• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ৭, ২০২০, ০৩:২৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ৭, ২০২০, ০৩:২৮ পিএম

চীনে বুবোনিক প্লেগ সংক্রমণ

নতুন ব্যাধি নয়, চোখ রাঙাচ্ছে সহস্রাব্দ পুরনো ‘কালোমৃত্যু’

নতুন ব্যাধি নয়, চোখ রাঙাচ্ছে সহস্রাব্দ পুরনো ‘কালোমৃত্যু’

ৎপত্তিস্থল চীন থেকে বিস্তার লাভ করা করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। এরইমাঝে এবার দেশটিতে ইতিহাসের পাতায় 'কালোমৃত্যু' খ্যাত প্রাণঘাতী ‘বুবোনিক প্লেগ’ রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্ট হয়েছে। এরইমধ্যে বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে বিষয়টি। তবে কেন তা নিয়ে এতটা উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা তা বুঝে নিতে, সাম্প্রতিক ঘটনার পাশাপাশি বুবোনিক প্লেগ প্রসঙ্গে প্রাপ্ত ইতিহাস ও গবেষণাভিত্তিক বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে দৃষ্টিপাত করা একান্ত প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ বিভিন্নসূত্রের তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায় যে অনেক ক্ষেত্রেই চীনের এই বুবোনিক প্লেগ প্রসঙ্গটিকে সেদেশে 'এক নতুন প্রাণঘাতী রোগের সংক্রমণ' দেখা দেয়ার তথ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তবে এই ধারণাটি মোটেই সঠিক নয়। বরং বলা যায়, চীনে নতুনভাবে অতি প্রাচীন একটি প্রাণঘাতী ভয়াল ব্যাধির সংক্রমণ নতুন করে বিস্তার শুরুর লক্ষণ দেখা দিয়েছে। গত দিন কয়েক যাবত বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচনায় এলেও চীনে এর সংক্রমণ সৃষ্টির সাম্প্রতিক সম্ভাব্যতা দেখা দেয় মূলত ২০১৯ সালের নভেম্বর মাস নাগাদ। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশদভাবে তুলে ধরেছিল।

চলমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যানুসারে জানা যায়, চীনের উত্তরাংশের মঙ্গোলিয়া শহরে বুবোনিক প্লেগের ফলে মহামারির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই রোগ খুব দ্রুত অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করে তৃতীয় স্তরের সতর্কবার্তা ঘোষণা করা হয়েছে। 

গত শনিবার বায়ানুরের উরাদ মিডল বানারের একটি হাসপাতালে প্রথম বুবোনিক প্লেগে আক্রান্ত এক রোগীর সন্ধান মেলে যা নাকি ভয়ঙ্কর সংক্রামকই শুধু নয়, প্রাণঘাতীও। প্রদেশের দুটি আলাদা হাসপাতালে দুজনের চিকিৎসা চলছে। তাদের সংস্পর্শে আশা আরও ১৪৬ জনকে চিহ্নিত করে আইসোলেট করা হয়েছে। হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা চলছে। এরপরেই স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সতর্কতা জারি করে বলে, বর্তমানে এই প্লেগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। যাদের শরীরে এই রোগের লক্ষণ দেখা যাবে তারা বিন্দুমাত্র দেরি না করে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে হবে। তিন স্তরের সর্তকর্তা জারি করে প্লেগ বহন করতে পারে এমন প্রাণীদের শিকার ও খাওয়া জনসাধারণকে নিষেধ করা হয়েছে।

চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম পিপলস ডেইলি অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত এই নির্দেশনা জারি থাকবে।

বিশেষ এক ধরনের মাছির মাধ্যমে বিস্তার ঘটাতে সক্ষম বুবোনিক প্লেগের জীবাণু - সংগৃহিত 

বুবোনিক প্লেগ বা শুধুই প্লেগ যে নামে ডাকা হোক না কেন, এ মহামারি পনেরো শতকে ইউরোপের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগকে বিলুপ্ত করে দিয়েছিল। গবেষকদের তথ্য মতে, বুবোনিক প্লেগের উৎপত্তিস্থল এশিয়ার রাষ্ট্র এই চীনের বুকেই যা বিভিন্ন সময় এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল বিপর্যস্ত করেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এশিয়ায় প্লেগের মহামারি চলাকালে সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় নথিভুক্ত করা হয়নি। ১৩৩০-৪০ সালের মধ্যে এ রোগ ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছিল।

