• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০১৮, ১২:৩০ পিএম

চরাঞ্চল নিয়ে কাজ করছি, রাজনৈতিক দলের ইশতেহারেও যেন থাকে

চরাঞ্চল নিয়ে কাজ করছি, রাজনৈতিক দলের ইশতেহারেও যেন থাকে

 

ড.আতিউর রহমান দেশের একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। তিনি একজন সুলেখকও বটে। তিনি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক আবহ নিয়ে দৈনিক জাগরণকে সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে উন্নয়ন হয়েছে বিস্ময়কর রকমের। জাগরণের পক্ষে একান্ত সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেছেন এম এ খালেক

জাগরণ : বর্তমান সরকার অব্যাহতভাবে ১০ বছর। এই সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ড.আতিউর রহমান: বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে তারা একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। এর আগে অনেক সরকার তাদের ভিশনটা আর্টিকুলেট করতে পারেন নি কোথায় তারা আছেন এবং কোথায় তারা যাবেন। আমি বলবো, এটা বর্তমান সরকারের একটি বড় ধরনের কৃতিত্ব যে তারা ভিশনটা  দিতে পেরেছিল। এবং সেই ভিশন তাদের নির্বাচনি ইস্তেহার দিন বদলের সনদ এ স্থান পেয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে আমিও সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সেই ভিশনে তারা বলেছিল, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়বে। ডিজিটাল বাংলাদেশ একটি বড় কনসেপ্ট। এটা শুধু প্রযুক্তির ব্যবহার নয়। ডিজিটাল কালচার হলো, সমাজে একটি জিডিটাল সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করবেন এবং একই সঙ্গে ডিজিটাল কালচারের বড় কথা হলো পরিকল্পনার পাশাপাশি সঠিক বাস্তবায়ন বা ইম্পিমেন্টেশন।

অর্থাৎ শুধু পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই হবে না সেই পরিকল্পনা সঠিকভাবে নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করা হবে। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে বর্তমান সরকার নানামুখি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং সেই পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের একটি বড় সুবিধা ছিল তারা দু’ টার্ম ধরে ক্ষমতায় আছেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ধারাবাহিকতা না থাকলে এক সরকার যে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তা মাঝপথে আটকে যায়। এতে উন্নয়ন কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। আমরা দেখেছি, ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার অনেকগুলো জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু ২০০১ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পরিবর্তন হলে সেই সব পরিকল্পনার বেশির ভাগই মাঝপথে থেমে যায়। কিন্তু ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অব্যাহতভাবে দু’টার্ম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন আছে। ফলে তাদের পক্ষে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে সুবিধা হয়েছে। কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় নি। আমরা এর ফলও হাতে হাতেই পেয়েছি। বর্তমান সরকার আমলে দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তা এক কথায় বিস্ময়কর। উন্নয়ন কার্যক্রমের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সঠিকভাবে তা বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখাতে পেরেছেন।
আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন খাত ভিত্তিক আলোচনা করতে পারি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় মাপকাঠি হচ্ছে একটি দেশের জনগণের মাথাপিছু গড় জাতীয় বৃদ্ধি পাওয়া। আমরা লক্ষ্য করছি,২০০৮ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় ছিল ৬৮৬ মার্কিন ডলারের মতো। দশ বছরের মাথায় এসে এটা বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ বর্ণিত সময়ে মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় বেড়েছে প্রায় তিনগুন। মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় তো এমনি এমনি বাড়েনি। এ জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করবো,শুধু বিনিয়োগ বাড়েনি একই সঙ্গে কনজামশন বা ভোগ ব্যয়ও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে বিনিয়োগ প্রায় তিনগুন বেড়েছে। এবং কনজামশনও তিনগুন বেড়েছে। অর্থাৎ দেশে যে বিনিয়োগ হচ্ছে তার ফসলটা সাধারণ মানুষের ঘরে পৌঁছুতে পেরেছে। তারা শুধু কেকটাই বড় করেনি, সেই কেকটা সবার নিকট পৌঁছানোর ব্যবস্থাও করেছে। যার প্রমাণ মেলে পরিসংখ্যানে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের জিডিপি’র আকার বা সাইজ ছিল ৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত অর্থ বছরে সেই জিডিপি’র আকার ২৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। চলতি অর্থ বছরে এটা ২৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে বলে আমরা আশা করছি। ২০২০ সাল নাগাদ এটা জিডিপি’র আকার ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করে যাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। সুতরাং আমি বলবো, বর্তমান সরকার আমলে দেশের অর্থনীতিতে চমৎকার গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির মধ্যেও এই বিষয়টি প্রতিফলিত হচ্ছে।

