত্যাচারী প্রতাপশালী শাসক পেয়েছে, যাদের সামনে সাধারণ দুর্বল মানুষের টিকে থাকাই সমস্যা ছিল। কিন্তু কোনো না কোনভাবে তাদেরও পরাজয় ঘটেছে। তাদের পরাক্রম মোটেও চিরস্থায়ী ছিল না।

তেমনি প্রাণীকালের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান সৃষ্টি এই মানুষ। বুদ্ধির কারণে মানুষ এখন ভয়ংকর শক্তিশালী। পাহাড় পর্বত সমুদ্র পর্যন্ত আমরা জয় করেছি অনেক আগেই। উন্নয়নের নামে নির্বিচারে বনসম্পদ ধ্বংস করছি, প্রোটিন খেতে হবে বলে মঙ্গলের পর মঙ্গল জ্বালিয়ে গোচারণ ভূমি তৈরি করেছি। চেনা অচেনা সব জীবজন্তু খেতে খেতে ওজনাধিক্যে ভুগছে সব উন্নত শহরগুলো। মানবজাতির মধ্যে নতুন একটা অ্যাডিকেশন তৈরি হয়েছে, আমরা কেউই যার বাইরে নই। ফুড এডিশনে আমাদের কারোরই কোনো মাথাব্যথা নেই।

‘বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুদের মাতৃক্রোড়ে’-এতো অনেক পুরোন কথা। প্রকৃতি সংক্রান্ত দায়িত্ববোধকে আমরা কোনদিনই ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ হিসেবে নেইনি। প্রকৃতি, পরিবেশ এবং প্রাণীজগতের মতো বড় বড় ব্যপারগুলোকে পাশকাটিয়ে নিজের জীবন নিয়েই আমরা বেশি ব্যক্ত। সভ্যতা যতোই বাগিয়েছে, আমরা নিজের ব্যক্তিগত সুখস্বাচ্ছন্দ্যে এতোই কেন্দ্রীভূত হয়েছি।

কোভিড ১৯ একটি ঘণ্টা বাজিয়ে মনে করিয়ে দিল-আমাদের যথেষ্ট স্বেচ্ছাচারিতা হয়েছে। সময় এখন প্রকৃতির। একটি ব্যপারে কিন্তু বিজ্ঞান এবং সমস্ত ধর্মগ্রন্থ একই কথা বলেছে-‘বাড়াবাড়ি ভালো নয়’। করোনা মহামারী আসলে আমাদের কতোটুকু সতর্ক করতে পেরেছে? মহামারী শেষে আমরা টিকে থাকতে পারবো তো? কিংবা কি রকম হতে পারে পরবর্তী মহামারী, আমরা কিংবা আমাদের উত্তরসূরীরা টিকে থাকবে তো?

প্রজন্মের জন্যে সতর্ক বার্তাসহ শুভেচ্ছা।

লেখক: ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট ডিন এবং ফ্যাকাল্টি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন বিভাগের পরিচালক।