• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ২৬, ২০১৯, ০১:২৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ২৬, ২০১৯, ০১:৪২ পিএম

লোকসভা নির্বাচন কড়চা

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের মূলোৎপাটন ও গেরুয়া বিপ্লবের নেপথ্যে

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের মূলোৎপাটন ও গেরুয়া বিপ্লবের নেপথ্যে
মমতা বন্দোপাধ্যায়

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সকল চেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণ করে ভারতের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলো নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) জোট। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতজুড়ে শুরু হওয়া গেরুয়া ঝড় এবারে আরও প্রলঙ্করী রূপে আঘাত হেনেছে প্রতিপক্ষ শিবিরে। তবে সে আঘাতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দুর্জয় দুর্গ হিসেবে খ্যাত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য।  ২০১১ সাল থেকে বামদের হটিয়ে রাজ্য পঞ্চায়েত, বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনের প্রতিটি পর্যায়ে উপর্যুপরী জয়লাভে এ অঞ্চলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত হওয়া মমতার তৃণমূল কংগ্রেসকে এবার বেশ জোর ধাক্কাই দিয়েছে মোদীর গেরুয়া বাহিনী। আর তাতে এবারের লোকসভা নির্বাচনে জান বাঁচলেও মান বাঁচেনি তৃণমূলের। 

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাংলা থেকে মাত্র ২টি আসন জিতেছিল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। তবে ১৮ টি আসন জিতে সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যকে বামশূন্য করে তৃণমূল কংগ্রেসের কপালেও চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিল গেরুয়া বাহিনী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি নিজের দুর্গ রক্ষা করবেন এবং কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু দেশটির রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, মাত্র ৫ বছরে বিজেপির আসন সংখ্যা ২ থেকে ১৮ তে উঠে আসার ঊর্ধ্বমুখী পরিসংখ্যানটি সুস্পষ্টভাবেই এই বার্তা দিচ্ছে, রাজ্যে মমতার একচ্ছত্র আধিপত্যের দিন ফুরিয়ে এসেছে।

পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের এমন ভোট বিপর্যয়ের কারণ কী? আর কোন মন্ত্রে বিজেপির বঙ্গ-বশীকরণ সফল হলো? এমন প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে যে বিষয়গুলো সামনে চলে আসে তার অধিকাংশের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, গত কয়েক বছরে মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি ক্রমাগত বাংলার মানুষের অনাস্থা সৃষ্টির প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই অনাস্থা সৃষ্টির মূল কারণগুলোর সাথে কার্যত সম্পৃক্ততা রয়েছে খোদ তৃণমূলের দলীয় প্রধান ও দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের।

|| মমতার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও মোদীর অহিংস প্রতিরোধ
রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও নির্বাচনি লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে তৃণমূলের প্রচারণায় দলের ভাবমূর্তি রক্ষার প্রচেষ্টার চেয়ে বিজেপিকে আক্রমণের প্রবণতাই বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে এবার। এক্ষেত্রে একাধিকবার অশালীন ভাষা ও উক্তির মাধ্যমে বিজেপি প্রধান নরেন্দ্র মোদীকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আক্রমণের যে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন মমতা তা রীতিমত আপত্তিকর ছিলো। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি নূন্যতম সৌজন্যবোধ বিবর্জিত এ সকল আচরণের বিপরীতে মোদীর কৌশলী চালে বাজিমাত করেছে বিজেপি। যেমন- রাফায়েল যুদ্ধবিমান ক্রয়ে দুর্নীতির দাবি তুলে মোদীর ‘চৌকিদার’ তকমাকে বিকৃত করে ‘চৌকিদার চোর হ্যা’ স্লোগান দিয়েছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী। কিন্তু সেটিকে একেবারে যা-তা ভাবে প্রয়োগ করেছেন মমতা ও তার দলের নেতারা। শুধু তাই নাই, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পারিবারিক ইস্যুতেও কটাক্ষ করা হয়েছে তাকে।মোদীর দাঁত ভেঙে দেয়া বা ‘গালে জোর থাপ্পড়ে’র মত অযাচিত ভাষাও ব্যবহার করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই মোদীর সুস্থির পদক্ষেপ এবং ‘দিদির থাপ্পড়ে আশীর্বাদ’-এর মতো কৌশলী জবাবে দুই দলের দুই সুপ্রিমোর ব্যক্তিত্বের উপস্থাপন ঠিকই নজরে এসেছে সাধারণ মানুষের। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে ‘ব্যক্তি পর্যায়ে’ সাধারণ মানুষের বিবেচনায় একজন নেতা হিসেবে মমতার রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরাণয়তার বিপরীতে মোদীর এই অহিংস প্রতিরোধ তাকে অনেকটাই এগিয়ে রেখেছে। 

