• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০১৯, ০৯:২৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২৪, ২০১৯, ১০:৩৮ পিএম

অভিশংসন সংকট ও ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

অভিশংসন সংকট ও ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

ট্রাম্পের অভিশংসন মামলা

.......................................

সাম্প্রতিক বিশ্বের অন্যতম আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসন মামলা। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, সাংবিধানিক বিধিভঙ্গকারী অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার জেরে ট্রাম্পের ক্ষমতাচ্যুতি বা সীমিতকরণের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে এই ইমপিচমেন্ট বা অভিংশসনের মাধ্যমে।

রাষ্ট্রীয় বিধিমালা ভঙ্গ করে নির্বাচনে বিদেশি শক্তির সহযোগিতা গ্রহণ, আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে কোণঠাসা করতে— বহিঃরাষ্ট্রের দ্বারা চাপ সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার মতো বেশ কয়েকটি স্পর্শকাতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে এই অভিশংসন সংকটের ফাঁদে পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। 

একজন রাষ্ট্রপ্রধানের এ ধরনের কাজে জড়িত থাকা দেশটির সাংবিধানিক বিধান অনুসারে দণ্ডযোগ্য অপরাধ। এ নিয়ে সারা বিশ্ব এখন শুধু একটি প্রশ্নেরই জবাব খুঁজছে— শেষ পর্যন্ত কি ট্রাম্পকে সংসদীয় বিচারের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া বা ইমপিচ করা হতে পারে?

বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই অভিশংসন মামলায় জড়িয়ে পড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলেও এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই অনেকেরই।

এই ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসনের অর্থ কী? আর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেলায় তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কতোটুকু? যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অভিশংসনের আর কোনও ঘটনা এর আগে ঘটেছে কি— না, এমন আরও বহু বিষয় আছে যেগুলো সম্পর্কে অনেকেই অজ্ঞাত।

দৈনিক জাগরণ এর পাঠককূলের জন্য তাই এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হল  অভিশংসন সংক্রান্ত এই বিশেষ প্রতিবেদনটিতে। 

» ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসন কী

যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক বিধিমালা (আর্টিকেল-১, সেকশন-২, ধারা-৫) অনুসারে, ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সে দেশের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় ভারসাম্য রক্ষা করা হয়।

মার্কিন কংগ্রসের আইনপ্রণেতাদের মাধ্যমে বিধিবদ্ধ এই আইনি প্রক্রিয়ার আওতায়, প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে দেশটির প্রেসিডেন্টসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের জবাবদিহি বা দায়েরকৃত কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারের মুখোমুখি করারও আইনানুগ বিধান রয়েছে।

» ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসন বিধির প্রয়োগ

যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা আছে, বেশকিছু অপরাধ কর্মকাণ্ড আছে যেগুলোর প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত ফলে স্বয়ং প্রেসিডেন্টকেও তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া অর্থাৎ তাকে ইমপিচ করা যেতে পারে।

এসব অপরাধের মধ্যে— রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ঘুষ নেয়া বা দেয়া, রাষ্ট্র সম্পৃক্ত ইস্যুতে বহিঃরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ প্রদান, সার্বভৌমত্ব প্রতি হুমকি সৃষ্টি অথবা ছোটো-বড়ো এমন আরও কয়েকটি বিষয়, যেগুলো অপরাধ হিসেবে গ্রাহ্য করা হয়।

‘‘আনিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে হলে এই সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ সিনেটরকে ইমপিচমেন্টের পক্ষে ভোট দিতে হবে’’

» ইমপিচ যেভাবে করা হয়?

ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু হতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভস থেকে। এটি মার্কিন কংগ্রেসের একটি অংশ। এই প্রক্রিয়া শুরু করার জন্যে এটি সেখানে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হতে হবে। আর সেটা পাস হলে পরের ধাপে বিচার অনুষ্ঠিত হবে সিনেট, যেটা কংগ্রেসের দ্বিতীয় অংশ।

এটা অনেকটা আদালত কক্ষের মতো, যেখানে সিনেটররা বিচারক বা জুরি হিসেবে কাজ করবেন। তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন প্রেসিডেন্ট দোষী কি নির্দোষ।

আনিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে হলে এই সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ সিনেটরকে ইমপিচমেন্টের পক্ষে ভোট দিতে হবে।

» ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগের ভিত্তিতে অভিশংসনের প্রশ্ন উঠছে তার মধ্যে সর্বশেষ ইস্যুটি হল, আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের মর্যাদাহানি ও গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করতে, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ দায়ের ও তা তদন্তে ইউক্রেন সরকারকে চাপ প্রয়োগ। যা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এর আগে নির্বাচনি বিধি লঙ্ঘন, নারী কেলেঙ্কারি ও আর্থিক কেলেঙ্কারির মতো বেশ কয়েকটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে ট্রাম্পের ‘ইমপিচ ফ্যাক্টর’ জোরদার হয়ে ওঠে।

