• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০১৯, ০৯:৪৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২২, ২০১৯, ০৪:১৪ পিএম

মার্কিন ষড়যন্ত্রে পতনের মুখে আরব বিশ্বের শেষ দুর্গ

মার্কিন ষড়যন্ত্রে পতনের মুখে আরব বিশ্বের শেষ দুর্গ

ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ 

...................

সামরিক সংঘাতে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশ ইরানের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হওয়ায় শেষ পর্যন্ত নিজেদের প্রথাগত কূটনৈতিক প্রহসন আর নিষেধাজ্ঞার রাজনৈতিক অপকৌশলই অবলম্বন করলো যুক্তরাষ্ট্র। আর তাতে করে আকস্মিক পাল্টে গেল ইরানের দৃশ্যপট। মাত্র কয়েকদিন আগেও তেহরানের বুকে মার্কিন বিরোধী প্রতিরোধ বুহ্যে ইরানের সরকার-জনতা মহাঐক্যের যে দৃঢ়তা ছিল, তাতে চির ধরেছে। মার্কিনিদের প্রতিহিংসামূলক বিভাজনের রাজনীতির ফাঁদে পা গলিয়ে দিয়েছে ইরানিরা। যার পরিণতিতে হয়তো অচিরেই দেখা যাবে আরও একটি ইরাক, কুয়েত, সিরিয়া বা ফিলিস্তিনের পুনরাবৃত্তি।

সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও রেশন খরচা বৃদ্ধির ইস্যুতে সরকার বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে ইরান। ক্রমেই এই বিক্ষোভ তীব্রতর হয়ে বর্তমানে এক সংঘাত্মক সহিংস আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। দাবি করা হচ্ছে- এই আন্দোলন দমনে কঠোর হয়েছে ইরান সরকার। সরকারের নির্দেশে হার্ড লাইনে থাকা প্রশাসন প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ছে বিক্ষোভ নিবারণে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ ইরানের চলমান এই বিক্ষোভ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে তাদের দাবি, ‘‘ক্রমেই জটিল রূপ ধারন করতে থাকা এই সহিংস আন্দোলন প্রতিহত করতে ইরানি সরকারের নির্দেশে শক্ত অবস্থান নিতে দেখা গেছে প্রশাসনকে। যার প্রেক্ষিতে চলমান সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত পুলিশ ও সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন অন্তত ১০৬ জন ইরানি নাগরিক।’’ 

বিবিসি ও রয়টার্সসহ বিশ্ব মিডিয়ায় ফলাও করে  প্রকাশ করা হয়েছে সেই সংবাদ।

তবে এর পর পরই ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেয়া এক বিবৃতিতে ইরানের প্রধান রাষ্ট্রীয় নেতা সাঈয়াদ আলী হুসেইনি খামিনি জানান, ইরানের চলমান বিক্ষোভটি মোটেই সরকার বিরোধী বিক্ষোভ নয়। জনগণ তাদের দাবি আদায়ের জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এই আন্দোলন করেছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় এ ব্যাপারে কাজ করছে সরকার।

তিনি দাবি করেন, এই পরিস্থিতি ইরানের শাসন ব্যবস্থার ত্রুটির দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। কারণ ইরানের সরকার সকল সমস্যা ও আগ্রাসন থেকে তার জনগণকে রক্ষার কাজে নিবেদিত। ইরান সরকার প্রয়োজনে সারা বিশ্বের সঙ্গে বৈপরীত্ব সৃষ্টি করবে যদি তারা তার জনগণের স্বার্থ রক্ষা না করে।

খামিনি বলেন, "এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ইরানকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চলছে। বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার জেরে অর্থনৈতিক প্রকট সৃষ্টির মাধ্যমে তার উত্থান ঘটানো হচ্ছে। তবে দেশের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্রের কঠোর জবাব দেয়া হবে"। ইরনা নিউজ

