• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০২০, ০৭:৪৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ৩০, ২০২০, ০৮:০৬ পিএম

কোভিড-১৯

কফিনে নিমজ্জিত একটি দেশের শবযাত্রার দুঃখগাঁথা

কফিনে নিমজ্জিত একটি দেশের শবযাত্রার দুঃখগাঁথা
আন্ডারটেকাররাও সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদের সুরক্ষা সরঞ্জাম ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে ● বিবিসি

ভালোবাসার কেউ যখন মারা যান, তখন তাকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে পারাটাকেই হয়তো সবকিছু মনে হয়। তবে ইতালীয়দের শেষ বিদায় জানানোর এই সুযোগটি কেড়ে নিয়েছে করোনাভাইরাস।

মৃতদের প্রাপ্ত মর্যাদাটুকু কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং জীবিত স্বজনদের দুঃখ বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুণ।

করোনার মহামারি আপনাকে একবার নয়, দু’বার মেরে ফেলবে কথাগুলো এভাবেই বলেন আন্দ্রেয়া সেরাতো। তিনি ইতালির শহর মিলানে শেষকৃত্য ব্যবস্থাপনার কাজ করেন।

তিনি বলেন, এটি মৃত্যুর আগেই আপনাকে আপনার প্রিয়জনদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই ভাইরাসের কারণে কেউ আপনার কাছাকাছিও ঘেষতে পারে না।

সেরাতো বলেন, পরিবারগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে এবং এমন বাস্তবতা মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তাদের।

মারা যাচ্ছেন বিচ্ছিন্ন অবস্থায়

কোভিড -১৯ এ আক্রান্ত অনেকেই হাসপাতালে বিচ্ছিন্ন থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। শেষ মুহূর্তে পরিবার বা বন্ধু-বান্ধব কাউকে কাছে পাননি।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি খুব বেশি হওয়ায় রোগীদের সাথে দেখা করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদিও ইতালির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পরে ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারে না। তবে এই ভাইরাস কয়েক ঘণ্টা ধরে কাপড়ের উপরে বেঁচে থাকতে পারে।

এর অর্থ, ভাইরাসে আক্রান্ত কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহ সঙ্গে সঙ্গে প্যাকেটে ভরে ফেলা হয়।

অনেক পরিবার আমাদের কাছে জানতে চায় যে তারা শেষবারের মতো প্রিয়জনের মরদেহটি দেখতে পারবেন কি-না। কিন্তু এটি নিষিদ্ধ, বলছিলেন ম্যাসিমো ম্যানকাস্ট্রোপা। যিনি ক্রিমোনা শহরের শবদেহ ব্যবস্থাপনার কাজ করেন।

মৃতদের এখন আর তাদের সবচেয়ে সুন্দর এবং প্রিয় পোশাক পরিয়ে সমাধিস্থ করা যায় না। এর পরিবর্তে তাদের ভাগ্যে জোটে হাসপাতালের পরিচয়হীন গাউন।

তবে ম্যানকাস্ট্রোপা তার সাধ্যমতো যতোটা সম্ভব চেষ্টা করছেন।

তিনি বলেন, পরিবারগুলো আমাদের যে পোশাকগুলো দেয় আমরা সেটা মরদেহের ওপর বিছিয়ে দেই, যেন দেখে মনে হয় তিনি ওই পোশাকটি পরে আছেন। উপরে একটা শার্ট থাকে, নিচে থাকে স্কার্ট।

আমাদের বিশ্বাস করা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় থাকে না

এমন অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে এই শবদেহ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কর্মীরাই নিজেদের মৃতের পরিবার, বন্ধু এমনকি বদলি পুরোহিত হিসেবে ভাবতে শুরু করেন।

এর কারণ ভাইরাসের প্রকোপে যারা মারা গেছেন, তাদের কাছের লোকরা বেশিরভাগ সময়েই কোয়ারেন্টাইনে আলাদা থাকেন।

আমরা তাদের সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করি মন্তব্য সেরাতোর।

তিনি আরও বলেন, মৃত ব্যক্তিকে যে কফিনে রাখা হয়, আমরা সেই কফিনটার ছবি তুলে তাদের প্রিয়জনদের পাঠাই। তারপর আমরা হাসপাতাল থেকে মরদেহটি তুলে নিয়ে সেটিকে কবর দিই না হয় পুড়িয়ে ফেলি। আমাদের ওপর বিশ্বাস করা ছাড়া মৃতের পরিবারের আর কোনও উপায় নেই।

সেরাতোর পক্ষে সবচেয়ে কঠিন হয়ে যায়, শোকসন্তপ্ত পরিবারের কষ্ট লাঘব করতে না পারাটা।

