• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০১৯, ০৫:৪০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯, ১২:৫৬ এএম

ব্রিটেনের নির্বাচনে ব্রেক্সিটিই আসল ইস্যু

ব্রিটেনের নির্বাচনে ব্রেক্সিটিই আসল ইস্যু

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এমন নির্বাচনের মুখোমুখি হয়নি ব্রিটেন। কারণ বৃহস্পতিবারের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর দেশটির ভবিষ্যতের অনেক কিছু নির্ভর করছে। ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের (ব্রেক্সিট ) প্রশ্নে প্রায় তিন বছর ধরে পার্লামেন্টে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে গত দু'বছরের মধ্যে এটি দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন।

প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কনসারভেটিভ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে ফিরবে বলে আশা করছে, অন্যদিকে জেরেমি করবিনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি ব্রেক্সিটের পরিবর্তে তাদের নানা ধরণের রাষ্ট্রীয় কল্যাণমূলক কর্মসূচিকেই তাদের প্রচারণায় প্রাধান্য দিচ্ছে।

যে কারণে এ নির্বাচন?

ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার ২০১৬র গণভোটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ত্যাগের পক্ষে রায় দেয়। তার আগের কয়েক দশক ধরে ব্রিটেন এবং ইইউর অর্থনীতি এবং বাণিজ্য অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল।

তাই গণভোটের পরই কথা ওঠে যে ইইউ ত্যাগ করার ফলে যাতে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কোন ক্ষতি না হয়, দু-অংশের জনগণ চাকরিবাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব সুবিধা ভোগ করতেন সেগুলোতে কোন ছেদ যেন না পড়ে। তাই ব্রেক্সিট কীভাবে হবে তা আগে থেকেই একটা চুক্তির ভিত্তিতে স্থির করে নিতে হবে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং তার আগে প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে এরকমই চুক্তি করেছিলেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে । কিন্তু পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় তা তাদের পক্ষে ওইসব প্রস্তাব পাস করা সম্ভব হয়নি। জোটের শরীক দলগুলো ওই চুক্তিকে সমর্থন করেনি। ফলে এই চুক্তিটি লেবার পার্টিসহ অন্য বিরোধীদলগুলোর সমর্থন পায়নি।

যে কারণে তেরেসা মে তিন বার এবং বরিস জনসন একবার পার্লামেন্টে তুলেও তাদের ব্রেক্সিট চুক্তি পাস করাতে পারেননি।

ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে পার্লামেন্টে সৃষ্টি হয়েছিল নজিরবিহীন তিক্ততা, বিভক্তি ও অচলাবস্থা। ব্রেক্সিট হবে কি হবে না এই অনিশ্চয়তায় ব্যবসাবাণিজ্যে তৈরি হয়েছে স্থবিরতা। অনেকে বলছেন, ব্রিটেনে রাজনীতিবিদদের ওপর জনগণের আস্থাই কমে যাচ্ছে। কনজারভেটিভ এবং লেবার দু দলই ব্রেক্সিট চাইছে নিজেদের মত করে।

এই সঙ্কট মোকাবেলায় নতুন এই নির্বাচন দেয়া হয়েছে ব্রিটেনে। নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে তারাই এই সঙ্কটের সুরাহা করতে পারবে বলে আমা করা হচ্ছে। তবে কোনো দল যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত ব্যর্থ হয় তাহলে সঙ্কট আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তাই বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে বিপুল আসন পেতে দুই দলই মরিয়া।

 যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ এ নির্বাচন

ব্রেক্সিট এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার নজিরবিহীন তিক্ততা, বৈরিতা এবং বিভক্তির কারণে এই নির্বাচনকে এতটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ব্রেক্সিট হবে কিনা বা কীভাবে হবে তা নির্ধারিত হবে এ নির্বাচনে। ব্রেক্সিট যদি হয়, তাহলে তা ব্রিটেনের সমাজ ও অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসবে ।

কিন্তু যারা ব্রেক্সিটের বিরোধী তারা বলছেন, এর পরিণতিতে যুক্তরাজ্য ভেঙে যেতে পারে - কারণ স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে জোর জনমত আছে।

অন্য দিকে ব্রেক্সিটের প্রতিক্রিয়া পড়বে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ওপরও - অনেকের মতে ইইউর ঐক্যও হুমকির মুখে পড়তে পারে। এক কথায় গোটা ইউরোপেই অনেক সুদূর প্রসারী পরিবর্তন আসতে পারে, এবং এগুলো সবই ঘটতে পারে ব্রেক্সিটের কারণে ।

আর এ নির্বাচনের পরিণতিতে ব্রেক্সিট যদি না হয় - তাহলে অনেকের মতে ব্রিটেনে এক গভীর রাজনৈতিক সংকট দেখা দেবে।

জনগণের একাংশের মধ্যে গুরুতর বিভক্তি ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হবে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনীতিবিদদের প্রতি সৃষ্টি হবে জনগণের গভীর অনাস্থা। অনেকে সামাজিক সংঘাতের আশংকাও প্রকাশ করছেন।