|| মমতার জোট বদলের রাজনীতি
সুনির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক দর্শনের ধারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন তৃণমূল প্রধান মমতা বন্দোপাধ্যায়। কখনও বামেদের মোর্চা তো কখনও সর্বভারতীয় কংগ্রেস। আবার ক্ষমতার স্বপ্নসারথি হিসেবে আজকের শত্রু বিজেপির রাজনৈতিক সহযাত্রী রূপেও আবির্ভূত হয়েছেন রাজনীতির মাঠে। নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন যে আসলে কোনও ঘরানার রাজনৈতিক চর্চাকে নিজেদের দর্শন হিসেবে ধারণ করেছে দলটি। আর তাই বাংলাজুড়ে ব্যক্তি মমতার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকলেও তৃণমূলের রাজনৈতিক আদর্শ ও নেতৃত্বের দিকহীন দর্শনের কারণে ক্রমেই খর্ব হয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা। আর সেটা ঠিক কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তা এবারের ভোট বিপর্যয়ে স্পষ্টভাবেই ওঠে এসেছে।     

|| মমতার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক তোষণের রাজনীতির অভিযোগ
পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই এ অঞ্চলের বিশাল ভোটব্যাংক হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে। তবে বিজেপি শুরু থেকেই বাংলায় মুসলিম তোষণ নিয়ে রাজনীতি করছে, তৃণমূলের এমন দাবির বিপরীতে মূলত তাদের মাঝেই দেখা গেছে এই প্রবণতা।  রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি নিজের মমতা প্রদর্শন করতে গিয়ে অতিরঞ্জিত আচরণ প্রদর্শন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের স্পর্শকাতর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতি নয় বরং চরম রাজনৈতিক স্বার্থপরতার বিষয়টিই সামনে নিয়ে এসেছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। যা তার প্রতি বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়কে যেমন খেপিয়ে তুলেছে তেমনি স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে তৃণমূলের ‘মুসলিম প্রীতি দর্শন’ মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে সুস্পষ্ট প্রহসন হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বিজেপিই সর্বপ্রথম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর তোষামোদের রাজনীতিতে অভিযোগ করেছে। তাদের অভিযোগ ছিল- মমতা শুধু মুসলমানদের জন্যই চিন্তিত, হিন্দুদের জন্য নয়। ইমামকে পেনশন দেয়া হচ্ছে। কিন্তু হিন্দু ধর্মের পণ্ডিতদের জন্য কিছুই করা হয় না। এর মধ্যে সব অভিযোগই যে সঠিক ছিল তা নয়। কিন্তু নির্বাচনি রাজনীতিতে আবহ তৈরি করার ইস্যু হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টিকে নিজেদের প্রতি সমর্থন আদায়ে সফল হয়েছে বিজেপি।

|| চুপচাপ পদ্মে ছাপ
পশ্চিমবঙ্গ থেকে মার্কসবাদী বামেদের উৎখাত করতে চেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্লোগান তুলেছিলেন চুপচাপ ফুলে ছাপ। এই স্লোগানকে ভারতীয় জনতা পার্টি আপন করে নিয়েছে। এই বার ফুল ছাপের জায়গায় শুধু পদ্মে ছাপ যুক্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি নির্বাচনেই সহিংসতা সৃষ্ট হয়। আর বিজেপি এই বিষয়টিকেও ব্যবহার করে নিজেদের ভোটবাক্স ভরেছে।  বিজেপি প্রার্থী ও কর্মীদের প্রতি তৃণমূল কর্মীদের আগ্রাসী আচরণকে সফলভাবে উষ্কে দিয়ে তাদের রীতিমত বেকায়দায় ফেলে নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের সুনিশ্চিত পন্থাই সৃষ্টি করেছিলো গেরুয়া সেনারা।   

