• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ২৪, ২০১৯, ০৩:২৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ২৪, ২০১৯, ০৬:১৮ পিএম

গল্পটা সাড়ে তিন ডজন আসনের

গল্পটা সাড়ে তিন ডজন আসনের

 

লোকসভা ভোটের ফলাফলে ভারতবর্ষ আবার গেরুয়া হয়েছে। উত্তর, পশ্চিম, উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণে কর্ণাটক, এবং পূর্ব ভারত। এই সেদিন পর্যন্ত বামেদের অধীনে থাকা পশ্চিমবঙ্গের সাড়ে তিন ডজন আসনে কী হবে, সে নিয়ে পর্যলোচনা চলছিলই।

এবারের নির্বাচনে অন্যতম সব চাইতে বড় নজর-কাড়া বিষয় ছিল পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিপুল বৃদ্ধি। গোটা ভারতবর্ষই নজর রেখে গেছে এ দিকে। বিজেপি যে পশ্চিমবঙ্গকে পাখির চোখ করেছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল বাংলায় তাদের প্রচারণার বহর দেখে। ২০১৪-র লোকসভায় বিজেপির ১৭ শতাংশ ভোট ২০১৬-র বিধানসভায় ১২ হলেও। পশ্চিমবঙ্গের হাওয়ায় বোঝাও যাচ্ছিল যে, বিজেপি-র সমর্থন বাড়ছে। সংবাদ-মাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়াতে, বাসে-ট্রামে, অফিসে-আদালতে লোকজনের আলোচনায়। প্রায় সমস্ত বুথ-ফেরৎ সমীক্ষাই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিপুল ভাবে ফুলে-ফেঁপে ওঠার পূর্বাভাস করেছে। বুথ-ফেরৎ সমীক্ষার ভরসা যদিও ভীষণ কম, কিন্তু এগুলিতে আসন-সংখ্যায় গোলমাল হলেও ভোটের শতাংশে তুলনায় ভুল অনেক কম হওয়ার কথা। যাই হোক, নির্বাচনের ফলেও দেখা যাচ্ছে একই ধরনের গতি-প্রকৃতি।

পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনে বিজেপি পেয়েছে মোটামুটি দেড় ডজনের মত, কংগ্রেস দুটা, আর বাকিটা গেছে তৃণমূলের ঘরে। কিন্তু শুধু আসন-সংখ্যার হিসেব কিছুতেই পুরো ছবিটা দিতে পারবে না। গুরুত্বপূর্ণ হল, ভোট শতাংশের হিসেবে তৃণমূল প্রায় ৪৩, আর বিজেপি প্রায় ৪০। তৃণমূল কিন্তু তাদের ভোট শতাংশ ধরে রাখতে পেরেছে মোটামুটি ভাবে। বরং আগের লোকসভার তুলনায় খানিকটা বেড়েছে তাদের প্রতি জনসমর্থন। তাহলে বিজেপির এই ম্যামথের মত ভোট বাড়ার রসায়নটা কী? আপাতদৃষ্টিতে এটা পানির মত পরিষ্কার।

পশ্চিমবঙ্গে বামেদের ভোট শতাংশ ২০১৪-তে ছিল ৩০ শতাংশের মত, এমনকী ২০১৬-র বিপর্যয়েও সেই ভোট ২৬ শতাংশের নীচে নামেনি। এবারের ভোটে বামেদের ভোট কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। আর এই বাম ভোটের অধিকাংশই গিয়েছে বিজেপির খাতায়। এই পরিবর্তনটা হয়ত শুরু হয়েছে ভোটের আগে থেকেই। বাম ভোট যে দলে দলে বিজেপির দিকে চলে যাওয়া সম্ভব তার নমুনা আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি আর এক বাংলা-ভাষী রাজ্য ত্রিপুরাতে। তবে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিটা বোধ করি খানিকটা আলাদা। ত্রিপুরাতে শাসক ছিল বামেরা। তাই সেখানে ভোটের পরিবর্তনটা বাস্তবে শাসকের পরিবর্তন। পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু বাম থেকে ডানে এই ভোটের পরিবর্তনটা হল বিরোধীদের ভোটের পরিবর্তন। কোথাও বা সংশ্লিষ্ট ভোটারদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের পরিবর্তন।

