• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০২১, ০৪:১০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৪, ২০২১, ০৪:১০ পিএম

ভালো থাকার টোট্কা

ভালো থাকার টোট্কা

‘টোটকা’ বলে আসলেই কার্যকরী কিছু হয় কিনা আমি নিশ্চিত নই। তবু সোস্যাল মিডিয়াতে যেকোনো পরিচিত সমস্যার টোটকা সমাধান দেখলেই চোখ বুলাই। সারাবছর দেখেছি মাত্র তিন দিনে করোনা জয়ের জাদুকরী অব্যর্থ টোট্কা! বছরটা শেষ হয়ে পুরােেনা হয়ে গেল কিন্তু করোনা প্রসঙ্গ পুরোনো হলো না বরং নতুন বছরে ভাইরাসটিও নতুনরূপে নতুন ছন্দে হাজির। নতুন নতুন সমস্যার ইঙ্গিত নিয়ে, এতো অনিশ্চয়তা নিয়ে ভালো থাকাই বিরাট সমস্যা। আমি আসলে ভালো থাকার টোট্কা খুঁজছিলাম। কোথাও পেলাম না। ভাবতে বসলাম একেক জনের একেক রকম সমস্যা। সবার জন্যেই ভালো থাকার কি কোনো কমন টোট্কা হয়?

করোনা মহামারী নিয়ে গেছে অনেক কিছু। এতো মৃত্যুসংবাদ আর কোনোবছর পাইনি। নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর বীজ আশেপাশে নিয়েই বছরটি কাটিয়েছি। কতোজন যে আক্রান্ত হয়ে পরাজিত হয়েছে, কতোজন ভুগছে! এই রকম পরিস্থিতিতে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে আছি এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! এটা ভাবতেই মন কৃতজ্ঞতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। টের পেলাম-কৃতজ্ঞতা একটা চমতকার অনুভূতি। বিনা পয়সায় মন ভালো করে দিতে পারে। কৃতজ্ঞ মন এবং অকৃজ্ঞমনের ভেতর আকাশ-পাতাল ফারাক।

যাবতীয় খারাপ যেমন রাগ, ঘৃণা, ক্রোধ এগুলো থেকে অনায়াসেই মনকে দূরে রাখে, এই খারাপ রিপুগুলো মনকে শুধু নয়, আক্রান্ত করে শরীরকেও, আজকাল যতো রোগ বালাই সিংহভাগই আসে মানসিক অস্থিরতা এবং দুশ্চিন্তা থেকে ডাক্তার তিনি যে বিশেষজ্ঞই হোক না কেনো, একটি সাজেশন কমন থাকে ‘দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকবেন।’ মনকে দুশ্চিন্তামুক্ত রাখা সহজ নয় তবে মনের মধ্যে যখন কৃতজ্ঞতা জায়গা দখল করে  রাখে, দুশ্চিন্তা কিছুতেই জায়গা করতে পারে না।

আমাদের মধ্যে নানান দম্ভ অহংকার আমিত্ব জায়গা দখল করে রেখেছে। এগুলোকে ঠেলে সরানো সহজ নয় কিন্তু কিছুটা পরিবর্তন হয়তো করা সম্ভব। ‘আমি ধনী’ এই কারণে দম্ভে না ভুগে কৃতজ্ঞও তো হতে পারি। অভাবের কষ্ট আমাকে দেখতে হয়নি। করো কাছে হাত পাতার অপমান আমাকে বুঝতে হয়নি। নতুন মডেলের গাড়ি কিংবা মোবাইল কিনলে অবশ্যই ভালো লাগবে। এখানে দোষের কিছু নেই কিন্তু সেটি ব্যবহার করার সময় নিজেকে ‘কেউকেটা’ মনে না করে  ভাগ্যবান মনে করেই দেখুন না! সেটি অহংকারের চেয়েও হাজারো গুণ চমতকার একটি অনুভূতি।

আপনি ভাগ্যবান বলেই আপনার পছন্দের পণ্যটি কিনতে পেরেছেন। পছন্দ তো কতো মানুষই করে, সবাই কি কিনতে পারে? আপনি সেই কিনতে পারা ভাগ্যবানদের মধ্যে একজন। স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ দিন। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে আরো আরো কৃতজ্ঞ থাকার সুযোগ করে দেবেন। নিজের চারপাশে একবার সচেতনভাবে একটু তাকিয়ে দেখুন, কতো মানুষ বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান হারিয়েছেন। সেই পরিবারের জন্যে তিনি হয়তো সমস্ত কিছু ব্যয় করতে  প্রস্তুত ছিলেন। আপনার পরিবার হয়তো সুস্থ আছে। তার মানে এক অর্থে আপনি সম পরিমাপ সম্পদের মালিক। কতো জনে দুর্ঘটনায় হাত পা হারিয়েছেন। নষ্ট কিডনী নিয়ে জীবন যাপন করেছেন অগণিত মানুষ। নিভে যাওয়া অঙ্গের জন্যে তিনি হয়তো লাখ লাখ টাকাও খরচ করতে প্রস্তুত। আপনার শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ ঠিকমতো কাজ করছে। তার মানে আপনি কপর্দকহীন হলেও প্রকারন্তরে লাখ লাখ টাকার মালিক। আপনার অজান্তেই! তারজন্যে কৃতজ্ঞ থাকুন। দেখবেন নিজেকে কি দারুণ পরিপূর্ণ মনে হবে।

