জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গিত করে ২৮ দিনের অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৪টা ২৪ মিনিটে স্মারকে সই করার মধ্য দিয়ে তিনি মেলার উদ্বোধন করেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭ বার গ্রন্থমেলা উদ্বোধন করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন।
বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্যকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। ভাষাশহীদদের স্মরণে এই গ্রন্থমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। প্রাণের উৎসব। সেই মেলা শুধু দেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে গেছে বাংলা ভাষার সুবাস।
তিনি বলেন, একুশ আমাদের গৌরব। আমাদের অহঙ্কার। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রক্ত দিতে হয়েছে। ভাষাশহীদদের স্মরণে গ্রন্থমেলা সেই গৌরবের ইতিহাসকেই প্রতিভাত করে। লেখক সাহিত্যিক ও পাঠকদের এক বিরল সুযোগ এনে দেয় এ মেলা।
প্রতিবছরই গ্রন্থমেলায় আসতেন। তারই স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলেন, এখন আর পারি না। রফিক সালামদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাদের কারণে বাংলাভাষায় কথা বলতে পারছি।
একাডেমির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ও একাডেমির মহাপরিচালক ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে সাথে নিয়ে বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়নসহ মেলার বেশ কয়েকটি প্যাভিলিয়ন ও স্টল ঘুরে দেখেন।
এর আগে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু রচিত তৃতীয় নতুন বই ‘আমার দেখা নয়াচীন’ এর মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
‘আমার দেখা নয়া চীন’র মোড়ক উন্মোচন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারাগারে খাতা সেন্সর করে দেয়া হতো। সেই সেন্সরের সিল থেকে আমরা জানতে পারি এটি ১৯৫৪ সালে লেখা। মলাটটি অনেকটা চীনা অক্ষরের মতো করে লেখা।মনোগ্রামটি পিকাসোর তৈরি করা।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু চীনে শান্তি সম্মলনে গিয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গ থেকে প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তিনি আমন্ত্রিত ছিলেন। সেখানে যাবার পথটি, কীভাবে গিয়েছেন তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, এই বইতেই লেখা আছে- তিনি শান্তি সম্মেলনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। মনোজ বসু তার বইতে একথা লিখেছেন। এসবই এই বইতে পাওয়া যাবে।
‘আমার দেখা নয়া চীন’ বঙ্গবন্ধুর লেখা তৃতীয় বই। এর আগে বঙ্গবন্ধুর লেখা দুটি বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ প্রকাশিত হয়েছে।
মেলা উদ্বোধনী আয়োজনে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ১০ জনের হাতে পদক ও ৩ লাখ টাকার চেক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন- কবিতায় মাকিদ হায়দার, কথাশিল্পে ওয়াসি আহমেদ, প্রবন্ধ ও গবেষণায় স্বরোচিষ সরকার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাহিত্যে রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, অনুবাদ সাহিত্যে খায়রুল আলম সবুজ, আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণে ফারুক মঈনউদ্দীন, বিজ্ঞান/কল্পবিজ্ঞানে নাদিরা মজুমদার, নাটকে রতন সিদ্দিকী, শিশুসাহিত্যে রহীম শাহ এবং ফোকলোরে সাইমন জাকারিয়া।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের হীরক জয়ন্তী উদযাপন করছে বাংলা একাডেমি। এ কারণে পুরস্কারের অর্থমূল ৩ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এবারের মেলা উৎসর্গ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির উদ্দেশে। এ কারণে এবারের মেলাজুড়ে আছে বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক নানা আয়োজন। আবর্তিত হয়েছে মেলার ডিজাইন, আলোচনা, সেমিনার, চিত্রাঙ্কনসহ অনেক কিছুই।
মেলায় বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বই ৩০ শতাংশ, ২০০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত প্রকাশিত একাডেমির বই ৭০ শতাংশ এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বিক্রি করবে।
সিটি নির্বাচনের কারণে একুশের গ্রন্থমেলা একদিন বিলম্বে শুরু হয়েছে। ২৯ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে গ্রন্থমেলা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সব লেখা সংগ্রহ করে ‘শেখ মুজিবুর রহমান রচনাবলী’ প্রকাশ করবে বাংলা একাডেমি। আর এই রচনাবলী সম্পাদনা করবেন বঙ্গবন্ধু কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির (বাপুস) আরিফ হোসেন ছোটন। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
এর আগে সাজেদ আকবরের পরিচালনায় সূচনা সঙ্গীত হিসেবে ভাষার গান ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ পরিবেশন করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থার শিল্পীরা।
দর্শকসারিতে বসে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপভোগ করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, কবি-লেখক-সাহিত্যিকসহ গুণীজন।
বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় আট লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৯টি ইউনিট ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩৪টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৯৪টি ইউনিটসহ মোট ৫৬০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৭৩টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ৩৩টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ৩৪টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
প্রথমবারের মতো ‘লিটলম্যাগ’ কর্নার নেয়া হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও একাডেমির উল্টো দিকের কালী মন্দির এবং তিন নেতার মাজারের পাশ দিয়ে থাকবে প্রবেশ ও বহির্গমন পথ। শিশু চত্বরের আয়তনও বেড়েছে। শুধু বইয়ের মেলা হিসেবে এই মেলা আয়োজন হলেও এবার যুক্ত হচ্ছে ফুডকোর্ট। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের দুই প্রান্তে দু’টি ফুডকোর্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এবারের গ্রন্থমেলা সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। মুজিববর্ষ উপলক্ষে এবারের মেলা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করা হচ্ছে।মেলা মঞ্চের আলোচনার বিষয়ও হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। প্রতিদিনের মেলা মঞ্চের আলোচনা-সেমিনার, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, গান, আবৃত্তি, নৃত্যসহ সবকিছুই আবর্তিত হবে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে। সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) থেকে প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে আলোচনা অনুষ্ঠান শুরু হবে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শুধু বাংলা একাডেমিই প্রকাশ করছে ২৬টি বই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আগামী দুই বছরে মোট ১০০টি বই প্রকাশ করবে একাডেমি।
গ্রন্থমেলা সম্পূর্ণ পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত।
যে কোনও ধরনের নাশকতা এড়াতে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে পুলিশ, র্যাব, আনসার ছাড়া একাডেমির নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী। র্যাব পুলিশ ও আনসারের একাধিক কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। গত বছর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন এক হাজার পুলিশ সদস্য। এবার তা বেড়ে দেড় হাজার করা হয়েছে। সে সঙ্গে আনসার সদস্যের সংখ্যাও বেড়েছে।
মেলায় আগতদের শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজ চলায় এ রাস্তায় গাড়ি পার্কিং না করতে আহ্বান জানানো হয়েছে বাংলা একাডেমি ও ডিএমপির পক্ষ থেকে।
অস্থায়ী দোকান, হকার উচ্ছেদ, ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ ও বৃষ্টি হলে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র ও করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
অস্বচ্ছল ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য থাকছে মূল ফটক থেকে হুইল চেয়ারে আনা নেয়ার ব্যবস্থা।
রোববার থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা এবং শুক্র-শনিবারসহ সরকারি ছুটির দিনগুলোতে মেলার দ্বার খুলবে সকাল ১১টায়। চলবে একটানা রাত ৯টা পর্যন্ত। একুশে ফেব্রুয়ারির দিন মেলার দ্বার খুলবে সকাল ৮টায়। চলবে একটানা রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। প্রতি শুক্র ও শনিবার শিশু প্রহর।
এসএমএম