বাম ভোটের এইভাবে বিপুল পরিমাণে বিজেপিতে সরে যাওয়ার কারণ নিয়ে অনেক পর্যালোচনা হবে আগামী দিনগুলিতে। এদের খানিকটা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক পরিবর্তন। সমর্থনের ভিত্তি এক দল থেকে অন্য দলে সরে যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। এটা যে কোনও গণতন্ত্রের স্বাভাবিক নিয়ম। বিশেষ করে দেশের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক ভোটারই সম্ভবত ফ্লোটিং ভোটার। তারা কোনো দলকে সমর্থন করলেও সেই সমর্থনের ভিত্তি ভীষণ নড়বড়ে। অনেকাংশেই তা বিশেষ কোনও আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে থাকে না। এবং তা বদলাতে পারে সহজেই।

তবু, এবারের পশ্চিমবঙ্গে বাম ভোটারদের একটা অংশ কৌশল করে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে — এমন একটা ধারণা, একটা হাওয়া এবং প্রচার ঘুরছে বেশ কিছুদিন ধরেই। বহুদলীয় গণতন্ত্রে এই কৌশলী ভোট বা ট্যাকটিক্যাল ভোট কিন্তু খুবই স্বাভাবিক। এবং অন্যায়ও কিছু নয়। ‘ক’, ‘খ’ এবং ‘গ’ এই তিনটি দলের মধ্যে ‘গ’ দলের ভোটাররা যদি দেখে যে, তাদের জেতার কোনো সম্ভাবনাই নেই, তারা বিচার করতে বসতে পারে ‘ক’ এবং ‘খ’-এর মধ্যে কাকে তারা কম অপছন্দ করে। যদি তারা ‘খ’ দলকে কম অপছন্দ করে, নিজেদের সমর্থনের দল ‘গ’-কে ভোট না দিয়ে তারা দলে দলে ভোট দিতে পারে ‘খ’-কে। একেই বলে ‘ট্যাকটিক্যাল ভোট’।

ব্রিটেনের ২০১৭ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভদের হারানোর জন্য লেবার পার্টি আর লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা এমনই কৌশল করে ভোট দিয়েছে। যেখানে লেবাররা প্রধান প্রতিপক্ষ, লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা ভোট দিয়েছে লেবারদের। উল্টোটা হয়েছে — লেবাররাও লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিয়েছে যেখানে তারাই কনজারভেটিভদের প্রধান প্রতিপক্ষ। সেই নির্বাচনে এই ট্যাকটিক্যাল ভোট দিয়েছে দেশের প্রতি পাঁচজনের একজন ভোটার। ২০১৯-এর পশ্চিমবঙ্গে এমন একটা জল্পনা শোনা গিয়েছে যে, বামেরা এমনই কৌশল করে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, তৃণমূলকে হারানোর জন্য। সেটা সত্যি কিনা, বলা একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু, যদি সত্যি হয়, তাহলে এই ভোটাররা কি আবার চাইলেই ফিরবে পুরোনো দলের সমর্থনে? ২০২১, ২০২৪ বা ২০২৬-এ? এটা গোটা বিশ্বের প্রেক্ষিতেই এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক প্রশ্ন। আজকের পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তো বটেই।

আপাত ভাবে বিজেপি ভাল ফল করেছে উত্তরবঙ্গে, রাজ্যটার পশ্চিম দিকে, এবং পূর্বে বাংলাদেশ সীমান্তের কেন্দ্রগুলিতে। এই প্রবল হাওয়ায় ৪০ শতাংশ ভোট পাওয়ার পথে বিজেপি কংগ্রেসেরও খানিক ভোটে থাবা বসিয়েছে। এমনকী সামগ্রিক ভাবে না দেখে কেন্দ্র হিসেবে কোথাও কোথাও তৃণমূলের খানিক ভোটও নির্ঘাৎ বিজেপিতে গিয়েছে। কেন্দ্র ধরে ধরে ফল দেখলে এটা মনে হতেই পারে। ওদিকে উত্তরে দার্জিলিংয়ে বিজেপির বিপুল জয়ের ফলে পাহাড় সংক্রান্ত নীতি নিয়ে কি নতুন করে ভাবার অবকাশ রয়েছে?