এমতাবস্থায়, সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ কথা বলাই যায়, অত্যন্ত সুকৌশলে ইরানকে কাবু করার নীল নকশা বাস্তবায়ন শুরু করলো যুক্তরাষ্ট্র। সেক্ষেত্রে ইরানের সাম্প্রতিক অবস্থার সারাংশটুকু অনেকটা এমন, একদিকে লাগাতার সামরিক আগ্রাসনের হুমকি সৃষ্টির মাধ্যমে আরব সাম্রাজ্যের সর্বশেষ পরাশক্তি ইরানকে বাধ্য করা হয়েছে আত্মরক্ষার খাতিরে ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারের স্বার্থে পারমাণবিক শক্তিবৃদ্ধিতে। অপরদিকে সেই পারমাণবিক কার্যক্রমকেই আবার ইস্যু করে আরোপ করা হয়েছে একের পর এক বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। মার্কিন নেতৃত্বাধীন আরব ন্যাটোর সামরিক আগ্রাসনের চাপে থাকা ইরান যখন সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নে, ঠিক তখনই লাগাতার নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দেশটির আয়ের পথ। এতে করে এক ঝাটকায় মুখ থুবড়ে পড়েছে ইরানের অর্থনীতি। যার প্রভাব পড়তেই প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে সেদেশের সাধারণ মানুষ। রাতারাতি জনপ্রিয়তা হারিয়ে শূন্যের কোটায় নেমে আসছে খামিনি সরকারের গ্রহণযোগ্যতা। শুরু হয়েছে সংঘাত আর বিক্ষোভ। পরিস্থিতি সামাল দিতে বল প্রয়োগে বাধ্য হচ্ছে প্রশাসন, রাজপথে ঝরছে প্রাণ। যা এই সঙ্কটাপণ্ন পরিস্থিতিকে আরও উসকে দিচ্ছে। 

ইরানের যেই অজেয় দুর্গ জয় একদিন মার্কিনিদের দিবাস্বপ্ন ছিল, আজ তা সত্যি হবার পথে। ইরানি নেতৃত্বের প্রতি সে দেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনই ছিল সে স্বপ্নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা যা আজ ভাঙনের মুখে।

যদি নিকট ভবিষ্যত অনুধাবনে বলা হয় তবে দৃশ্যপট যেদিক যাচ্ছে তা এমন- শিগগিরই আর্থিক মন্দা আর অভাবের প্রলয়ে এই ঐক্য ভেঙে জনতার অনাস্থার পাত্রে পরিণত হবে খামিনি ও তার সরকার। বলা হবে জনগণের স্বার্থ বিক্রি করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে ইরান সরকার। সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার জন্য ইরানকে দায়ি করা হবে। আর খামিনি সরকারের পতনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাবে আরব ন্যাটোর সদস্য সৌদি আরব। এরইমধ্যে সৌদির বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন ইরান আঞ্চলিক সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে।গালফ নিউজ

সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ইরানি শাসকের দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে তার নাগরিকদের নিস্তার দেয়ার নামে শান্তির বোমারু পায়রার পিঠে চড়ে উড়ে আসবে যুক্তরাষ্ট্র, হানবে মোক্ষম আঘাত। বিধ্বস্ত ইরানের বুকে বিপণ্ন হবে জন-জীবন। বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে মুসলিম সাম্রাজ্যের সর্বশেষ পরাক্রমশালী রাষ্ট্রটি। এরপর পুরো মধ্যপ্রাচ্যই চলে যাবে মার্কিন অধিগ্রহণে যা সে অঞ্চলের জন্য কতটা নেতিবাচক হবে এবং এই ইস্যুতে ধর্মতত্ত্বের ব্যবসা ও জিহাদের নামে নৈরাজ্য কোন বিভীষিকার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ঠেকবে, তা বর্তমান বিশ্ব ধারণাও করতে পারছে না। হয়তো এর প্রেক্ষাপটে কিছু দিনের জন্য বিশ্বজুড়ে শুরু হবে 'গৃহবন্দি' বিশ্ব বিবেকের মানববন্ধন আর বৈঠকি প্রতিবাদ। আর সোস্যাল মিডিয়াবাজি। অর্থের অভাবে থাকা জাতিসংঘও মুখ বুজে রইবে। বড় বড় রাষ্ট্রগুলো দর কষাকষিতে ব্যস্ত রবে। এরই মাঝে সাদ্দাম হোসেন আর মুয়াম্মর গাদ্দাফির মতো ‘দৈত্য শাসক’ এর তমকাজুড়ে দিয়ে লটকে দেয়া হবে খামিনি ও তার অনুসারিদের।  