|| মমতা ও তৃণমূল বিরোধী ভোটে বিজেপির ভোটবাক্স ভরা
পঞ্চায়েত নির্বাচনেই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিক্ষোভের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। তাতে করে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসকে কোনও দল চ্যালেঞ্জ করতে পারলে, সেটি একমাত্র বিজেপিই পারে।  এর ফলে মমতা বিরোধী ভোটাররা বিজেপির বোতামেই আঙুল রেখেছে।  পরিস্থিতি এমনই যে ২০১১ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে  নিজেদের শাসন কায়েম করা বামেদের উৎখাতের মূল কারণ মমতার তৃণমূলের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে ভোটে বিজেপিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বামপন্থী ঘরানার ভোটাররা। এখন ক্ষমতাসীন বিজেপিই রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল যা তৃণমূলের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।

|| রাজনীতিতে রামায়ণ ও 'জয় শ্রী রাম'
পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুজা নিয়ে যারা গর্ব করতেন, গত কয়েক বছরে তাদের ভাবাচ্ছেন রামনবমীর ধুম আর ডিজে বাদ্যের বুক কাঁপানো ‘জয় শ্রী রাম' ধ্বনি। বিজেপির কৌশল পরিষ্কার ছিল- তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হিন্দুবিরোধী প্রমাণ করে এবং মুসলিম তোষণের ইস্যু সামনে রেখে বিজেপি হিন্দুদের সপক্ষে কথা বলার নির্ভরযোগ্য ঠিকানা হয়ে ওঠবে। ফলাফল বলছে, মোদী-শাহের নেতৃত্বাধীন দল এ ব্যাপারে পুরোপুরি সফল হয়েছে রাজ্যে। আর আগ্রাসী আচরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই বিজেপিকে সাহায্য করে ফেলেছেন।

|| বিভাজনের রাজনীতি
তৃণমূল, বাম, কংগ্রেস-সহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে বিজেপিএ বিরোধী মোর্চা তৈরির লক্ষ্যেই ব্রিগেডের জনসভার আয়োজিত হয়েছিল। কিন্তু মমতার একতান্ত্রিক আচরণে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে বিরোধী জোটকে সাথে নিয়ে সমন্বিত নেতৃত্বে নয় বরং নিজের অধীনস্থ হিসেবে অন্যদের কাছে টানতে চেয়েছিলেন মমতা। ফলে ঐক্যের মঞ্চেই ওঠে ভাঙনের সুর। অপরদিকে বিজেপি তার শরীক দলগুলোর প্রতি উদার মনোভাব প্রদর্শনে তৃণমূলের জোট সঙ্গীদের মনে আক্ষেপের বান টানে। এতে করে ‘মমতাবাদী’ শরীক দলগুলোর অনেক নেতাই নিজেদের হাই কমান্ডের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। তাদের একাংশের ভোটও এবার বিজেপির বাক্সেই ঠাঁই নিয়েছে যা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে।     

|| শক্তিশালী বিরোধী শক্তির অভাব
কংগ্রেস নেতা-কর্মী-বিধায়করা গত কয়েক বছরে দলে দলে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন৷ বামেরাও ক্রমশ দুর্বল হয়েছে৷ দাপট বাড়িয়েছে তৃণমূল। রাজনীতিতে বিরোধী স্থান শূন্য থাকে না৷ তাই বাম ও কংগ্রেসকে টপকে চতুর্থ থেকে দ্বিতীয় শক্তির দিকে উত্থান হচ্ছে বিজেপির৷ 

দুর্বলতার কথা স্বীকার করে সিপিএম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য বলেন, তৃণমূলের সন্ত্রাসে আমাদের সংগঠন অনেক জায়গায় দুর্বল হয়েছে৷ ভয় দেখিয়ে, ভুয়া মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে নেতাদের। তাই সমর্থকদের একটা অংশ মনে করছে, তৃণমূলের বিরুদ্ধে আমরা লড়াইয়ের জায়গায় নেই। বিজেপি সেই সুযোগটা নিয়েছে।

|| তৃণমূলের হাইকমান্ড থেকে নিচতলা পর্যন্ত দুর্নীতি
শাসক দলের তাবড় নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে৷ নারদ কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে সারদা প্রজেক্ট কেলেঙ্কারি প্রতিটি ক্ষেত্রেই মমতাসহ তৃণমূল নেতাদের একটি বিশাল অংশের সম্পৃক্ততা দলটির প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থার হার ক্রমশ বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া নিচুতলার তৃণমূল কর্মীরা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দিতে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ ছিল। আর তাদের এই অভিযোগ যে সত্য ছিল তা সত্য করেই যেন পদ্ম ফুটেছে বাংলায়। আর নানা পর্যায়ে প্রশাসনিক ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে তৃণমূল নেতৃবৃন্দ ও তাদের অনুসারীদের উদ্ধত আচরণ ও দুর্ব্যবহার তো রয়েছেই।

