• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০, ০৩:১৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০, ০৩:৪১ পিএম

কিটো ডায়েট যখন সর্ব রোগের ওঝা

কিটো ডায়েট যখন সর্ব রোগের ওঝা

‘কিটো ডায়েট’ সহজ কথায় বলতে গেলে ফ্যাট দিয়ে ফ্যাট পোড়ানো। অনেক আগে কেবল বিশেষ কিছু স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে কিটো ডায়েট ব্যবহার করা হত। তবে, বর্তমানে অনেক ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির তোয়াক্কা না করেই ওজন কমানোর অস্ত্র হিসাবে ‘কিটো ডায়েট’ ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেকে বলছেন, বাইরের দেশ গুলোতেও কিটো ডায়েট ব্যবহার করে মানুষ ফিট থাকছেন। শুধু তাই নয় ডায়াবেটিস রোগীদেরকেও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে কিটো ডায়েট নেয়ার।

সেক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হল- বাইরের দেশ এমনকী ভারতে একজন ক্লায়েন্টের উপর কিটো ডায়েট আপ্লাই করার জন্য যেসব প্যারামিটার বা রেগুলেশন মেইন্টেন করা হয় সেসব আমাদের দেশে সম্ভব কি না? বা যারা কিটো ডায়েট নিয়ে কাজ করছেন তারা এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কাজ করছেন কি না?

যার ওজন বেশি তাকে ‘কিটো ডায়েটের’ সুবিধা-অসুবিধা বা ক্ষতিকর দিকের ব্যাপারগুলো না বুঝিয়েই পরামর্শ দেয়া হচ্ছে কিটো ডায়েট নেয়ার জন্য। একজন ব্যক্তি কিটো ডায়েটের জন্য শারীরিকভাবে প্রস্তুত কি না, সে বিষয়টা কতটুকু প্রাধান্য দেয়া হয়- আমার জানা নেই। 

কিটো ডায়েট ফলো করে ওজন কমানোর পর ঐ ব্যক্তি ভবিষ্যতে কী ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন সে বিষয়ে তাকে পর্যাপ্ত কোনো ধারণা দেয়া হয় কি না সে বিষয়ে আমি পরিষ্কার নই।

আমি জানি, কিটো ডায়েট প্রেস্ক্রাইবার এবং ফলোয়ার দুজনেরই মুখ্য উদ্দেশ্য কেবল ওজন কমানো। সেক্ষেত্রে, একজন ব্যক্তি পরবর্তীতে কী ধরনের শারীরিক জটিলতা বা সমস্যায় পড়তে পারেন- সে বিষয়ে উভয় পক্ষই হয়ত উদাসীন।
  
আমরাও গন্তব্য না জেনেই হ্যামিলিওনের বাঁশিওয়ালার পিছু নিচ্ছি নির্দ্বিধায়। ভবিষ্যতে কী হয় তা ভবিষ্যতেই দেখা যাবে আমরাও ভাবছি এমন।

সে কারণেই হয়ত, ১ মাসেই ১৫ কেজি ওজন কমান এমন বিজ্ঞাপন আমাদের খুব সহজেই আকৃষ্ট করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আমাদের দেশের মানুষ অধিকাংশ মানুষই সব কিছুতেই শর্টকাট খুবই পছন্দ করেন। লাইনের শেষে দাঁড়িয়ে সুযোগ বুঝে প্রথমের দিকে চলে যাওয়া আমাদের পুরনো অভ্যাস।

সারা জীবন নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ওজনটাকে বাড়িয়ে ফেলেছেন, যখন দেখলেন আপনার ওজনই আপনার গলার কাটা হিসেবে দেখা দিয়েছে, অবশেষে হয়ত আপনি একজন পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হবেন।

‘পুষ্টিবিদ বা ডায়েটিশিয়ান’ আপনার পুরো ইতিহাস নেয়ার পর, যখন আপনাকে এক এক করে পরামর্শ দেবেন, আপনাকে আপনার লাইফস্টাইল ঠিক করতে হবে, নিয়ম করে আপনাকে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা ব্যায়াম করতে হবে, আপনার উচ্চতা, কাজের ধরন অনুযায়ী আপনাকে সঠিক পরিমাণে খাবার খেতে হবে, দিনে অন্তত ৪০০ গ্রাম ফল এবং সবজি গ্রহণ করতে হবে, সেই সঙ্গে ফ্যাট জাতীয় খাবারে লাগাম দিতে হবে। তাহলে মাস শেষে আপনার স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ২-৩ কেজি ওজন কমবে। আপনার হতাশা ওজনের থেকে বেশি বেড়ে যাবে।