করোনার পাশাপাশি আরেক মহামারি চলছে। তার খবর আমরা রাখিনা। বিষন্নতা, হতাশা নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে আমাদের যাওয়া আসা বেড়েছে। ... ঘুমের ওষুধ বিক্রিও বেড়েছে। প্রত্যাশা বেড়েছে তাই না পাওয়ার বেদনাও বেড়েছে। কি কি পেয়েছি তার হিসাব করার সময় কোথায়? একবার হিসেব করেই দেখুন না, নিজেই অবাক হবে। নিজের প্রতি, নিজের সৃষ্টিকর্তার প্রতি মনোভাব একদম পাল্টে যাবে, হতাশা দূরে পালিয়ে যাবে। বিষন্নতার জায়গা করে নেবে ‘কৃতজ্ঞতা’। প্রচন্ড সুন্দর সেই অনুভূতি থেকে হেলায় নিজেদের বঞ্চিত করি আমরা। কৃতজ্ঞ মনের মতো ওষুধ আর হয় না, যার কোনোই পাশ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই, আছে শুধুই উপকারিতা।

অকৃতজ্ঞ মনের কোনো শত্রুর প্রয়োজন হয় না। সে নিজেই নিজের জন্যে বিরাট বোঝা। পৃথিবীর সবকিছু আমার চাওয়ার মতো চলবে না। অকৃতজ্ঞ মন কেবলই না পাওয়ার হিসেব করে বেড়ায় আর মনের ওজন দিন দিন বাড়তেই থাকে। শরীরের বাড়তি ওজন যতো না বহনযোগ্য, মনের বাড়তি ওজন তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ক্ষতিকর। মনকে ভালো করতে আমরা কতো না চেষ্টা করি। যতো বিনোদন সবইতো মনের খাদ্য। ভারী মন অনেক সময় মাদককেও আশ্রয় করে শুধু কষ্ট ভুলে থাকার জন্যে, কষ্টের বদলে সুখগুলো গুণতে থাকুন, আনন্দ পাবেন, স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দেবেন।

কতোরকম শারীরিক সুস্থ্যতার পরীক্ষাই তো আমরা করাই, মানসিক সুস্থ্যতার খুব ছোট একটি পরীক্ষা নিয়ে দেখতে পারেন। আপনার জীবনের যতো প্রাপ্তিগুলো ধন্যবাদ পাবার উপযুক্ত, তার একটা তালিকা তৈরি করুন মনে মনে। আর যদি ধন্যবাদ দেবার তেমন কোনো কারণ খুঁজে না পান, তবে সাবধান সমস্যা আপনার নিজের মধ্যে রয়েছে। সতর্ক হোন, তা নাহলে আপনার অভিযোগ আপনার আশেপাশের মানুষকে কেবল বিরক্তই করবে। আপনার কোনো মঙ্গল হবে না, কোনো সমস্যার সমাধানও হবে না। মাঝ থেকে সম্পর্কগুলো নষ্ট হবে শুধু।

মহামারীর মধ্যে নতুন বছরে ভালো থাকার এই টোট্কাকেই আমি গ্রহণ করলাম। আমি কৃতজ্ঞ যে আমার চারপাশে ভালো  লোকেরা রয়েছে। এমনকি আমার জীবনের সমস্যাগুলোর প্রতিও আামি কৃতজ্ঞ। তারাই ধাক্কা দিয়ে আমাকে এগিয়ে যেতে শিখিয়েছে। কৃতজ্ঞতা নেই তো মানবতাও নেই। জীবনের ছোট বড় প্রাপ্তি এবং আশির্বাদগুলোকে যদি চিহ্নিত করা এবং ধন্যবাদ দেবার অভ্যেস গড়ে তোলা যায়, তবে হয়তো একটি জীবন সুখে-দুখে সুন্দর কাটিয়ে দেয়া যাবে।

 

লেখক: অ্যাসোসিয়েট ডিন, ব্যাবসায় প্রশাসন বিভাগ এবং ডাইরেক্টর, ফ্যাকাল্টি ডেভেলপমেন্ট অ্যাÐ ইভ্যালুয়েশন, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।