এর ফলে জঙ্গলমহলসহ বিভিন্ন জেলায় বিজেপি গত বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচনে চমকপ্রদ ফল করেছে৷ এর মধ্যে অনেক স্থানেই সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি নগণ্য, মেরুকরণ ছাড়াই প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার ফলে বিজেপি ভালো ফল করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ এই ত্রুটি স্বীকার করে নেন পুরুলিয়া কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মৃগাঙ্ক মাহাতোও৷ পেশায় চিকিৎসক মৃগাঙ্ক বলেন, একশ্রেণির কর্মীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ ছিল৷ সে কারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়৷ তার প্রতিফলন পঞ্চায়েত ভোটে দেখা গিয়েছে৷ তবে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি৷ দল অনেককে এ জন্য বহিষ্কার করেছে।

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিল তৃণমূল৷ যেখানে ভোট হয়েছে, তার অধিকাংশ স্থানে গ্রামীণ জনতা ভোট দিতে পারেনি বলে অভিযোগ। একটা বড় অংশের মানুষ তৃণমূলের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল এ কারণে। তাদের ভোট শাসকদলের বিরোধী হিসেবে বিজেপির দিকে টেনে নিয়েছে।

|| নেতা কেনে তৃণমূল?
শাসক দলের সঙ্গে বিজেপি কর্মীদের সংঘাত হচ্ছে চতুর্দিকে। তৃণমূলের ইটের জবাবে পাটকেল ছুড়তে সক্ষম বিজেপিই তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ার মতো ক্ষমতাধর বলে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিরোধীদের কাছে। তাই বাম ও কংগ্রেস সমর্থকরা মোদী বাহিনীর দিকে ঝুঁকেছেন৷ তারা মনে করছেন, তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে বিজেপিই। মুর্শিদাবাদ, মালদার মতো পুরুলিয়াতেও কংগ্রেস কোনমতে তাদের সংগঠন টিকিয়ে রেখেছে। দলটির জেলা সভাপতি নেপাল মাহাতোর মতে, ‘মানুষ তৃণমূলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। তারা চাইছে যে কোনোভাবে তৃণমূলকে হারাতে৷ জনতা মনে করছে, শাসককে হারানোর জোর বিজেপিরই রয়েছে৷ তাই তারা পঞ্চায়েতে কংগ্রেস, বামের বদলে বিজেপির দিকে ঝুঁকেছে৷ আমাদের নেতাদের কিনে নিয়েছে তৃণমূল। সাংগঠনিক দুর্বলতার এই সুযোগ পুরো নিয়েছে ওরা৷ সে দিক থেকে আমরা ব্যর্থ অবশ্যই৷

|| রাজ্যে গণতান্ত্রিক পরিসরের সঙ্কোচন
বিরোধীরা অহরহ অভিযোগ তোলে পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিরোধী কণ্ঠের স্বর ক্রমশঃ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে তৃণমূলের আমলে৷ এই পরিস্থিতিতে অনেকে বিজেপির হাত ধরছেন। অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দের মতে, তৃণমূল উন্নয়ন করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এমনটাই বার্তা দেয়া হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী তার আচরণে বোঝাচ্ছেন, তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। বিরুদ্ধাচরণ তিনি বরদাশত করবেন না। 

