• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৮, ২০১৮, ০৪:৪০ পিএম

দেশে নারী উন্নয়নের কাজ অনেকাংশে এগিয়ে গেছে

দেশে নারী উন্নয়নের কাজ অনেকাংশে এগিয়ে গেছে

 

মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট উন্নয়ন গবেষক। তিনি নারীদের নিয়ে কাজ করেন। তিনি মনে করেন, নারীরাও সমানভাবেই নিজেকে তুলে ধরার ক্ষমতা রাখে। প্রয়োজন শুধু যথাযথ সহায়তা। দৈনিক জাগরণের পক্ষে তার সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন এম এ খালেক। 

 

জাগরণ : আপনি নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক দিন ধরে কাজ করছেন। সরকার বা বিভিন্ন সংস্থা নারী উন্নয়নে যে সহায়তা দিচ্ছে তা কি পর্যাপ্ত বলে মনে করেন?

মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী : আমাদের দেশে নারী উন্নয়নের কাজটি অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এক সময় মনে করা হতো মহিলারা শুধু ঘরের কাজ করবে। আর পুরুষরা বাইরের কাজ করবে। কিন্তু এখন সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে এ ধারণা অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এখন মনে করা হচ্ছে, নারী-পুরুষ সমতালে কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসডিজিতে বলা হয়েছে, কাউকে পিছনে ফেলে রাখা যাবে না। সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশ এ মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে নারী উন্নয়নের পেছনে অনেক কারণ কাজ করছে। এর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার বিষয়টি। মহিলারা এখন ব্যাংকিং সেক্টর থেকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। বিশেষ করে এসএমই ঋণের মাধ্যমে তারা আত্মনির্ভর হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের মহিলারা যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। তারা সুযোগ পেলে যে কোনো কাজে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করতে সক্ষম। আগে ব্যাংকগুলো সাধারণত মহিলা উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন একটা আগ্রহ দেখাত না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ব্যাংকগুলো এখন মহিলাদের জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার হিসেবে মনে করছে। তারা ঋণ ও অন্যান্য ব্যাংকিং ফ্যাসিলিটিজ প্রদানের ক্ষেত্রে মহিলাদের বিবেচনায় রাখছে। তারা দেখছে, মহিলারা সুযোগ পেলে যে কোনো কঠিন কাজও করতে পারে। অনেক সময় কোনো কোনো ব্যাংক হয়তো মহিলাদের কর্মদক্ষতার ওপর আস্থা রাখতে পারে না। তারা নিজেরা গিয়ে মহিলাদের কাজ দেখে তারপর ঋণ দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এসএমই ফাউন্ডেশন নানাভাবে মহিলা উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে সহায়তা করছে। এসএমই ফাউন্ডেশন শুধু যে ঋণ দিচ্ছে তা নয়, তারা মহিলা উদ্যোক্তা উন্নয়নে তারা নানাভাবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ প্রশিক্ষণ নিয়ে মহিলা উদ্যোক্তারা তাদের সৃজনশীল কর্মদক্ষতা বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে। 
এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে তা হলো, শুধু ঋণ বা অর্থ থাকলেই সফল উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। সফল উদ্যোক্তা হতে হলে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন উদ্যোক্তা যেমন কোনো পণ্য বা সেবা উৎপাদনের সুযোগ পান, তেমনি উৎপাদিত পণ্য ও সেবা বাজারজাতকরণ, যথাযথভাবে সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়েও জ্ঞানার্জন করতে পারেন। এসএমই ফাউন্ডেশন তাদের প্রদর্শনী গ্যালারিতে নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন পণ্য প্রদর্শন করছে। এসএমই ফাউন্ডেশন নারী উদ্যোক্তাদের যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তা অত্যন্ত উপকারী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। শুধু স্থানীয় সংস্থাগুলোই নয়, অনেক বিদেশি সংস্থাও নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এর মধ্যে জাপানি সংস্থা জাইকার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। জাইকা বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের নানাভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। আরও অনেক বিদেশি সংস্থা আছে, যারা বাংলাদেশের মহিলাদের প্রশিক্ষণদানের মাধ্যমে উপযুক্ত উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীরা তাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন হচ্ছে। একজন মহিলা হয়তো আগে একটি ব্যবসা করত। কিন্তু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেই ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ পাচ্ছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই তারা জানতে পারছে ব্যবসায়ের হিসাব কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয়, কীভাবে মালামাল সংরক্ষণ করতে হয়। কীভাবে বাজারে পণ্য ও সেবা বিপণন করতে হয়। প্রশিক্ষণের ফলে নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা আধুনিক উপায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ পাচ্ছে। 
মহিলারা এখন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন বাণিজ্যমেলায় অংশগ্রহণ করতে পারছে। এতে নতুন উদ্যোক্তা তার কাজের মান যাচাই করার সুযোগ পাচ্ছে। স্থানীয়ভাবেও এখন অনেক বাণিজ্যমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নারীরা সেখানে সাহসিকতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করছেন। প্রত্যেকটি বাণিজ্যমেলায় মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য প্রচুর স্টল বরাদ্দ থাকে। নারী উদ্যোক্তারা এখন আর কারো করুণার পাত্র নন। তারা নিজেদের যোগ্যতা বলে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অবস্থান করে নিচ্ছেন। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং আন্তর্জাতিকভাবে নানা ধরনের বাণিজ্যমেলা করছে এবং সেখানে মহিলা উদ্যোক্তাদের স্থান করে দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহিলা উদ্যোক্তারা অভিযোগ করে থাকেন যে, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বিদেশে অনুষ্ঠিত বাণিজ্যমেলায় অংশগ্রহণের জন্য তাদের নিকট থেকে অনেক টাকা নেয়, কিন্তু তারপরও দেখা যায় নারীরা এসব মেলায় অংশ নিচ্ছে। বিশেষ করে চীনে গিয়ে তারা যথেষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করছে। চীনে বাংলাদেশি পণ্যের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। মহিলা উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের সুযোগ অনেকটাই বেড়ে গেছে। আগে পুরুষরা মহিলা উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সেভাবে মেলামেশা করত না। মহিলা উদ্যোক্তাদের উৎপাদন হিসেবে সেভাবে আস্থায় রাখতে পারত না। কিন্তু যতই দিন যােেচ্ছ দেখা যাচ্ছে, মহিলা উদ্যোক্তারা তাদের মালামাল দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাজারে নিয়ে আসছে এবং পুরুষ উৎপাদকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পণ্য বিক্রি করছে। এখন মহিলা উদ্যোক্তারা ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। 

জাগরণ : মহিলা উদ্যোক্তাদের প্রতি পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি এখন কেমন বলে মনে করেন?

মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী : মহিলা উদ্যোক্তাদের প্রতি পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি আগের তুলনায় অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। আগে মহিলারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গেলে পরিবার থেকে অনেক ধরনের বাধা আসত। এখন সেই অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। এখন কোনো পরিবার থেকে একজন মহিলা ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হতে চাইলে তেমন একটা বাধা দেয়া হয় না। বরং পরিবার থেকে তারা নানাভাবে সহায়তা পাচ্ছে। কারণ একজন মহিলা উদ্যোক্তা শুধু নিজের জন্য কাজ করেন না। তিনি পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতার ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন। আগে মনে করা হতো, কোনো মহিলা ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হলে পরিবারে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাচ্চা লালন-পালন ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, মহিলারা ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হলেও তারা পরিবারকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও নারীদের গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা মেয়েদের নিকট থেকে মালামাল ক্রয় করছে। আমরা ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব স্মল অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশ (নাসিব)-এর মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দিই। অনেক সময় মহিলা উদ্যোক্তারা সঠিক সময়ে মালামাল সরবরাহ করতে পারে না। তখন তারা বিপদে পড়ে যান। কিছু সমস্যা সত্তে¡ও নারী উদ্যোক্তারা এগিয়ে যাচ্ছে। 

জাগরণ : নারী উদ্যোক্তাদের সাধারণ সমস্যা সম্পর্কে কিছু বলবেন কি? তারা পণ্য বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে কি কোনো সমস্যায় পতিত হচ্ছেন?

মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী : সাম্প্রতিক একটি সরকারি আদেশের ফলে রাজধানীর মহিলা উদ্যোক্তারা কিছুটা হলেও বিপাকে পড়েছে। গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ইত্যাদি এলাকায় মেইন রোডের ওপর থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তুলে দেয়া হয়েছে। এ কারণে অনেক নারী উদ্যোক্তাকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এতে মহিলা উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের ট্রেড লাইসেন্স পর্যন্ত নবায়ন করা হচ্ছে না। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। 

জাগরণ : ঋণদানকারী সংস্থা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নারী উদ্যোক্তারা যেভাবে সহায়তা পাওয়ার কথা তা কি পাচ্ছে?

মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী : নারী উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা পাচ্ছে, কিন্তু সব ক্ষেত্রে তারা কাক্সিক্ষত সহায়তা পাচ্ছে না। আমি প্রাইম ব্যাংকের সঙ্গে নাসিবের সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তারা দুই বছরের অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনো মহিলা উদ্যোক্তাকে ঋণ প্রদানে রাজি নয়। এ ছাড়া ব্যাংকিং সেক্টরে অনেক আইন-কানুন আছে, যার কারণে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়। ব্যাংকিং আইন-কানুন আরও সহজ করা গেলে নারী উদ্যোক্তারা এগিয়ে যেতে পারত। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কীভাবে আবেদন করতে হবে, সে বিষয়ে নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। 

জাগরণ : নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য দুই বছর ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতার যে শর্তারোপ করছে ব্যাংকগুলো, এটা কি নতুন উদ্যোক্তা উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা নয়?

মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী : নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য দ্ইু বছরের যে অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়, তা অবশ্যই উদ্যোক্তা উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা। কারণ ঋণ তো প্রথমেই প্রয়োজন হয়। একজন উদ্যোক্তা দুই বছর ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে পারলে তার হয়তো ঋণের প্রয়োজনই হবে না। এ শর্ত শিথিল করে উদ্যোক্তার সম্ভাবনার দিকটি বিবেচনা করে ঋণ দেয়া যেতে পারে। 

জাগরণ : বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক পরিবেশ নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে কতটা সহায়ক বলে মনে করেন? 

মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী : দেশে বর্তমানে যে সামাজিক পরিবেশ বিরাজ করছে, বিশেষ করে জঙ্গি তৎপরতার যে খবর মাঝে মাঝে পাওয়া যাচ্ছে তা নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। জঙ্গি হামলা প্রতিরোধের নামে শহরের বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। একটি মেয়ে হয়তো বিউটি পার্লার চালাচ্ছে। এ বিউটি পার্লারের সঙ্গে জঙ্গি তৎপরতার কি সম্পর্ক থাকতে পারে? কোনো অজুহাতেই মহিলা উদ্যোক্তাদের বিরক্ত করা উচিত হবে না। এতে মহিলা উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হতে পারে। 

জাগরণ : আগে মনে করা হতো, মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকরাই জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত থাকে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বিত্তবান পরিবারের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকরাও এ তৎপরতার জড়িত রয়েছে। এর কারণ কি বলে মনে করেন?

মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী : এটা একটি অদ্ভুত ব্যাপার, যেটা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম গুলশান ও শোলাকিয়া জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রে যেÑ সেখানে বিত্তবান পরিবারের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেরা জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত রয়েছে। এমনকি সেখানে একটি রাজনৈতিক দলের একজন প্রভাবশালী নেতার ছেলেও জড়িত রয়েছে। আমার মনে হয়, এখানে জঙ্গি হওয়ার একটি বড় কারণ হতে পারে ছেলেটি ভীষণভাবে হতাশাগ্রস্ত। হয়তো বাবা-মা তাকে সময় দিচ্ছে না। ছেলের কি ভালো লাগে কি ভালো লাগে নাÑ এসব ব্যাপারে তারা খেয়াল করছেন না। আজকাল ছেলেমেয়েরা টিভি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ফেইস বুক-ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আগেকার দিনে এটা ছিল না। আগেকার দিনে বাবা-মা সন্তানকে নিয়ে পড়তে বসাত। তাদের সময় দিত। ছেলেমেয়েদের ভালো-মন্দ খোঁজ রাখত। ফলে তারা কখনই একাকিত্ব বোধ করত না। আমি যখন মাস্টার্সে পড়ছি, তখনো আমার বাবা-মা আমার পড়াশোনার খোঁজ রাখতেন। তারা নোট করে দিতেন। আমি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছি সেই ’৬০-এর দশকে। আমার বাবা ছিলেন চট্টগ্রামের বিখ্যাত ব্যবসায়ী। সেই ’৬০-এর দশকেই আমি দুটো ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করতাম। কিন্তু বাড়িতে আমাকে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলতে হতো। আমাকে নিজস্ব কালচার মেনে চলতে হতো। সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলতে হতো। আজ-কাল বাবা-মায়েরা নিজেদের নিয়ে খুবই ব্যস্ত। তারা ছেলেমেয়েদের খোঁজ রাখার সময় পান না। ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের সমস্যা শেয়ার করতে পারছে না। আগে একান্নবর্তী পরিবার ছিল। সেখানে কেউ না কেউ তাদের সমস্যা সম্পর্কে খোঁজ রাখত। কিন্তু এখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যুগে কেউ কারো খবর রাখার সময় এবং সুযোগ পান না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। আমার মনে হয়েছে, যারা জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তারা কোনো না কোনোভাবে মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত ছিল। এ ছাড়া তারা ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জনের সুযোগ পাচ্ছে না। ইসলাম কখনোই মানুষ হত্যা করতে বলে না। তা হলে এরা ইসলামের নামে মানুষ হত্যা করবে কেন?

জাগরণ : ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন?

মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী : ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্রিটেনের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। কিন্তু ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেলে তারা একা হয়ে পড়বে। তাদের চাহিদা আর আগের মতো থাকবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আমরা পণ্য রপ্তানি থেকে শুরু করে অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে যে অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পেতাম, ব্রিটেনের নিকট থেকে তা পেতে হলে নতুন করে চুক্তি করতে হবে। সেই চুক্তি সম্পাদন করাটা খুব একটা সহজ হবে বলে মনে হয় না। ব্রিটেনে বাংলাদেশের প্রচুর জনশক্তি কাজ করছে। এটাও বিঘিœত হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি মহিলাদের বিদেশে প্রেরণ করা হচ্ছে কর্মসংস্থান করার জন্য। কিন্তু তারা সেখানে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যায় পড়ছে। তাদের বিদেশে প্রেরণের আগে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। আমি ইউএন উইমেনের একটি কাজ করেছিলাম। যেসব মহিলা বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে তাদের ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। তারা আমাকে বলেছিলেন, বিদেশে গিয়ে আমরা যখন বিপদে পড়ি তখন আমাদের কোথায় যেতে হবে তা আমরা জানি না। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসকে মহিলাদের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা নাসিব থেকে খুব শীঘ্রই মহিলা উদ্যোক্তাদের নিয়ে কনভেনশন করব। সরকারের শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গকে আমরা এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাব। বিদেশ থেকেও মহিলা উদ্যোক্তারা এতে অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। স্থানীয় নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন দেশের নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে। 
 

জাগরণ : পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সৃষ্ট সাম্প্রতিক যুদ্ধাবস্থার কারণে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। এতে সার্ক নামক সংস্থার ভবিষ্যৎ কি বিপন্ন হতে পারে?

মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী : এখনই অনুধাবন করা যাচ্ছে না যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট সামরিক উত্তেজনা কত দূর গড়াবে। তবে আমার মনে হয়, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে তা খুব সহসাই থেমে যাবে। কারণ যুদ্ধ কোনো সমাধান আনতে পারে না। বরং শুধু ধ্বংসই ডেকে আনে। কিন্তু দেশ দুটির মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা যদি আগামীতে আরও বেড়ে যায়, তা হলে পুরো উপমহাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর তা বিরূপ প্রভাব ফেলতে বাধ্য। 

জাগরণ : গত বছর দেশে ২৫০ কোটি মার্কিন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। জঙ্গি তৎপরতার কারণে আগামীতে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে কি?

মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী : আমার তা মনে হয় না। কারণ সরকার জঙ্গিদের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে এবং সে কারণে ইতোমধ্যে জঙ্গি তৎপরতা অনেকটাই কমে গেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের এ তৎপরতা প্রশংসিত হচ্ছে। আগামীতে দেশে জঙ্গিদের অস্তিত্ব থাকবে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশ জঙ্গিবাদী দেশ নয়। তারা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিচ্ছে। কাজেই আগামীতে জঙ্গিবাদ ইস্যুতে বাংলাদেশকে কোনো সমস্যায় পড়তে হবে বলে মনে হয় না। বিশ্বব্যাপী বাংলদেশের পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এ অবস্থাকে কাজে লাগনোর জন্য স্থানীয়ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। 

জাগরণ : আমরা জানতে পেরেছি আপনি সম্প্রতি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সামিটে আপনাকে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়েছে। এ পুরস্কারপ্রাপ্তির প্রেক্ষাপট জানতে চাই।

মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী : এটা আমার জন্য সত্যি এক বিরল অর্জন। গত জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ এশীয় ৯টি দেশ রাজধানী ঢাকায় এসএমই সামিট করেছিল। সেই সামিটেই আমাকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তার সৃষ্টি ও উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখার জন্যই আমাকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। আমি এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করেছি। ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ তারই স্বীকৃতি।