মূলত ২০১৬ নির্বাচনের আর্থিক কেলেঙ্কারি ইস্যুতে, ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডে ‘বিব্রতিতে পড়া’ সাবেক আইনজীবী মাইকেল কোহেনের মামলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক এই সংকট।

তবে তার অভিযোগ অস্বীকার করে ট্রাম্প বলেছেন, কোহেন এখন ‘গল্প’ বানাচ্ছেন।

অভিশংসন বিষয়ক অনুসন্ধানে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সত্য দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রের এই দু’জন জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেন, ২৫ জুলাই টেলিফোনে ট্রাম্প নিজেকে রাজনৈতিকভাবে লাভবান করতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জো বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদোমির জেলেন্সকিকে যে চাপ দিচ্ছিলেন সে ব্যাপারে তারা অত্যন্ত বিচলিত এবং উদ্বিগ্ন বোধ করেছেন।

» এরকম কি আগে কখনও হয়েছে?

সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তিনি হলেন বিল ক্লিনটন। সেটি ছিল ১৯৯৮ সালের ঘটনা। ক্লিনটনের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্যে ভোটও পড়েছিল প্রতিনিধি পরিষদে।

তারও আগে এ রকম ঘটনা ঘটেছিল ১৮৬৮ সালে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জনসনের বিরুদ্ধেও।

কিন্তু ক্লিনটন বা জনসন তাদের কাউকেই শেষ পর্যন্ত সে লজ্জায় ডুবতে দেয়নি সিনেট ভোট। যদিও তারা দু’জনেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।

সুতরাং ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া চলা মানে এটা নয় যে, এর প্রক্রিয়া শুরু হলেই প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত কোনও প্রেসিডেন্টকে ইমপিচমেন্টের কারণে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়নি। তবে একজন প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার উপক্রম হয়েছিল। তিনি রিচার্ড নিক্সন।

তবে ১৯৭৪ সালে তার বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই তিনি পদত্যাগ করেন। ধারণা করা হয়, প্রক্রিয়াটি শুরু হলে তাকে হয়তো প্রেসিডেন্টের পদ থেকে শেষ পর্যন্ত সরিয়ে দেয়া হতো।
 

» ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কি ইমপিচ করা হতে পারে?

বর্তমানে এ রকম কোনও সম্ভাবনা নেই। যার কারণ হিসেবে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে এই বিষয়গুলো— হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ ও সিনেটে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টির সদস্য সংখ্যা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দল ডেমোক্র্যাটির পার্টির সদস্য সংখ্যার চাইতেও বেশি।

সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভে ২৫ জন রিপাবলিকান সদস্যকে এবং সিনেটে ১৭ জনকে তাদের নেতার বিরুদ্ধে ভোট দিতে হবে এই প্রক্রিয়া শুরু করা এবং তাকে ইমপিচ করার জন্যে। (শুধু তাই নয়, এই হিসেব তখনই সম্ভব হবে যখন, যারা রিপাবলিকান নয় তাদের সবাইকেও ইমপিচ করার পক্ষে ভোট দিতে হবে।)

যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাচন আসছে। মধ্যবর্তী নির্বাচন। এ বছরের শেষের দিকে। ওই নির্বাচনের ফলাফল হয়তো বর্তমানের এই হিসেব-নিকেশ বদলে দিতে পারে।

নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় ওই নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কংগ্রেসের সদস্যদের নির্বাচন করবেন। হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের সবকটি অর্থাৎ ৪৩৫টি আসনে এবং সিনেটের ১০০টি আসনের মধ্যে ৩৫টি আসনে হবে এই নির্বাচন।

নির্বাচনের ফলাফল কী হয় সেটা দেখতে হবে— হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ফেলতে পারে রিপাবলিকানরা। সিনেটেও এ রকম ঘটতে পারে।

যদি এরকম কিছু হয় তাহলে ডেমোক্র্যাটরা হয়তো দেখতে পারেন যে কংগ্রেসের তাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক সদস্য রয়েছে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করার জন্যে, যদি তারা সেটি চায়।

» ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসন কার্যকর হলে কী হবে?

ট্রাম্পকে যদি শেষ পর্যন্ত ইমপিচ করা হয় তাহলে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

 

থ্যসূত্র সহায়ক:

• যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান-উইকি (কনস্টিটিউশন্যাল ফেইস অব ইউএসএ)

• বিবিসি নিউজ

• দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট

 

এসকে/এসএমএম

আরও পড়ুন