আমরা লক্ষ্য করছি, গত প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশ টেকসইভাবে ৬ শতাংশের উপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। গত তিন বছর ধরে এটা ৭ শতাংশের উপরে রয়েছে। গত অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭দশমিক ৮৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আমরা আশা করছি,চলতি অর্থ বছরে এটা হয়তো বা এটা ৮ শতাংশ স্পর্শ করবে। পুরো বিশ্বে যে ১০টি দেশ টেকসইভাবে উচ্চ মাত্রায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবার শীর্ষে রয়েছে। এমন কি বাংলাদেশ প্রতিবেশি দেশ ভারতের চেয়েও বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। চলতি অর্থ বছরের গত ত্রৈমাসিকে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭দশমিক ১ শতাংশ। আমরা তো চলতি অর্থ বছরে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি স্পর্শ করবো। ভারত এবং চীনও প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে অনেক পেছনে পড়ে রয়েছে। আমি বলবো, বর্তমান সরকারের আমলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক ধরনের গতি এসেছে। ডিজিটাল কালচারের একটি বড় গুন এবং সাফল্য নির্ভর করে প্রধান নির্বাহী কিভাবে নেতৃত্ব দেন তার উপর। আমাদের বড়ই সৌভাগ্য যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি আমাদের প্রধান নির্বাহী তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দিন বদলের সনদ তিনি শুধু তৈরি করেন নি একে হৃদয়ে ধারন করেছেন এবং সফলভাবে বাস্তবায়ন করে চলেছেন।
বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই শুধু ব্যাপক মাত্রায় উন্নয়ন অর্জন করেছে তা নয়,অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন ঈর্ষণীয়। বিশেষ করে সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের উন্নয়ন যে কোনো বিচারেই বিস্ময়কর। এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের উত্থান আমরা লক্ষ্য করছি। অনেক দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলেও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সামাজিক উন্নয়ন ঘটে না। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক উন্নয়ন তাল মেলাতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশে যখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন সীমিত ছিল, মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় কম ছিল তখনও আমাদের সামাজিক উন্নয়নের একটি গতি ছিল। বর্তমান সরকারের আমলে সামাজিক উন্নয়নে গতি আরো বেগবান হয়েছে। কোনো কোনো সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকেও অতিক্রম করে গেছে। শিশু মৃত্যু, মাতৃ-মৃত্যু ইত্যাদি সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে কমেছে তা পুরো উন্নয়নশীল দেশের জন্য ঈর্ষণীয়। আমাদের মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় যে গতিতে বেড়েছে তা ভারতের তুলনায় তিন গুন বেশি। ২০২০ সালে আমরা ভারতের মাথাপিছু গড় জাতীয় আয়ের যে অঙ্ক তাকে ধরে ফেলবো। আমরা এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে অনেক অগেই পেছনে ফেলে চলে এসেছি। মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় বৃদ্ধির প্রতিফলন আমরা সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। মাতৃ-মৃত্যু হ্রাস এবং অন্যান্য সামাজিক সূচকে উন্নয়নের কারণে আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। কমিউনিটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। চিকিৎসা সেবা সাধারণ মানুষের দ্বারপ্রান্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নানাভাবে উন্নতি হচ্ছে। শুধু প্রচলিত শিক্ষা নয় কারিগরি শিক্ষা ক্ষেত্রেও জোর দেয়া হচ্ছে। সামাজিক শিক্ষা বিস্তারের হারও বেশ ভালো। সরকার এ জন্য প্রাইভেট সেক্টর,এনজিও সবাইকে কাজ করতে দিয়েছে। ফলে এ ক্ষেত্রে ভালো উন্নতি হচ্ছে। সরকার সবাইকে নিয়ে কাজ একযোগে কাজ করছে। বাংলাদেশ অনাকাঙ্খিত জন্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় সফল হয়েছে। ১৯৭২ সালে একটি দম্পতির কম করে হলেও ৫ থেকে ৬টি সন্তান থাকতো। সেটা হ্রাস পেয়ে এখন ২ দশমিক ১ এ নেমে এসেছে। তার অর্থ হচ্ছে প্রায় রিপ্লেসমেন্ট রেটের সমান হয়ে গেছে। এর ফলে আমাদের মাথাপিছু গড় জাতীয় আয়ও বাড়ছে। মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় বাড়ছে কিন্তু মানুষ সেভাবে বাড়ছে না। এই আয়টা যেহেতু আমরা সবার মধ্যে ভাগ করে দিতে পারছি সে কারণেই কনজামশনটাও বাড়ছে। মানুষের আয় এবং কনজামশন বাড়ার কারণে পুষ্টি গ্রহণের মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি দারিদ্র্যের হার হ্রাসের মাধ্যমে।