সব মিলিয়ে বিজেপির ভোট এ বার অনেকটাই বাড়বে বলে যে ধারনা করা হচ্ছিলো বাস্তবে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। তবে তার প্রভাব যে তৃণমূল কংগ্রেসের রঙ এতটা ম্লান করে দেবে তা হয়ত ভাবেনি কেউ।

|| তৃণমূল নেতাদের ঔদ্ধত্যে তৃণমূলের শনির দশা 
এবারে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের যতোটা না জনপ্রিয়তা রাজ্যে রয়েছে, তার চেয়ে বেশি ভয় কাজ করছে মানুষের মনে। নির্বাচনি প্রচারে রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা ময়দান কাঁপালেও আমজনতা অদ্ভুতভাবে নিশ্চুপ। ভোট নিয়ে কেউই সেই অর্থে মুখ খুলতে রাজি নয়। রাজ্যটির রাজনৈতিক মহলের মতে, তৃণমূলের এই জনপ্রিয়তা হারানোর মূল কারণ দলের নিচু স্তরের নেতা-নেত্রীরা। 

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য নেতৃত্বের প্রথম সারির কিছু নেতা-নেত্রীকে বাদ দিলে জেলা ও ব্লক স্তরে একটি বড় অংশের তৃণমূল নেতাদের খবরদারি কার্যত অসহনীয় হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের কাছে। বামেদের সময় যেভাবে কথিত কমরেডদের রক্তচক্ষু মানুষকে ভীত করে তুলতো, ঠিক একই কায়দায় এই আমলেও রাজ্যের বহু স্থানে তৃণমূলের ছোট মাপের নেতা-নেত্রীরা হয়ে উঠেছেন এলাকার স্বৈরশাসক।

সেই সঙ্গে বাম আমলের কুখ্যাত কমরেডদের বাছ-বিচার না করে জেলায় জেলায় শাসক শিবিরে ঢুকিয়ে নেয়াটাকেও ভালো চোখে দেখেনি সাধারণ মানুষ। বাম আমলে যাদের বিরুদ্ধে বিরক্ত হয়ে মানুষ তৃণমূলকে ক্ষমতায় এনেছিলো, এখন রাজ্যের বহু ক্ষেত্রে সেই সমস্ত বাম আমলের দাগী নেতারাই তৃণমূল নেতাদের ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠেছে। ফলে স্বভাবতই মানুষ চুপচাপ শাসক শিবিরের থেকে মুখ ঘোরাতে শুরু করে দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতেই পশ্চিমবঙ্গে এবার গেরুয়া প্রলয়ে ভেসেছে মমতার দল। 

|| পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় আটটি অর্থ কেলেঙ্কারিতে তৃণমূলের সম্পৃক্ততা 

রাজ্যের আলোচিত আটটি অর্থ কেলেঙ্কারির প্রায় প্রতিটির সাথে জড়িয়ে তৃণমূল নেতাদের নাম। যা নাড়িয়ে দিয়েছে বাংলার মানুষের আস্থা। এর মাঝে চারটি বাম আমলের যার মূল হোতাদের অনেকেই এখন মমতাবাদী। আর অপর চারটি তৃণমূল আমলের যার একাধিক ক্ষেত্রে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর জড়িত থাকার কথাও শোনা যায়। এগুলো হলো- (১) সারদা কেলেঙ্কারি (কয়েকশো কোটি টাকা, সঠিক হিসেব আজও নেই), (২) নারদ কেলেঙ্কারি (স্টিং অপারেশন), (৩) রোজভ্যালি কেলেঙ্কারি (কয়েক হাজার কোটি টাকা), (৪) ত্রিফলা কেলেঙ্কারি (কয়েক কোটি টাকার), (৫) আলু কেলেঙ্কারি (হিসেব নেই), (৬) আবাসন কেলেঙ্কারি (আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা), (৭) ওয়াকফ কেলেঙ্কারি, (৮) বামফ্রন্ট আমলের লোহাচুর কেলেঙ্কারি, (৪৫০ কোটি টাকা)।

|| বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার রাজনীতিতে বিজেপির মাত