তিনি কী কী করতে পারবেন, সেটা আর মৃতের পরিবারকে তিনি বলেন না— বরং কী করতে পারবেন না সেটাই বলেন।

যেসব কাজ করার আর অনুমতি নেই, এমন সমস্ত কিছু তালিকাভুক্ত করতে তিনি বাধ্য হয়েছেন।

তিনি বলেন, আমরা মৃতদেহকে আর সাজাতে পারি না, আমরা তাদের চুল আঁচড়ে দিতে পারি না, আমরা তাদের মুখে প্রসাধনী লাগাতে পারি না। আমরা তাদের দেখতে সুন্দর এবং শান্তিপূর্ণ করে তুলতে পারি না। এটি খুবই দুঃখজনক।

বিদেহী মানুষদের প্রতি একটি কর্তব্য

সেরাতো তার বাবার মতো গত ৩০ বছর ধরে আন্ডারটেকার হিসেবে অর্থাৎ শবদেহের ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন।

তিনি বিশ্বাস করেন, ছোট ছোট কিছু বিষয় শোকগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, শেষবারের মতো তাদের গালে হাত বুলিয়ে দেয়া, তাদের হাত ধরা এবং শেষ সময়ে তাদের সুন্দর দেখানো। এগুলো একটাও করতে না পারা খুব কষ্টের।

ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এই সময়ে, শবদেহ ব্যবস্থাপকদের প্রায়শই একটি বন্ধ দরজার অপর পাশ থেকে শোকগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে হয়।

স্বজনরা এখনও হাতে লেখা নোট, বংশের চিহ্ন বহনকারী বস্তু, ছবি এবং কবিতা লিখে দেন— এই আশায় যে তাদের তাদের মা-বাবা, ভাই, বোন, ছেলে বা মেয়ের পাশে সমাধিস্থ করা হবে।

তবে এসবের কোনও কিছুই কফিনে রাখা হয় না।

সুরক্ষা সরঞ্জাম ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে

ব্যক্তিগত সামগ্রী সমাহিত করা এখন অবৈধ। এই নিয়ম বেশ কঠোর হলেও এটি প্রণয়ন করা হয়েছে যেন ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করা যায়।

যদি কেউ বাড়িতে মারা যান, তখনও শবদেহ ব্যবস্থাপকদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়, তবে তাদের সে সময় পুরো প্রতিরক্ষামূলক পোশাক যেমন চশমা, মুখোশ, গ্লাভস, কোট ইত্যাদি পরে আসতে হয়।

যিনি সবেমাত্র তার প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তার পক্ষে এমন একটি উদ্বেগজনক দৃশ্য দেখা বেশ কষ্টকর।

তবে অনেক শবদেহ ব্যবস্থাপক এখন নিজেদের কোয়ারেন্টাইন করে অর্থাৎ আলাদা করে রেখেছেন।

অনেককে ব্যবসাও বন্ধ করতে হয়েছে, কারণ তাদের বড় উদ্বেগ হল যারা মৃতদের ব্যবস্থাপনার কাজ করেন তাদের অধিকাংশের পর্যাপ্ত মাস্ক বা গ্লাভস নেই।

সেরাতো বলেন, আমাদের কাছে আরও এক সপ্তাহ চলতে পারার মতো পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষামূলক জিনিসপত্র রয়েছে।

কিন্তু যখন এগুলো শেষ হয়ে যাবে, তখন আমরা আর কাজ করতে পারব না। আমরা দেশের অন্যতম বড় শেষকৃত্য আয়োজক। আমাদেরই এই অবস্থা। তাহলে বাকিরা কীভাবে মোকাবেলা করছে, আমি সেটা কল্পনাও করতে পারি না।

নিষিদ্ধ শেষকৃত্য

ভাইরাসটির বিস্তার রোধে ইতালির সরকার একটি জরুরি জাতীয় আইনের মাধ্যমে শেষকৃত্য সেবা নিষিদ্ধ করেছে।

এত কঠোর রোমান ক্যাথলিক মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি দেশের জন্য এমন আইন নজিরবিহীন।

দিনে অন্তত একবার সেরাতো একটি মরদেহ কবর দেন। কিন্তু একজনও আসে না বিদায় জানাতে— কারণ প্রত্যেকে কোয়ারেন্টাইনে থাকেন।

দাফনের সময় একজন বা দু’জনকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়, ব্যাস এটুকুই।

ম্যানকাস্ট্রোপা বলেন, কেউ কোনও কথা বলার মতো অবস্থায় থাকে না। তাই সেখানে থাকে কেবল নীরবতা।

