• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০১৯, ০৫:৩৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ১৩, ২০১৯, ০৫:৪৮ পিএম

ফিদেল কাস্ত্রোর জন্মদিন আজ

সমাজতান্ত্রিকতার এক বিপ্লবী মহানায়কের কথা

সমাজতান্ত্রিকতার এক বিপ্লবী মহানায়কের কথা

সারা বিশ্বের বুকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কিংবদন্তী মহানায়ক হিসেবে পরিচিত, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে নিরন্তন সংগ্রাম পরিচালনাকারী এক অদম্য যোদ্ধার নাম ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো রুৎ। আজ এই বিপ্লবী নায়কের শুভ জন্মদিন।

কাস্ত্রো এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি সারাজীবন জোয়ারের প্রতিকূলে সাঁতরে পারে উঠেছেন। গণমানুষের ন্যায্য প্রাপ্তি আদায়ের লক্ষ্যে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের এই পুরোধা-ব্যক্তিত্ব জীবনভর লড়াই চালিয়ে গেছেন। আর সুদীর্ঘ প্রায় ৫০টি বছর ধরে ধনতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে সমাজতান্ত্রিক পন্থা মেনে শাসন করেছেন কিউবা।

কিউবার সশস্ত্র বিপ্লবের নেতৃত্বে কাস্ত্রো- ছবি: ইন্টারনেট

রাজপথের একজন লড়াকু সৈনিক থেকে হয়েছিলেন কিউবার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মহানায়ক। প্রথমে ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত কাস্ত্রো কিউবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে ১৯৭৬ সাল থেকেই ২০০৮ সাল পর্যন্ত একটানা কিউবার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব সামলেছেন। নানা সময় কাস্ত্রর বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ উত্থাপনের প্রয়াস চালানো হলেও শেষ পর্যন্ত গণ মানুষের কাণ্ডারী হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব অর্জন করেছেন তিনি। একনজরে দেখে নিন সমাজতন্ত্রের এই প্রাণপুরুষের জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি। 

ফিদেলের জন্ম: ১৯২৬ সালের ১৩ অগাস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলে বিরান জেলায় স্পেনীয় বংশোদ্ভূত এক উদ্বাস্তু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কাস্ত্রো। তাঁর পিতা আখের চাষ করতেন। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়ার সময় ফিদেল কাস্ত্রোর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। 

 মার্কিন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই: পঞ্চাশের দশকে মার্কিন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কিউবায় সমাজতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে কাস্ত্রোর অবদান অপরিসীম বলে মনে করা হয়। অনেকে সেজন্য তাঁকে সমাজতন্ত্রের প্রবাদপুরুষ বলেও আখ্যায়িত করেন।

বাঁ থেকে- মুক্তিকামী বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিশেষ মুহূর্তে কাস্ত্রো- ছবি: ইন্টারনেট    

• রাজনৈতিক জীবনের শুরু: ১৯৪৭ সালে নবগঠিত কিউবান পিপলস পার্টিতে যোগ দেন ফিদেল। আর এর মধ্যদিয়েই শুরু হয় তার পেশাদার রাজনৈতিক জীবনের। মার্কিন ব্যবসায়ী শ্রেণি ও সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবিচার, নিম্ন মজুরি দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে লড়াইয়ে নামেন ফিদেল। আর সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করেন তিনি। যে এক পর্যায়ে তাকে সেরাদের সেরা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

• কিউবায় সামরিক অভ্যুত্থান: ১৯৫২ সালে দলীয় কংগ্রেসের সদস্য প্রার্থী হন ফিদেল। নির্বাচনে পিপলস পার্টির বিজয়ের সম্ভাবনা থাকলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে কিউবার তৎকালীন জেনারেল বাতিস্তা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিউবার ক্ষমতা দখল করলে নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। 

• ফিদেলের কারাবাস: রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে যখন বিপ্লবই একমাত্র পথ হিসেবে নির্ধারিত হয় তখন এই ভাবনা থেকেই ১৯৫৩ সালে মনকাডা সেনা ব্যারাকে হামলা চালান ফিদেল ও তাঁর সহযোগীরা। সেই ঘটনায় ফিদেল পরাস্ত হন এবং তাঁর বহু সহযোদ্ধাকে হত্যার নির্দেশ দেন বাতিস্তা। তবে কোনওভাবে প্রাণে বেঁচে যান ফিদেল। এরপরও তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সেই খবর ফাঁস করে দেওয়ায় ফাঁসি দেওয়া হয় পেলেচিয়ার নামে বাতিস্তা সরকারের এক ক্যাপ্টেনকে। পরে জনমতের কথা ভেবে বিচারের ব্যবস্থা করে বাতিস্তা সরকার। 

