• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২১, ০৭:১৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ১৩, ২০২১, ০৭:২৯ পিএম

পাকিস্তানে সংখ্যালঘু নির্যাতন

অপহরণের পর জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও বাল্যবিবাহ!

অপহরণের পর জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও বাল্যবিবাহ!

চৌদ্দ বছর বয়সী নেহা (ছদ্মনাম) খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। কয়েক বছর আগে প্রতিবেশি এক নারী তাকে হাসপাতালে যাওয়ার কথা বলে সঙ্গে নিয়ে যায়। এরপর নেহাকে বন্দি করে তার দেবর সান্দাস বালুছকে বিয়ে করতে জোর করেন সেই নারী। ছোট ভাইকে মেরে ফেলার হুমকি দিলে নিজের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নেহা এবং বিয়ে করেন সান্দাসকে। ধর্মান্তরিত নেহার নতুন নাম রাখা হয় ফাতিমা। এভাবেই জীবন বাঁচাতে নিজের ধর্ম ত্যাগ করে প্রতিবেশীর পয়তাল্লিশ বছর বয়সী বিবাহিত দেবরের দ্বিতীয় স্ত্রী হন ফাতিমা।

এরপর বন্দীজীবনে ফাতিমার উপর চলে স্বামীর পাশবিক নির্যাতন। শেষ পর্যন্ত শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ফাতিমা তাঁর কথিত স্বামীর মেয়ের সাহায্য নিয়ে সেই নরক থেকে পালিয়ে আসে। স্বামীর পরিবারের লোকজনের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো নেহাকে আশ্রয় দেয় করাচীর একটি চার্চ। তাঁর দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা ছাপা হয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় বার বার কেঁপে উঠছিল নেহার কণ্ঠ। তিনি জানান, এখনো তাঁকে তাড়া করে বেড়ায় সেই ভয়াবহ অতীত। প্রতিদিন সকালে চার্চে গান গাওয়ার সময় তাঁর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরে নিরব অশ্রু। নেহার মতো অনেক মেয়েই প্রতি বছর জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে পাকিস্তানে। তাদের বন্দী রেখে বিয়ের নামে নিজেদের দাসে পরিণত করছে অত্যাচারী স্বামীরা। 

সিন্ধু প্রদেশের তের বছর বয়েসী হিন্দু ধর্মাবলম্বী সনিয়া কুমারি। অপহরণ হবার একদিন পর পুলিশ তার পরিবারকে জানায়, তাদের মেয়ে ‘স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহন করে ৩৬ বছর বয়স্ক দুই সন্তানের জনক-কে বিয়ে করেছে’। অথচ এর আগেই সনিয়ার মায়ের কান্না জর্জরিত এক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে তিনি বারবার বলেন, “ওরা আমার মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে। দয়া করে আপনারা আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন...”।

একই ঘটনা করাচীর বাসিন্দা তের বছরের আরজু রাজার ক্ষেত্রেও। আরজুর অপহরণের পর এই খ্রিস্টান পরিবারকে পুলিশ জানায়, তাদের মেয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে চল্লিশোর্ধ এক প্রতিবেশীকে বিয়ে করেছে। আদালত ভবনের বাইরে আরজুর মায়ের মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আকুতির ভিডিওটিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ নিয়ে উদ্বেগ জানায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো। অথচ সনিয়া কিংবা আরজুর মা কারো অভিযোগই আমলে নেয়নি পুলিশ।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য নিয়মিত খবরের শিরোনাম হওয়া দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশ পাকিস্তানকে ‘কান্ট্রি অফ পার্টিকুলার  কন্সার্ন’ বা উদ্বেগজনক রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন কংগ্রেসের ‘ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম এক্ট ১৯৯৮’ অনুযায়ী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতনকারী রাষ্ট্রকে এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৮ সালেও দেশটিকে একই তালিকায় দেখানো হয়।

সম্প্রতি পুলিশের সামনে মন্দির ভাঙার ঘটনাতেও প্রমাণ হয় যে পাকিস্তানে কেবল সংখ্যালঘু শিয়া মুসলিম নয়, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও খুব একটা ভালো নেই। আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস, এপির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানে প্রতি বছর প্রায় এক হাজার মেয়েকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে।

এই হিন্দু, খ্রিস্টান কিংবা শিখ সম্প্রদায়ের ধর্মান্তরিত মেয়েদের বেশিরভাগই অপ্রাপ্তবয়স্ক। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার তিন দশমিক ছয় ভাগই সংখ্যালঘু। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর উদাসীনতা এবং সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় তাদের জীবনকে করছে দুর্বিষহ, পরিস্থিতিকে করে তুলছে আরও সঙ্গিন। একদিকে এরা যেমন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর টার্গেটে পরিণত হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় প্রভাবশালীরাও নানাভাবে হয়রানি করছে।

পাকিস্তান হিউম্যান রাইটস কমিশন সহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, সংখ্যালঘু এই মেয়েরা অপহৃত হচ্ছে পরিচিত জনদের মাধ্যমেই। এর পেছনে পাকিস্তানের সংখ্যালঘু অমুসলিমদের আর্থসামাজিক অবস্থা, সামাজিক অবক্ষয়, পুরুষদের বিকৃত যৌন রুচিকে দায়ী করছে বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু প্রশাসন ও রাষ্ট্রের উদাসীনতায় আইনের ফাঁক গলে প্রতিবারই পার পেয়ে যাচ্ছে এই চক্রটি।

(তথ্যসূত্র: এসোসিয়েট প্রেস, উইকিপিডিয়া ও ইন্টারনেট)

আরও পড়ুন