তিনি যখনই পারেন, সেটা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন। তাই তিনি গাড়িতে কফিনটি নিয়ে একটি গির্জার দিকে যান, বুটটি খোলেন এবং যাজককে তখনই প্রার্থনা করতে বলেন।

এটি প্রায়শই এক সেকেন্ডের মধ্যে করা হয়। কারণ আপনার পরে আরও অনেকে অপেক্ষা করছে।

কফিনে নিমজ্জিত একটি দেশ

ইতালিতে মৃতের সৎকারের ব্যবসাও ব্যাপক হারে বাড়ছে। মৃতের সংখ্যাও বেড়েই চলছে।

এখনও পর্যন্ত ভাইরাসের আক্রমণে দেশটিতে প্রায় ১১ হাজার মানুষ মারা গেছেন (৩০ মার্চ)— যা বিশ্বের যে কোনও দেশের চেয়ে বেশি।

সেরাতো বলেন, ক্রিমোনা শহরে শেষকৃত্য আয়োজক প্রতিষ্ঠানের বাইরে লম্বা লাইন দেখতে পাবেন। প্রায় সুপারমার্কেটের মতো।

উত্তর ইতালির প্রতিটি হাসপাতালের মর্গ মরদেহে পূর্ণ হয়ে গেছে।

ম্যানকাস্ট্রোপা বলেন, ক্রিমোনা শহরের হাসপাতালের প্রার্থনা কক্ষগুলো কফিনের গুদামে পরিণত হয়েছে।

গির্জাগুলোতেও কফিনের স্তূপ

ইতালির বার্গামো শহরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এজন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে— শহরটির কবরস্থানগুলো এখন পূর্ণ হয়ে গেছে।

গত সপ্তাহের এক রাতে, স্থানীয় বাসিন্দারা দেখতে পান, সেনাবাহিনীর সারি সারি ট্রাক রাস্তা দিয়ে ধীর গতিতে যাচ্ছে।

ওই গাড়িগুলো করে ৭০টিরও বেশি কফিন নিয়ে যাওয়া হয়। স্থানীয়রা চুপ করে এই দৃশ্য দেখছিলেন।

প্রত্যেকটি ট্রাকে একটি করে মরদেহে ছিল, হয়তো কারও বন্ধু বা প্রতিবেশী। তাদের মরদেহ, পাশের একটি শহরে নিয়ে যাওয়া হয় পুড়িয়ে ফেলার জন্য।

প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে এমন কিছু দৃশ্য খুবই বেদনাদায়ক এবং মর্মস্পর্শী।

মৃতদেহের ভার বহনকারীরা পায়নি কোনও মূল্যায়ন

ইতালির চিকিৎসক ও নার্সদের সবচেয়ে অন্ধকারতম সময়ের নায়ক, উদ্ধারকর্তা হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।

তবে শেষকৃত্যের পরিচালকরা তাদের কাজের জন্য কোনও স্বীকৃতি পাননি। অনেকে আমাদের কেবল মরদেহের পরিবহনকারী হিসাবে দেখেন ম্যানকাস্ট্রোপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাগুলো বললেন।

তিনি বলেন, অনেক ইতালীয় তাদের কাজকে পাতালপুরের অশুভ পৌরাণিক চরিত্র শ্যারণের মতো দেখেন- যিনি জীবন ও মৃত্যুর মাঝে বয়ে চলা নদীর মাঝি। কেউ মারা গেলে এই শ্যারণ মৃতের আত্মাকে জীবিতদের পৃথিবী থেকে আলাদা করে নদীর ওই পারে নিয়ে যায়।

তার মতে, অনেকের দৃষ্টিতে আমাদের কাজ কৃতজ্ঞতা পাওয়ার যোগ্য নয়। অনেকের কাছে মনে হয় এই কাজের জন্য মাথা খাটাতে হয় না। তবে আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে আমরা যা চাই তা হল মৃতদের মর্যাদা দিতে।

#Andratuttobene - ইতালীয় ভাষার এই শব্দের অর্থ ‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে’-ইতালিতে সঙ্কট শুরু হওয়ার পর থেকেই এই হ্যাশট্যাগ একটি রেইনবো ইমোজিসহ অনেক ব্যবহার হচ্ছে।

কিন্তু এই মুহূর্তে কারও চোখে কোন আশার আলো নেই। যদিও সবাই এর জন্য প্রার্থনা করছেন, তবে কেউ ঠিক বুঝতে পারছেন না যে কখন আবার সবকিছু ঠিক হবে। বিবিসি।

এসএমএম