অন্যদিকে অর্থাভাবে থাকায় সস্তায় মার্কিনিদের কাছে বিক্রি হবে ইরানি প্রশাসনের একাংশ। যাদের কারণে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পরবে ইরানের মানুষ। রাষ্ট্রের দখল নেয়ার পর এক পর্যায়ে তাদের বসানো হবে মার্কিন আনুগত্যে নিবেদিত পুতুল সরকার হিসেবে। ইরানের বুকে সঞ্চিত পারমাণবিক ঐশ্বর্য আর তরল সোনা লুন্ঠিত হবে। জন্ম নেবে আরও একটি জঙ্গিগোষ্ঠী। যারা সারাবিশ্বের বুকে নৈরাজ্য আর সন্ত্রাসী সহিংসতার রাজত্ব কায়েম করবে। ঝাঁঝালো বোমার আঘাতে যখন সংবিৎ ফিরে পাবে ইরানবাসী ততক্ষণে দেখবে, বড্ড দেরি হয়ে গেছে৷

হয়তো বরাবরের মত এই নাটকের মঞ্চায়ন নীরবে প্রত্যক্ষ করবে মানবতাবাদী সচেতন সভ্য বিশ্ব বিবেক।

এক্ষেত্রে পুরো বিশ্বের জন্য একটি আশঙ্কা রয়েছে। কূটনৈতিক সমালোচক ও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ইরানের ক্ষেত্রে এই ধরনের মার্কিন পরিকল্পনা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে সারা বিশ্বের জন্য। কারণ ইরান তার পরাক্রমশালী স্বত্তার কারণে ঐতিহ্যগতভাবেই বেশ দাম্ভিক একটি জাতি। তাদের অস্তিত্বে আঘাত আসলে মোটেই ইরাক, কুয়েত বা সিরিয়া, ফিলিস্তিনের মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে না। নিজেদের পতন নিশ্চিত জানা মাত্র চরম আগ্রাসি হয়ে উঠবে ইরান। সেক্ষেত্রে পরিণতি যাই হোক, ধসে পড়ার আগেই ইরান বেপরোয়াভাবে তার বিধ্বংসী পারমাণবিক মারণাস্ত্রগুলো নিক্ষেপ করে বসবে। আর সেটা সারা বিশ্বের জন্য কত বড় প্রলয় সৃষ্টি করতে পারে, তার ভয়াবহতার বিস্তৃতি কতটা হতে পারে সেটা হয়তো কল্পনারও অতীত।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিহিংসার কূটনীতির দায় সারা বিশ্বমানবতা কোনওভাবেই বহন করতে পারে না। এই আগ্রাসন রুখতে হবে, সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে উত্থিত সঙ্কট। সেজন্য অনতিবিলম্বে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রধান অভিভাবক জাতিসংঘ এবং ওআইসিসহ বিশ্বের প্রতিটি ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রকে। ইরানের বিপর্যয় আন্তর্জাতিক বাজারেও সৃষ্টি করবে অস্থিতিশীলতা, ঘটবে মানবতার চরম বিপর্যয়, বৃদ্ধি পাবে অভিবাসন সংকট।

কেএস/এসএমএম

আরও পড়ুন