• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০১৯, ০২:৫১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ৭, ২০১৯, ০৫:২৩ পিএম

কাশ্মীরের ‘ভারতীয়ত্ব’ নয়, ভারতের ‘কাশ্মীরায়ন’

কাশ্মীরের ‘ভারতীয়ত্ব’ নয়, ভারতের ‘কাশ্মীরায়ন’

কাশ্মীরে একটি কঠোর অবস্থান নেয়ার যৌক্তিক প্রেক্ষিতটি পরিচিত বলে মনে করছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’। তাদের সম্পাদকীয় বিশ্লেষনে বলা হচ্ছে, ভারত সরকারর মনে করছে ৩৫(ক) ধারা বৈষম্যমূলক, সুতরাং তার অবলুপ্তি প্রয়োজন। ৩৭০ ধারা মোটেই অখণ্ডতার স্বার্থে নয়, বরং আইনি পথে বিচ্ছিন্নতাবাদের লড়াইয়ে অনুঘটক। ভারত কখনোই রাষ্ট্র হিসাবে কাশ্মীর ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নিতে পারেনি। সুতরাং কাশ্মীরে মৌলবাদ দমনে কঠোর পদক্ষেপ জরুরি। বিতাড়িত কাশ্মীরি পণ্ডিতরা বহুকাল ধরে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির চালচিত্রও এখন সুবিধেজনক। চীন যা করছে, ভারতও করতেই পারে। সমাজ, সংস্কৃতি, সবই পুনর্গঠন করতে পারে। পাকিস্তান আর তালিবানদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে নিজেদের শক্তি। দ্বিধাহীনতা কাটিয়ে ওঠার এই তো সময়। দরকার হলে নির্মম ভাবে শক্তি প্রয়োগ করেও সমস্যাটা মিটিয়ে ফেলার এটাই প্রকৃষ্ট সময়।

উপরোক্ত যুক্তিগুলিতে কিছুটা সত্যতা অস্বীকার করা যাবে না। কাশ্মীরের স্থিতাবস্থাটা অনেকটা ‘জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সামরিক বাহিনীর দাপুটে উপস্থিতিতে কিছুই লাভ হয়নি কাশ্মীরিদের। বরং বাকি দেশের সঙ্গে কাশ্মীরের ‘দূরত্ব’ ক্রমে বেড়েই চলেছে। একটা ঝাঁকুনি অবশ্যম্ভাবীই ছিল। কিন্তু মুশকিল হল, হীন এবং অশুভ উদ্দেশ্যের আবরণ পরানো হচ্ছে এই সত্যতায়। সমস্যার সমাধানে তোয়াক্কা করা হচ্ছে না সৌজন্য-শিষ্টাচারের। রাতের অন্ধকারে, সেনা নামিয়ে, চূড়ান্ত গোপনীয়তায় যে ভাবে ঘটল কাশ্মীরের ঘটনাক্রম, তা অশুভ উদ্দেশ্যেরই পরিচায়ক। সাংবিধানিক সমাধানের সূর্যোদয় নয় এটা। এটা আসলে দমন। যা মনে করিয়ে দেয় ‘Reichstag’ বা চীনের সাংবিধানিক আধারকে। যে আধার যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের ক্ষমতায়ন এবং সংস্কৃতির একীকরণের পথে বাধা বলে মনে করে।

প্রস্তাবটির বৃহত্তর তাৎপর্যের কথা ভাবুন। ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি বলছে, দেশটি তার সাংবিধানিক সত্তারই অমর্যাদা করল। কাশ্মীর ছাড়াও দেশে একাধিক অসমঞ্জস যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রয়েছে। কাশ্মীর প্রস্তাব সেগুলিকেও খারিজ করার একটা বুনিয়াদ তৈরি করে দিল। নাগাল্যান্ডে সামঞ্জস্যহীন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো থাকলে কোন যুক্তিতে কাশ্মীর তা থেকে বঞ্চিত হলো? মানে তো এই দাঁড়াল, ইচ্ছে করলে যে কোনো সময় সরকার যে কোনো রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করতে পারে। এটা ভারতীয় সংবিধানের ইতিহাসে এই প্রথম ঘটল। এবং ভারত আদতে পরিণত হল একাধিক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সমষ্টিতে, যার মধ্যে কয়েকটি রাজ্যের মর্যাদা পাচ্ছে স্রেফ সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছায়।

খুব বেশি ভাবারও দরকার নেই অবশ্য এ নিয়ে। আসল কথাটা হল, জম্মু-কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করার নামে অপমান করা হলো একটি অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে, যারা নানাভাবে ইতিমধ্যেই অবদমিত। ভারতে কী করে থাকতে পারে মুসলিম-অধ্যুষিত একটা রাজ্য? কাশ্মীরকে কখনও বিশ্বাস করা যায় ‘রাজ্য’ হিসাবে? অখণ্ডতা বা একীকরণ নয়, এ আসলে দেশের সংখ্যালঘুদের অপমান করা, দেশে তাদের অবস্থানটা কখনও সূক্ষ্ম, বা কখনও কর্কশ ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া।