ব্রেক্সিটকে নিয়ে সমাজে এবং রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে তীব্র মতবিরোধ, তিক্ততা এবং বিভক্তি। ঘটেছে এমন সব ঘটনা যা ব্রিটেনে নিকট অতীতে দেখা যায় নি।

ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে আদালতে মামলা হয়েছে। একটি দল ব্রেক্সিট বাতিল করাকে তাদের প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার বানিয়েছে। এর আগে পার্লামেন্টে বার বার ভোট করেও ব্রেক্সিট প্রস্তাব পাস করাতে না পেরে পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী তেরিজা মে।

বরিস জনসনও তার প্রস্তাব পাস করাতে পারেন নি। এর পর তিনি পার্লামেন্ট স্থগিত করে দেবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আদালতের রায়ে তার সে পদক্ষেপ খারিজ হয়ে পার্লামেন্ট আবার বসে।

লেবার ও কনজারভেটিভ উভয় দলেরই বেশ কিছু এমপি দল ছেড়েছেন। কেউ নতুন দল করেছেন, কয়েকজন প্রথম সারির রাজনীতিক রাজনীতি থেকে কার্যত বিদায় নিয়েছেন। দলের কয়েকজন প্রবীণ নেতা এবার তাদের নিজস্ব দলকে ভোট দেবেন না বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। তারা ভোটারদেরকে অন্য দলের প্রার্থীদের ভোট দেবার আহ্বান জানিয়েছেন।

বহু এমপি বলছেন, তারা হত্যার হুমকি পেয়েছেন। সন্দেহ করা হয় যে ২০১৬ সালে জো কক্স নামে একজন এমপি খুন হবার পেছনেও কারণ ছিল ব্রেক্সিট। এরকম নানা নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে গত তিন বছরে। এতে ব্রিটেনের রাজনীতিতে যে তিক্ততা এবং বিভক্তি তৈরি হয়েছে - তাও নজিরবিহীন।

 ব্রেক্সিটই আসল ইস্যু

নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই জনমত জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কনসারভেটিভ পার্টি এগিয়ে আছে। তারা প্রধান বিরোধী দল জেরেমি করবিনের লেবার পার্টির চাইতে বিভিন্ন সময় অন্তত ৬ থেকে ১৫ পয়েন্টের বেশি ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। কিন্তু একেবারে সর্বশেষ জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে এই ব্যবধান কিছুটা কমে এসেছে।

সর্বশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে কনসারভেটিভ পার্টিকে ৪৩ শতাংশ এবং লেবার পার্টিকে ৩৩ শতাংশ ভোটার সমর্থন করছে। তবে এসব জনমত জরিপ কতটা নির্ভরযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ব্রিটেনের ইতিহাসে এসব জনমত জরিপের ভবিষ্যদ্বাণী কখনো সঠিক হয়েছে, কখনো ভুলও হয়েছে। নির্বাচনী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবধান কমে আসার ফলে কনসারভেটিভ পার্টি সবচেয়ে বেশি আসনে জিতলেও সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাবার সম্ভাবনা এখন আগের চাইতে বেড়ে যাচ্ছে।

যদি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হয়, তাহলে যে অনিশ্চিত অবস্থা থেকে বেরুনোর জন্য এ নির্বাচন হচ্ছে - সেই একই অবস্থা ব্রিটেন আবার ফিরে আসতে পারে।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নিম্নকক্ষে আসন সংখ্যা ৬৫০টি। স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে কোন একটি দলকে ৩২৬টি আসন পেতে হবে। তাই বরিস জনসন বা জেরেমি করবিন - দুজনেরই প্রধান্য লক্ষ্য কেবল বেশি আসনে জেতা নয়, একটা স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া।

তাই জনমত জরিপ দিয়ে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শুক্রবার ভোটের ফল আসতে শুরু করার পরই জানা যাবে আসল পরিস্থিতি।

বিবিসির জরিপ বলছে, ৬০ ভাগেরও বেশি উত্তরদাতার কাছে ব্রেক্সিটই প্রধান ইস্যু। বেশ কিছুটা পেছনে দ্বিতীয় স্থানে আছে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা অর্থাৎ এনএইচএসের উন্নয়ন। এরপরে আছে অপরাধ দমন, অর্থনীতি, অভিবাসন ইত্যাদি। জনমত জরিপ অনুযায়ী ব্রেক্সিটই আসল ইস্যু। কনসারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলছেন 'গেট ব্রেক্সিট ডান' - এটাই তার প্রধান এজেন্ডা।

অন্যদিকে লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন - ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সেবা, কর্মসংস্থান, দরিদ্রদের জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা - এগুলোকেই মূল ইস্যু করে তুলতে চাইছেন। দু দলের পক্ষ থেকেই এজন্য নানা রকম আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে ভোটারদের।

সূত্র: বিবিসি

এসকে