কলকাতায় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের নির্বাচনি প্রচারণার রোড শো চলাকালীন তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষে কলেজ স্ট্রিট সংলগ্ন বিদ্যাসাগর কলেজ ভাঙচুর ও বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় রাজ্যজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস পরস্পরকে এই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আনতে থাকে। তবে শেষ অবদি জানা যায় যে, রাস্তায় অবস্থান নেয়া বিজেপিকর্মীরা তালাবদ্ধ বিদ্যাসাগর কলেজের মূল ফটকের বাইরে অবস্থান নিয়ে ছিলো আর কলেজের ভেতরে ছিলো তৃণমূল ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা। মূর্তিটি যেহেতু কলেজের ভেতরে ছিল তাই মূল ফটকের বাইরে থাকা বিজেপি কর্মীদের হামলায় সেটি ভাঙার কাল্পনিক গল্প আর ধোপে টেকেনি। বরং বিরোধী দলকে কূটরাজনৈতিক চালে ফেলার জন্য বিদ্যাসাগরেরে মূর্তি ভাঙার মতো ন্যাক্কারজনক কাজে তৃণমূলের প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাংলার জনগণ। পরে কাজটি যে তৃণমূল কর্মীদের তা স্বীকার করে নেন তৃণমূল কংগ্রেসের এক জ্যেষ্ঠ নেতাও। আর এতে করে বিজেপির জন্য পাতা ফাঁদে নিজেরাই মাত খায় মমতার রাজ্য কংগ্রেস।

এ সবের পাশাপাশি তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের মতে আরও কিছু বিষয় এবারের নির্বাচনে বাংলা থেকে তৃণমূলের মূলোৎপাটন ও গেরুয়া শিবিরের উত্থানের পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

প্রথমত, রাজ্যে ব্যাপক মেরুকরণ রয়েছে। সেই মেরুকরণের ফায়দা তুলেছে বিজেপি। ২০১৪ সালে ১৭ শতাংশ ভোট ছিল বিজেপি। বামেদের ছিল ২৭ শতাংশ। বাম ভোটের কার্যত পুরোটাই চলে গিয়েছে রামে।

দ্বিতীয়ত, পঞ্চায়েত ভোটে হিংসার জেরে জনমত প্রতিফলিত হয়নি বলে মনে করছে তৃণমূল। আর সে কারণে দলের বাস্তব অবস্থা ঠাওর করা যায়নি। মানুষ ভোট দিতে না পারার শোধ তুলেছে লোকসভা ভোটে।

তৃতীয়ত, স্থানীয় নেতাদের গোষ্ঠীকোন্দলও দলকে ভুগিয়েছে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলে বহু এলাকায় এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি। এর পাশাপাশি সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণে বিজেপির উত্থানের রিপোর্টও ঠিকমতো আসেনি উপরতলায়।

চতুর্থ, কমবয়সী যুবকদের হাতে এখন তৃণমূলের রাশ।  আর সে কারণে অভিজ্ঞতার অভাব চোখে পড়েছে সংগঠনে। কম বয়সি নেতাদের ঔদ্ধত্য মেনে নিতে পারেননি মানুষ।

পঞ্চম, দল অতিরিক্ত প্রশাসন নির্ভর হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের চোখে দল দেখছেন নেতারা। আর তাতে সংগঠনে একাধিক ফাঁক-ফোকর তৈরি হয়েছে। অনেকটা বিদায় বেলার বামফ্রন্টের মতো।

ষষ্ঠ, রাজ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মোদী-শাহ। একাধিক সভা করেছেন। তার ফায়দা লুটেছে বিজেপি।  মোদীর অতিবড় সমালোচকও স্বীকার করেন, বর্তমানের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে জনপ্রিয় নেতা আর কেউ নেই।

সপ্তম, তপশিলী জাতি-উপজাতি ও মতুয়াদের ভোট নিয়ে চলে গিয়েছে বিজেপি। যা চমকে দিয়েছে তৃণমূলকেও।      

অষ্টম, পুরুলিয়া-সহ বিভিন্ন এলাকায় আবাস যোজনা বা অন্য সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের থেকে কাটমানি নিয়েছেন তৃণমূল নেতারা। এতে বীতশ্রদ্ধ হয়েছেন মানুষ।

সবিশেষ এ কথা বলাবাহুল্য, লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পর একটা জিনিস স্পষ্ট, বাংলায় বিজেপি আর প্রান্তিক শক্তি নেই। বরং শাসক দলের চ্যালেঞ্জার হিসেবে প্রবলভাবে উঠে এসেছে তারা।

একই সঙ্গে মমতা সরকারের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিও তৃণমূল থেকে মানুষের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে। চিটফান্ডের মাধ্যমে বহু মানুষের অর্থ তুলে নেয়ার ঘটনা রাজ্যের জনগণের মনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যার নিরব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছে ব্যালটের মাধ্যমে।

এসকে/এসএমএম