অপরদিকে সিএনএন তার বিশেষ প্রতিবেদনে বলছে, তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যাক, একটা দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধানের জন্য, শান্তির জন্য এটুকু যন্ত্রণা সহ্য করতেই হবে। কিন্তু সত্যিই কি সমাধান হবে? সামরিক শক্তির দাপটে একটা থমথমে শান্তি বিরাজ করবে, যেটাকে ‘জয়’ বলে ভুল করব আমরা। যে সেনাবাহিনীর গুণগানে আজ ‘দেশপ্রেমিকরা’ মুখরিত, সেই সেনাদেরই ক্রমশ আরও বেশি করে নেতিবাচক কাজে লাগানো হবে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার নামে। এবং যদি বাধ্যতই মেনে নিতে হয় সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা, সেই বাহিনীকে তো এমন একটা রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় কাজ করতে দিতে হবে, যা ভয়ের উদ্রেক করে না। যদি কাশ্মীর বর্তমান পরিস্থিতিকেই ভবিতব্য বলে মেনেও নেয়, দেশের অন্যত্র মৌলবাদের বিস্তারের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বস্তুত, সেই বিস্তারের লক্ষণগুলি এখনই স্পষ্ট। রাজনৈতিক হিংসার মঞ্চে উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালার সাম্প্রদায়িক ভাবে স্পর্শকাতর অংশগুলি জায়গা করে নেবে। আরও ভঙ্গুর দেখাবে ভারতকে।

দেখাবে, কারণ, একেবারে মৌলিক স্তরে ভারতীয় গণতন্ত্র ব্যর্থতার দিকে ক্রমে অগ্রসর হচ্ছে। আধিপত্যবাদের দিকে এগোচ্ছে দেশ, যেখানে ভোটের শক্তিই শেষ কথা, যেখানে বিরুদ্ধ মতের অন্তর্ভুক্তি স্বাগত নয়। দুর্বল এবং দিশাহীন বিরোধীশক্তি এই প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিতই করবে। রাজনৈতিক প্রতিবাদের মঞ্চগুলি ক্রমে নিশ্চিহ্নপ্রায়। তথাকথিত ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়’ কাঠামোয় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলি মেরুদণ্ডহীনতায় একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। কংগ্রেস তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে বহুদিন। সংসদ এখন আর তর্কের মঞ্চ নয়, পরিণত হয়েছে নোটিস বোর্ডে।

অপরদিকে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি বিশ্লেষনধর্মী লেখায় বলা হচ্ছে দেখা যাক, সুপ্রিম কোর্ট কী করে। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে, সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে প্রশাসনের চেয়েও প্রশাসন-মনস্ক হয়ে উঠবে। কাশ্মীরের ঘটনাপ্রবাহ শুধু কাশ্মীরেই সীমায়িত নয়; ইউএপিএ, এনআরসি, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং অযোধ্যা ইস্যুর প্রেক্ষিতে ভাবলে কাশ্মীর হলো একটা বৃহত্তর নকশায় আরও একটি বুনন। যে নকশা দেশকে এমন একটা পরিণতির দিকে ঠেলে দেবে, যেখানে শুধু কাশ্মীরিরা নয়, শুধু সংখ্যালঘুরা নয়, যারা সাংবিধানিক স্বাধীনতা এবং অধিকারের পক্ষে দাঁড়াবেন, তারা কেউই নিরাপদ থাকবেন না।

সমাজ-সংস্কৃতির যে কাঠামোর মধ্যস্থতায় এসব সম্ভব হচ্ছে, সেটা আরো বেশি উদ্বেগের। মিডিয়ার সহায়তায় তৈরি হয়েছে এক এমন প্রচারযন্ত্র, রক্তপিপাসাকে যা জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সমার্থক করে তুলছে। মানবিক আবেগে মরচে পড়ছে এতটাই, যে সম-অনুভূতির তুলনায় হিংসাকে বেশি কাঙ্খিত মনে হচ্ছে। বিকল্প রাস্তা খোঁজার ব্যাপারে প্রবল রাজনৈতিক অনীহা দৃশ্যমান। সমস্যা সমাধানের চিরাচরিত ‘কংগ্রেসি’ পন্থাকে এতটাই বস্তাপচা আর স্বার্থান্বেষী মনে হচ্ছে, যে যাবতীয় প্রতিষ্ঠান এবং নৈতিকতার ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়াকেও তুলনায় বেশি গ্রহণীয় দেখাচ্ছে। এক ‘নিষ্ঠুর নান্দনিকতা’ গ্রাস করেছে ভারতে রাজনীতিকে। যেখানে সমাদৃত হচ্ছে উদ্ধতের আস্ফালন, এবং ধিক্কৃত হচ্ছে সাধারণ সুকুমারবৃত্তি। স্রেফ ‘সাধারণ’ বলেই!

বিষয়টা কিন্তু একটা সমস্যার সমাধানে আর সীমাবদ্ধ নেই। কাশ্মীরে যা ঘটছে, তা বস্তুত এক মহান সভ্যতার মননে চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতার প্রতিফলন। বিজেপি-র ধারণা, তারা কাশ্মীরের মধ্যে ‘ভারতীয়ত্ব’ বুনে দিচ্ছে। ঘটবে কিন্তু উল্টোটাই, ভারতের সম্ভাব্য ‘কাশ্মীরায়ন’। মনে রাখতে হবে, ভারতীয় গণতন্ত্রের কাহিনি আসলে রক্তপাত এবং বিশ্বাসঘাতকতার।

সূত্র : মার্কিন ও ভারতীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যম

এসজেড