বিপ্লবী সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপরত কাস্ত্রো- ছবি: ইন্টারনেট

• সাজা শেষের আগেই মুক্তি: আদালতে দাঁড়িয়েই সে সময় দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের কথা জানিয়ে দীর্ঘ এক ভাষণ দেন তিনি। তার এই ভাষণ যেন কিউবান জনতার হৃদয়ে বিপ্লবের উৎসারণ ঘটায়। ফলে ১৫ বছরের সাজা ঘোষণা হলেও প্রবল জনমতের চাপে মাত্র ২ বছরের কারাভোগ শেষেই মুক্তি পান কাস্ত্রো। তারপরই বিপ্লবী দল গড়তে মেক্সিকোয় পাড়ি দেন তিনি। 

• মেক্সিকোয় কাস্ত্রো: মেক্সিকো পৌঁছে একটি গেরিলা বাহিনী তৈরি করেন তিনি। সশস্ত্র দল ও পর্যাপ্ত অস্ত্রভান্ডার মজুত করে সে সময়ে বিপ্লবের  বহ্নিশিখা হিসেবে পরিচিত চে গুয়েভেরা এবং খুয়ান আলমেদার মতো বিপ্লবীদের সঙ্গে নিয়ে কিউবায় ফেরত আসেন কাস্ত্রো। তারপরই শুরু হয় তাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড।

বাঁ থেকে- বিপ্লবী মহানায়ক ফিদেল কাস্ত্রো ও সংগ্রামের আরেক প্রবাদ পুরুষ চে গুয়েভেরা- ছবি: ইন্টারনেট

• বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা: কিউবায় ফিরে এসে ক্ষমতাসীন বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। এবারও বেশিরভাগ গেরিলা সৈন্য সরকারের আক্রমণের মুখে পড়ে প্রাণ হারায়। তবে এসবের মাঝেই ফিদেলের সমর্থনে একজোট হতে শুরু করে কিউবার যুবসমাজ। ফলে বাতিস্তা সরকারের রাগ গিয়ে পড়ে জনগনের উপরে। যার ফলে আরও বেশি করে সমর্থন বাড়তে থাকে ফিদেল কাস্ত্রোর। 

• ঐতিহাসিক 'জুলাই টোয়েন্টি সিক্স মুভমেন্ট': যেদিন কাস্ত্রো মেক্সিকো থেকে কিউবায় এসে পদার্পণ করেন সেই দিনটি ছিল জুলাই মাসের ২৬ তারিখ। সেই অনুযায়ী তাঁর আন্দোলনের নাম হয় জুলাই টোয়েন্টি সিক্স মুভমেন্ট। ১৯৫৮ সালে কিউবার মধ্যবিত্তশ্রেণিও কাস্ত্রোর আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসে। কিউবায় নির্বাচন বাতিলের পর গেরিলা বাহিনীর উপর জেনারেল বাতিস্তার আক্রমণ ও নিপীড়ন আরও বাড়তে থাকে। এ সময় সেনা পাঠিয়েও গেরিলা দমনে সরকার বিফল হয়। এরপরে সারা কিউবা অশান্ত হয়ে উঠলে আমেরিকার নির্দেশে নির্বাচনের ডাক দেন বাতিস্তা। তবে সিংহভাগ জনগণ সেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যাত করে। কিউবার দখল নেন কাস্ত্রো একইসঙ্গে ফিদেলের গেরিলা সৈন্য কিউবার রাজধানী হাভানার দখল নেয়। পরে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি কিউবা ছেড়ে পালান জেনারেল বাতিস্তা।

বাঁ থেকে- বিশ্বব্যাপী বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব নেলসন মেন্ডেলা ও কাস্ত্রো- ছবি: ইন্টারনেট 

এরপরে কিউবান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাতিস্তার অনুসারী সেনা জেনারেলরা সামরিখ অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালালে দেশজুড়ে ধর্মঘট করেন কাস্ত্রো। শত শত সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করলে সামরিক বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে নেয়। এভাবেই সে বছরের ৯ জানুয়ারি দেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেন ফিদেল কাস্ত্রো। 

• দেশের একছত্র রাষ্ট্রনায়ক: এরপরই কিউবার প্রথম সমাজতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী হন ফিদেন কাস্ত্রো। ১৯৭৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব সামলান তিনি। ২০০৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের পর ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। এখন রাউলই কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান। 

এভাবেই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই করে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন কিউবার এই মহান কমিউনিস্ট নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। ২০১৬ সালের ২৬ নভেম্বর সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রাণপুরুষ ফিদেল কাস্ত্রো পরলোকগত হন।

তথ্যসুত্র: উইকিপিডিয়া, বিবিসি নিউজ, ওয়ান ইন্ডিয়া.কম

আরও পড়ুন