গবেষকরা মনে করেন, প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে 'কালো মৃত্যু বা ব্ল্যাক ডেথ' খ্যাত বুবোনিক প্লেগের উদ্ভব ঘটে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। আবার অনেকে মনে করেন, এশিয়ার মধ্যাঞ্চল থেকে এ রোগের উৎপাত্তি হয়েছে। তবে ইতিহাসের তথ্য বলছে, ১৩৩১ সালে ইউয়ান সাম্রাজ্যে প্লেগ সংক্রমণের ফলে এক ভয়াবহ মহামারির সূত্রপাত হয়েছিল, যার ফলে সে সময় চীনে মোঙ্গল শাসনের যবনিকা ঘটেছিল। ঠিক তিন বছর পরই হেবেই প্রদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ এক ভয়াল প্লেগে মারা যায়। মৃতের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫০ লাখের মতো। সেটিই ছিল নতুন করে মানব সভ্যতাকে চোখ রাঙানো এই বুবোনিক প্লেগ।

সুঁচালো দাঁতের কাঠবিড়ালী গোত্রীয় প্রাণীর মাধ্যমে ছড়ায় বুবোনিক প্লেগ 

বিজ্ঞানীরা প্রাণীর বংশগত জিনের ধারা-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছেন, দুই হাজার বছর আগে চীনে উৎপাত্তি হওয়া প্লেগ রোগ পৃথিবীর প্রায় ১০ কোটি মানুষের প্রাণ হরণ করেছে। বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা মেডিকেল জার্নাল-নেচার জেনেটিকসে এসব তথ্য জানিয়েছেন। প্রাথমিককাল থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত প্লেগ মহামারির গঠন গবেষকরা জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে পুনর্গঠিত করতে পেরেছেন।

নতুন এ গবেষণায় বলা হয়েছে, দুই হাজার বছর আগে চীনে উৎপাত্তি হওয়া প্লেগ রোগ সারা বিশ্বে ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন কালপর্বে। বিজ্ঞানীরা প্লেগের ১৭টি সম্পূর্ণ জিনোম ও ৯৩৩টি পরিবর্তনশীল ডিএনএ নিয়ে তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছেন এবং তাদের কাছে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা প্লেগ জীবাণুর নমুনা ছিল। এ গবেষণা থেকে তারা জানতে পেরেছেন, প্লেগ রোগ মহামারি আকারে কোথায় কোথায় সংঘটিত হয়েছিল এবং কীভাবে কাজ করেছে।

গবেষকরা জানিয়েছেন, শুরুতে প্লেগ রোগের জীবাণু চীনের কাছাকাছি অথবা চীনে বিস্তার লাভ করেছিল। পরে এ রোগ বিভিন্ন পথে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পরে। যেমন পশ্চিম এশিয়ায় পৌঁছে যায় রেশমপথ হয়ে এবং একজন চৈনিক পরিব্রাজক ঝ্যাং হের মাধ্যমে ১৪০৯-৩৩ সালের মধ্যে হাজির হয় আফ্রিকায়।

কালো মৃত্যুখ্যাত প্লেগ রোগ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে ১৩৪৭-৫১ সালের মধ্যে। প্লেগ ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৪৫ থেকে নেমে ৩৫ কোটি হয়ে গিয়েছিল। চীনের জনসংখ্যার অর্ধেক, ইউরোপের তিন ভাগের এক ভাগ এবং আফ্রিকার আট ভাগের এক ভাগ প্লেগের আক্রমণে মারা গিয়েছিল।

১২০০ সালে চীনের জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি, কিন্তু ১৩৯৩ সালের পরিসংখ্যান জানায় যে দেশটিতে মাত্র ৬ কোটি ৫০ লাখ বেঁচে ছিল। এর মধ্যে আবার অনেকে দুর্ভিক্ষের কারণে এবং ইউয়ান রাজত্ব থেকে মিং শাসনের উত্থান পর্বের অরাজকতার প্রেক্ষিতে মারা যায়। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ মারা যায় এই প্রাণঘাতী বুবোনিক প্লেগ রোগে।