রাজ্যে বিজেপির এই হাওয়ার মধ্যেও লক্ষ্যণীয় যে তৃণমূলেরও কিন্তু ভোট বেড়েছে এ রাজ্যে, সামান্য হলেও। তাই স্পষ্টতই রাজ্যের ভোট একেবারে দুই মেরুতে ভাগ হয়ে গিয়েছে। আগামী দিনগুলিতে পশ্চিমবঙ্গে এই দ্বিমেরুর রাজনৈতিক লড়াই দেখার প্রবল সম্ভাবনা। আর সে পথে এই রাজ্যে বাম এবং কংগ্রেস কি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তে পারে আগামী দিনগুলিতে? নাকি দু’পাঁচ বছরের মধ্যে আগামী কোনও নির্বাচনে তারা ঘুরেও দাঁড়াতে পারে আবার? বামেদের কিছু ভোট যদি কৌশল করে বিজেপিতে গিয়ে থাকে তবে এ এক গুরুত্বপূর্ণ এবং জীবন্ত সামাজিক সমীক্ষা।

এবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে স্তিমিত কংগ্রেসের কুম্ভ বহরমপুরের গড়ে অধীর চৌধুরী আর মালদহ দক্ষিণে আবু হাসেম খান চৌধুরী। পশ্চিমবঙ্গের বামেরা এবং কংগ্রেস ভাবতে বসতে পারে যে, রাজ্যে বাম-কংগ্রেস যে জোটটা হবে হবে করে হল না শেষ পর্যন্ত, কেমন হত সেটা হলে? যদিও আগের বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোটের ফলে বাম-ভোট কংগ্রেসে গেলেও কংগ্রেস-ভোট তেমন ভাবে বাম-পক্ষে আসেনি বলেই শোনা গিয়েছে। তবু, এবার এই জোট হলে এবার কি বাস্তবে একটা ত্রিমুখী লড়াই হতে পারত এ রাজ্যে? অবশ্য সত্যি সত্যিই যদি বাম-ভোট কৌশল করে বিজেপির ঘরে গিয়ে থাকে — যেমন শোনা যাচ্ছে কান পাতলেই — সেক্ষেত্রে এই আলোচনাটাই অপ্রাসঙ্গিক। তাহলে ২০২১-এর দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতে কি কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের সম্ভাবনা রয়েছে এ রাজ্যে? এই প্রবল বিজেপি হাওয়ায় এবং তৃণমূল আর বিজেপির প্রায়-দ্বিমুখী লড়াইতে কংগ্রেসও রাজ্যে তাদের অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে বা পড়বে, নিঃসন্দেহে।

লোকসভার সঙ্গে সঙ্গেই বিধানসভার উপনির্বাচনে গোটা চারেক আসন বাড়িয়ে নিয়েছে বিজেপি। হেরেছেন মদন মিত্র। এগুলির সব কিছুরই গুরুত্ব রয়েছে আগামী দিনে রাজ্যের রাজনীতির গতিপথের প্রেক্ষিতে।

কেন্দ্রে প্রবল শক্তিশালী বিজেপি সরকার। আর আজকের পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল এবং বিজেপি তুল্যমূল্য লড়াই করছে। এই লোকসভা ভোটের হিসেবে ২৯৪-এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ১৫৮টি বিধানসভায় তৃণমূলের আর ১২৯টিতে বিজেপির আধিপত্য। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন তাই এক অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় রাজনৈতিক লড়াই হতে চলেছে। এবং এখনও পর্যন্ত এ রাজ্যের ক্ষেত্রে লড়াইটা প্রায় দ্বিমুখী দাঁড়িয়ে গেছে। কেবল আশা থাকবে, লড়াইটা যেন রাজনৈতিকই থাকে। মারামারি, গণ্ডগোল, এমনকী মণীষীদের মূর্তি ভাঙার ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়।

সূত্র  ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস