• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০১৯, ০৯:০৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ১৮, ২০১৯, ০৯:১৯ পিএম

কুর্দি বিরোধী তুর্কি অভিযান

মার্কিন প্রহসনে ফের সন্ত্রাসবাদ উত্থানের শঙ্কা

মার্কিন প্রহসনে ফের সন্ত্রাসবাদ উত্থানের শঙ্কা

সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদ নামের এক ভয়াল ব্যাধি আজ সারাবিশ্বের বুকে সংক্রামিত। বরাবর এ কথাই দাবি করা হয়, সাম্প্রদায়িকতার মুখোশের অন্তরালে স্পর্শকাতর ধর্মীয় তত্ত্বের এক বিকৃত দর্শনের দীক্ষা প্রচারের মাধ্যমে উত্থান ঘটানো হয়েছে এই জঙ্গিবাদের। আর এই জঙ্গিবাদের উত্থানের নেপথ্য শক্তি হিসেবে কাজ করেছে সুবিধাবাদী মার্কিন প্রশাসন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে গড়ে তোলা ‘জিহাদী’ সংগঠনের মাধ্যমে ৮০ এর দশকে, আফগানিস্তানের বুকে সৃষ্টি করা হয় জঙ্গিবাদ উত্থানের মূল পটভূমি। সে সময় সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উদ্দেশে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তান সরকার এবং সে দেশের বিশেষ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণের দ্বারা গড়ে তোলা হয়েছিল এই কথিত জিহাদী গোষ্ঠী। পরে প্রয়োজন ফুরালে একেবারে অবাঞ্ছিত হিসেবে তাদের প্রত্যাখান করা হয়। এক পর্যায়ে এই অবজ্ঞার বিপরীতে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠা গোষ্ঠীর হাত ধরেই উত্থান ঘটে তালেবান নামক সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর। এই ঘটনার সত্যতা নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজী। 

‘কুর্দি সেনাদের বিরুদ্ধে তুর্কি সামরিক অভিযান কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না মার্কিন সেনারা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা বিবিসি, নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্টের মতো গণমাধ্যমগুলোর প্রকাশিত প্রতিবেদনে সে বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে ফুটে উঠেছে’

...............................

চলতি সময় সিরিয়া ফেরত মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের ভাষ্য ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্যমতে জানা যায়, ঠিক একইভাবে আরও একটি চরমপন্থী জনগোষ্ঠীর জন্ম দিতে চলেছে মার্কিন প্রশাসন। যার প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ার বুকে। যেখানে আইএসআই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সিরিয়ান কুর্দি সেনাদের ব্যবহার করে আজ তাদের তুর্কি আগ্রাসনের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। একদিকে যখন তুর্কি সামরিক আগ্রাসনের মুখে নিপতিত কুর্দিরা, অন্যদিকে সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে সেই পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে মার্কিন প্রশাসন। 

এক সময়ের সহযোদ্ধাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এই সিদ্ধান্তকে কোনোভাবেই নৈতিক সমর্থন দিতে পারছে না খোদ মার্কিন সেনারা। তাদের মতে, কুর্দিদের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের এই আচরণ একটি ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ একটি নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে, যার জন্য হয়তো পুরো বিশ্বকে ভুগতে হবে।

আশির দশকের আফগানিস্তান ও সাম্প্রতিক সিরিয়ার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখে নেয়া যাক আসলেই মার্কিন প্রশাসনের এই বেপরোয়া প্রহসন গোটা বিশ্বকে নতুন করে শঙ্কিত হওয়ার মতো কোনও পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে কি না।

● ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবাদের উত্থান সম্পর্কে ইমরান খান নিয়াজীর মন্তব্য 

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে নিউ ইয়র্কের কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন (সিএফআর) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজী। সেখানে চলমান জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের কূটনৈতিক লড়াইয়ে প্রত্যাশিত মার্কিন সমর্থন না পাওয়ায় খেদ প্রকাশ করেন ইমরান। এক পর্যায়ে পাক-মার্কিন সম্পর্কের অতীত ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে তিনি জানান, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তান সরকার, সে দেশের সেনাবাহিনী এবং বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার (আইএসআই) হাতে একটি কট্টরপন্থী জিহাদী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছিল। আর পরবর্তীতে কীভাবে তাদেরকে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দেয়া হয়।

● যা বললেন ইমরান খান নিয়াজী 

‘১৯৮০র দশকে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। পাকিস্তানের সহায়তায় সোভিয়েত প্রতিরোধ সংগঠিত করে যুক্তরাষ্ট্র। আর ওই প্রতিরোধ সংগঠিত করতে সোভিয়েত-বিরোধী জিহাদে অংশ নিতে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয় পাকিস্তানি আইএসআই (ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স বা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা)। সোভিয়েত-বিরোধী লড়াই করতে এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী তৈরি করি আমরা... জিহাদীরা তখন বীরের মর্যাদা পেতো। ১৯৮৯ সাল আসলো, সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে গেল, যুক্তরাষ্ট্রও গুঁটিয়ে নিয়ে আফগানিস্তান ছাড়লো...আর আমাদের কাছে থেকে গেল এসব গোষ্ঠী’।

‘এরপর এলো ৯/১১ আর পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে যোগ দিলো। আর আমাদের এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যাওয়ার দরকার পড়লো। জিহাদের সময় তাদের বৈদেশিক দখলদারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তাদের শেখানো হয়েছিল বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার নামই জিহাদ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তানে এলো তখন তারা হয়ে গেল সন্ত্রাসবাদী। তবে এই সংঘাতে পাকিস্তানের নিরপেক্ষ থাকা উচিত ছিল।’ ইমরানের এই মন্তব্য এ কথাই প্রমাণ করে, এখনও এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রতি তাদের মনোভাব ইতিবাচক।

শুধু তাই নয় আফগানিস্তানের তালেবানদের প্রসঙ্গে পাক-প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান সেই তিনটি দেশের অন্যতম যারা ২০০১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। পরে ৯/১১ হামলার পর তারাই আবার তালেবানের বিরুদ্ধে মার্কিন সেনাকে সমর্থন করেছিল।

এভাবেই আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তান থেকে হটানো এবং পরবর্তীতে ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের যে পররাষ্ট্রনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, তার তীব্র সমালোচনা করেছেন দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। পাশাপাশি ৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস-বিরোধী যুদ্ধে তাদেরই এক সময়ের মিত্রপক্ষ, তালেবানদের নিধনে পাকিস্তানের অংশগ্রহণকে জঙ্গিবাদ উত্থানের মত ‘বড় বিপর্যয়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি।

● আইএসআইএস বিরোধী অভিযান ও কুর্দিদের প্রতি মার্কিন প্রত্যাখান     

কুর্দি সেনাদের বিরুদ্ধে তুর্কি সামরিক অভিযান কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না মার্কিন সেনারা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা বিবিসি, নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্টের মতো গণমাধ্যমগুলোর প্রকাশিত প্রতিবেদনে সে বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে ফুটে উঠেছে।

মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী যখন সিরিয়ার মাটিতে নেমে জিহাদী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিল, তখন তাদের সহযোগী ছিল এই কুর্দি যোদ্ধারাই। উত্তর-পূর্ব সিরিয়া এক সময় ছিল আইএসের শক্ত ঘাঁটি। কিন্তু তাদের উত্থানকে ঠেকিয়ে রেখেছিল কুর্দিপ্রধান সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস বা এসডিএফ মিলিশিয়া এবং তাদের সমর্থন দানকারী মার্কিন বিশেষ বাহিনী।

অনেকের আশঙ্কা, তুরস্ক যেভাবে অভিযান চালিয়ে কুর্দি মিলিশিয়াদের তাড়িয়ে দিচ্ছে- তাতে হয়তো সিরিয়ায় জিহাদী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের নতুন করে উত্থান ঘটতে পারে। অন্যদিকে মার্কিনিদের দ্বারা প্রত্যাখিত কুর্দিরাও হয়ে উঠতে পারে একটি আগ্রাসী সশস্ত্র বিপ্লবী জনগোষ্ঠী।

এ প্রসঙ্গে বিবিসির নিরাপত্তা বিশ্লেষক ফ্র্যাংক গার্ডনার মন্ত্যব্য করেছেন, ‘হ্যাঁ, এটা খুবই সম্ভব। অন্তত সীমিত অর্থে হলেও ইসলামিক স্টেট বা আল-কায়েদার মতো সংগঠনের পুনরুত্থান হতেই পারে। এটা মনে করার কারণ হলো- ইসলামিক স্টেট বা আল-কায়েদার মতো সংগঠনগুলো বিকশিত হয় বিশৃঙ্খল এবং গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে।’

উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় তুরস্কের অভিযান একটি অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ এলাকায় ঠিক এ রকমই একটা পরিস্থিতির ঝুঁকি তৈরি করেছে। তবে তা নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের ওপর। ১. সিরিয়ায় তুরস্কের অভিযান কত ব্যাপক হয়। ২. অভিযান কতদিন ধরে চলে এবং ৩. তার তীব্রতা কতটা হয়।

জিহাদী বাহিনী আইএস এবং তাদের স্বঘোষিত খেলাফত কার্যত- সম্পূর্ণ উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল এ বছরই। মার্চ মাসে বাঘুজের যুদ্ধে পরাজয়ের পর তাদের নিয়ন্ত্রিত সর্বশেষ ভূখণ্ডটিও হারায়। কিন্তু তাদের হাজার হাজার যোদ্ধা এখনও জীবিত এবং তারা এমন একটি পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। পাশাপাশি এই সংগঠনের সঙ্গে উপেক্ষিত কুর্দিদের মার্কিন-বিদ্বেষী মনোভাবের কারণে আঁতাত সৃষ্টি হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।

মার্কিন বাহিনীর সুরক্ষা নিয়ে এতদিন পর্যন্ত সিরিয়ার পুরো এলাকাটিই নিয়ন্ত্রণ করতো কুর্দি যোদ্ধারা। তাদের সঙ্গী করেই একের পর এক সন্ত্রাসী দমনের যুদ্ধ চালিয়েছে মার্কিনিরা। আজ তাদের তুরস্কের বিশাল সামরিক বাহিনীর আক্রমণের মুখে এক সর্বগ্রাসী সঙ্কটে ফেলে রেখে সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি চান না আমেরিকান সৈন্যরা দেশের বাইরে কোনও ‘অন্তহীন’ ও ‘অপ্রয়োজনীয়’ যুদ্ধে জড়িত থাকুক। এ যেন ঠিক আশির দশকের সেই আফগান ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

ট্রাম্প প্রশাসনের এই খেয়ালিপনা অদূর ভবিষ্যতে সন্ত্রাসবাদের মতো বৈশ্বিক সঙ্কটকে আরও তীব্রতর করে তুললে তখন তা নিশ্চিতভাবেই প্রভাব ফেলবে গোটা বিশ্বের ওপর। বিশ্ব শান্তিকে বিঘ্নিত করে সারা পৃথিবীর মানুষ মার্কিন প্রশাসনের এই দ্বিমুখী আচরণ আর অন্ধ-স্বার্থপরতার খেসারত দেবে, তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

আরআইএস/এসএমএম

আরও পড়ুন