জাগরণ : বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোগ কতটা আছে বলে মনে করেন?

ড.আতিউর রহমান: আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় যেমন বাড়ছে তেমনি দারিদ্র্যের হারও হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশে অতি দরিদ্র মানুষের হার হচ্ছে প্রায় ১১ শতাংশ। খুব সহসাই এটা আমরা আরো ৪/৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারবো বলে আশা করা হচ্ছে। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশই যুব শ্রেণির। এর সুফল আমরা পাচ্ছি। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা হয়তো আরো দু’দশক আমরা পাবো। তাই বোনাসটা ফুরিয়ে যাবার আগেই আমরা যাতে তরুণ জনশক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারি তার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের উপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে এ জন্য কারিগরি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমান সরকার এ বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করছেন বলেই কারিগরি শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দিচ্ছেন। আগে কারিগরি শিক্ষার হার ২ শতাংশেরও কম ছিল। গত ১০ বছরে সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টায় এটা প্রায় ১৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় একটি প্রশিক্ষণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পে বিভিন্ন এনজিও, গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। আমার প্রস্তাব থাকবে, এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটি স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি গঠন করা যেতে পারে। যারা সবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কিভাবে স্কিল আরো ডেভেলপ করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করবে। স্কিল বা দক্ষতা উন্নয়ন আমাদের জন্য খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছি প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিটেন্স থেকে। যারা বিদেশে কাজ করছে তাদের যদি স্থানীয় ভাষা শিক্ষা দেয়া যেতো। তাদের দক্ষতা উন্নয়ন ঘটানো যেতো বা তারা যে কাজ করবে সেই ব্যাপারে কিছুটা প্রশিক্ষণ দেয়া যেতো তাহলে এ খাতের আয় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করা কোনো কঠিন কাজ নয়।

জাগরণ : আপনি তো রেমিটেন্সের কথা বললেন। বাংলাদেশের বেশির ভাগ রেমিটেন্স আসে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ মুসলিম দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পাবার কারণে অনেক দেশ তাদের উন্নয়ন কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছে। এই অবস্থায় আগামীতে রেমিটেন্স প্রবাহ হ্রাস পাবার আশঙ্কা আছে কি?

ড.আতিউর রহমান: এ ক্ষেত্রে স্কিল ডেভেলপমেন্ট করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি স্কিল ডেভেলপমেন্ট করতে পারি তাহলে কিছু লোক বিদেশ থেকে ফিরে এলেও রেমিটেন্সের পরিমাণ কমবে না। উন্নত দেশগুলোরও তো দক্ষ শ্রমশক্তির অভাব রয়েছে। ঐ সব দেশের মানুষ তো সাধারণ কাজ করতে চায় না। বিদেশে চাকরি করার পর যাদের হাতে কিছু টাকা জমেছে তারা দেশে ফিরে এলেও কোনো অসুবিধা হবে না। আমি তো মনে করি তারা দেশে ফিরে আসুক। তারা দেশে ফিরে এসে এখানে এসএমই শিল্প প্রতিষ্ঠা করুক। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতোমধ্যেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স দিয়ে স্থানীয় বেনিফিসিয়ারিরা জমি ক্রয় করতো,বাড়ি নির্মাণ করতো। এখন তারা পুকুর খনন করে। সেই পুকুরে তারা মাছ চাষ করে। তারা ভ্যান কিনে। হাঁস-মুরগীর খামার স্থাপন করে। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করবেন,বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় দেশের সিডিউল ব্যাংকগুলো কৃষি ও পল্লি ঋণ নামে এক বিশেষ ধরনের ঋণ কার্যক্রম চালু করেছে। এই ঋণের উদ্দেশ্য হলো গ্রামীণ এলাকায় উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে তোলা। গত অর্থ বছরে কর্মসূচিতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এই ঋণ কার্যক্রম গ্রামীণ এলাকায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। অনেকেই এই ঋণ নিয়ে স্থানীয়ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছেন। এই ঋণদান কার্যক্রমে মহিলাদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি এবং অকৃষি খাত পরস্পর হাত মিলিয়ে গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে। গ্রামীণ অর্থনীতি ক্রমশ কৃষি নির্ভরতা কাটিয়ে শিল্পায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। গ্রাম এখন আর সেই সনাতনি গ্রাম নেই। গ্রামে এখন শহরের সমস্ত সুবিধা পাওয়া যায়। গ্রাম এবং শহরের মধ্যে কানেক্টিভিটি বেড়েছে। সরকার উদ্যোগ নিয়েছেন প্রত্যেকটি ইউনিয়নকে সাইবার হাইওয়ের অংশ করে ফেলবেন। ইতোমধ্যেই প্রত্যেকটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থপিত হয়েছে। এখন হাই স্পীড ইন্টারনেট যদি গ্রাম পর্যায়ে চলে যায় তাহলে এখানে আউটসোর্সিং ব্যবসায় সম্প্রসারিত হবে। গ্রামগুলো ক্রমশ শহরে পরিণত হচ্ছে। শহরের সব সুবিধা এখন গ্রামেই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আমি চাই, শহরের সমস্ত সুবিধা গ্রামে সম্প্রসারিত হোক কিন্তু গ্রাম গ্রামই থাকুক। গ্রামের সংস্কৃতি এবং পরিবেশ অব্যাহত থাকুক।

জাগরণ : বাংলাদেশের ‘চর’ এলাকায় অনেক মানুষ বাস করে। তারা খুবই অবহেলিত এবং দরিদ্র। বর্তমান সরকার ‘চর’ উন্নয়নে কাজ করছে। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন কি?

ড.আতিউর রহমান: আমরা অনেক দিন ধরেই চর উন্নয়নে কাজ করছি। চরের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আন্দোলন করছি। কিছু দিন আগে আমরা বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসেছিলাম। আমরা চরের মানুষের উন্নয়নের জন্য চর ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও চরের মানুষের উন্নয়নের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ সমর্থন করেন। কয়েক বছর ধরেই তিনি জাতীয় বাজেটে নিয়মিত টাকা বরাদ্দ রাখছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো না থাকার ফলে চর উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত এই অর্থ ব্যয় করা যাচ্ছে না। সে কারণেই আমরা প্রস্তাব করেছি, পিকেএসএফ এর আদলে চর উন্নয়ন ফাউন্ডেশন তৈরি করা হোক। যার মাধ্যমে সরকার,ব্যক্তি খাত, এনজিও সবাই মিলে চর উন্নয়নের জন্য কাজ করতে পারে। আশা করি এবারের নির্বাচনি ইশতেহারে এ বিষয়টি স্থান পাবে।

জাগরণ : ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু জিডিপি’র আকার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার সেভাবে বাড়ছে না। আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ আরো চাঙ্গা হবার সম্ভাবনা আছে কি?

ড.আতিউর রহমান: আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। কারণ নির্বাচনের আগে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকে। নির্বাচনের মাধ্যমে সেই অনিশ্চয়তা কেটে যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) ইতোমধ্যেই বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা কার্যকর ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু করেছে। এতে বিনিয়োগকারিদের ভোগান্তি অনেকটাই হ্রাস পাবে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন যে স্পেশাল ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তা বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে। এসব ইকোনমিক জোনে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারিদেরও বিশেষ সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও অনেকটাই বৃদ্ধি পাবে। আশার কথা এই যে, ইতোমধ্যেই বেশ কিছু স্পেশাল ইকোনমিক জোন কাজ করা শুরু করেছে। আগামীতে আমাদের দেশের বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় অংশ আসবে এসএমই খাত থেকে। এরা হবেন ডিজিটাল উদ্যোক্তা। ছোট ছোট উদ্যোক্তারাই দেশকে অনেক দূর নিয়ে যাবেন। সরকার থেকে শুধু সহায়তা করবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায়শই বলছেন, আমরা ব্যবসায় করি না,ব্যবসায়ের সুযোগ তৈরি করে দিই। উদ্যোক্তাদের মাঝে এক ধরনের ভরসার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে প্রায়ই বলতাম ভরসার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছি। আপনারা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায় করেন। ২০০ মিলিয়ন ডলারের এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডকে আমি ২দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করে রেখে এসেছি। এটা এখন তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে ডেভেলপমেন্টাল কাজ করতে পারে তাহলে বিনিয়োগের পরিমাণ আরো বাড়বে।

জাগরণ : বাংলাদেশতো ২০২৪ সালের মধ্যে চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে জিএসপি সুবিধাসহ বেশ কিছু সুবিধা হারাবে। এই অবস্থা মোকাবেলার জন্য কি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন?

ড.আতিউর রহমান: আমরা ইতোমধ্যেই এ কাজ শুরু করে দিয়েছি। একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করে বাংলাদেশ অনেকের আগেই এ কাজটি শুরু করেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের হাতে এখনো পর্যাপ্ত সময় আছে। আমরা প্রায় ৮/৯ বছর সময় পাচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে আমরা আমাদের প্রস্তুতিগুলো সম্পন্ন করতে পারবো বলে আশা করছি। এই সময়ের মধ্যে আমাদের জনশক্তির দক্ষতা বাড়াতে হবে। রফতানি বাড়াতে হবে। আমরা সবুজ অর্থনীতির দিকে এগুবো। এই কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারলে তখন কারো কাছ থেকে আমাদের সহযোগিতা নেয়া লাগবে না। বরং আমরাই অন্যদের সহযোগিতা করতে পারবো।

জাগরণ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে বাংলাদেশ এ থেকে কিভাবে লাভবান হতে পারে বলে মনে করেন?

ড.আতিউর রহমান: আমরা এই বাণিজ্য যুদ্ধের একটি সুবিধা সাময়িকভাবে পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু বাণিজ্য যুদ্ধ কারো জন্যই দীর্ঘ মেয়াদে সুবিধা বয়ে আনতে পারে না। বাণিজ্য যুদ্ধ সবারই ক্ষতি করে। আশার কথা এই যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং চীনা কর্তৃপক্ষ বলেছে আপাতত তারা এই যুদ্ধ মিনিমাইজ করতে চান। তবে চীনা অর্থনীতি এই বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। চীন থেকে অনেক উদ্যোক্তা বাংলাদেশে চলে আসতে পারে। সেটা অবশ্য অন্য কারণে। চীনে যে পণ্যটি তৈরি করতে ৪ মার্কিন ডলার খরচ হয় সেই পণ্য বাংলাদেশে তৈরি করতে খরচ হয় ১ ডলার। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই অনেক বিদেশি উদ্যোক্তা বাংলাদেশে চলে আসবে। এ মুহূর্তে আমাদের স্পেশাল ইকোনমিক জোনগুলো খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। এবং যে সব নীতি সংস্কার করবো বলে আমরা কথা দিয়েছি তা খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার আরো উন্নতি করতে হবে। বিমান পরিবহনে আমরা ইতোমধ্যেই প্রচুর উন্নতি করেছি। সরকার চারদিকে খেয়াল রেখেই এগুচ্ছে এবং সে কারণেই এই সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকা খুবই জরুরি।

জাগরণ : আপনার সঙ্গে কথা বলে আমরা অনেক জানলাম। পাঠকরাও জানবে।  ধন্যবাদ আপনাকে।

ড.আতিউর রহমান: ধন্যবাদ জাগরণকে এবং আপনাদের সকলকে।