কারণ আপনার এত সময় নেই, সুযোগও নেই। আপনি চাইছেন মাসে অন্তত ১৫-২০ কেজি ওজন কমাতে। এমন কোনো মিরাকেল বা শর্টকাট রাস্তা একজন পুষ্টিবিদ আপনাকে কখনোই দেবেন না যদি না সঙ্গত কোনো কারণ না থাকে।

সেক্ষেত্রে, সময় নষ্ট না করে ১ মাসে ‘১৫-২০ কেজি ওজন’ কমান এমন বিজ্ঞাপন আপনার কাছে একেবারে লাইফ সেভারের মতো।

সম্প্রতি অন্তত তিনজন ইন্টারনেট এবং বিশেষ কিছু ব্যক্তির পরামর্শ সাপেক্ষে কিটো ডায়েট ফলো করার পর পূর্বের ওজনে ফিরে যাওয়া এবং তাদের বেশ কিছু শারীরিক জটিলতার ব্যাপারে জানতে পেরে আজকের পর্বে জানাতে চাই কিটো ডায়েট নিয়ে কিছু কথা।

কিটো ডায়েট কী
কিটো ডায়েট কী- এর আগে বলতে চাই আমাদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে। আমাদের দৈনিক ক্যালরি চাহিদার ৪৫-৬৫% আসে শর্করা জাতীয় খাবার থেকে, ২০-৩৫% আসে ফ্যাট থেকে এবং প্রোটিন থেকে আসে ১০-৩৫%। আমাদের দেহের প্রধান এনার্জি সোর্স হিসেবে কাজ করে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার। আমাদের দেহের প্রধান শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় শর্করা জাতীয় খাবার। অর্থাৎ, ভাত, রুটি, আলু, মুড়ি কিংবা চিড়া। যেখানে, কিটো ডায়েট একেবারে উল্টো নিয়মের।

‘কিটো ডায়েট’ বলতে সাধারণভাবে বোঝায় যে ডায়েটে ফ্যাটের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, এরপর প্রোটিন আর সবচেয়ে কম পরিমাণে থাকে শর্করা। কিটো ডায়েটে এমন একটি ডায়েট যেখানে ৮০% ফ্যাট ১৫% প্রোটিন এবং ৫% থাকে শর্করা থাকে। মূলত, শর্করা জাতীয় খাবারকে একেবারে কমিয়ে ফেলা এই ডায়েটের মুখ্য উদ্দেশ্য।

আমরা যখন দেহের প্রধান এনার্জি সোর্স কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার খাদ্য তালিকা থেকে কমিয়ে ফেলব বা নামে মাত্র গ্রহণ করব তখন আমাদের দেহ সঞ্চিত চর্বি খরচ করে শক্তি উৎপাদন করবে এবং ওজন কমা শুরু হবে।

আমাদের মস্তিস্কের প্রধান ফুয়েল হল গ্লুকোজ। বাইরে থেকে যখন কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণ করা বন্ধ করা হয় তখন আমাদের মস্তিষ্ক যকৃত এবং মাংসপেশীতে সঞ্চিত গ্লুকোজ ব্যবহার করে থাকে। ‘কিটো ডায়েট’ শুরু করার ২-৪ দিনের মধ্য এই সঞ্চিত গ্লুকোজ শেষ হয়ে যাবে এবং শরীরে যে মেটাবলিক স্টেট তৈরি হবে তাকে কিটোসিস বলে। এই পর্যায়ে আমাদের দেহ সঞ্চিত ফ্যাট ব্রেক ডাউন করবে এবং ‘কিটোন বডি’ তৈরি হবে। 

যেহেতু, মস্তিস্কের প্রধান ফুয়েল গ্লুকোজ তাই কিটো ডায়েট শুরু করার প্রথম দিকে মস্তিস্ক কিটোন বডিকে ব্যবহার করতে পারে না তবে বেশ কিছুদিন এই ডায়েট ফলো করার পর মস্তিষ্ক কিটোন ব্যবহার করার সক্ষমতা লাভ করে।
 
‘কিটো ডায়েট’ চলাকালীন সময়ে চর্বি ভেঙে সমস্ত রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এই চর্বি হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীতে জমে রক্ত প্রবাহ বন্ধ করে দিতে পারে, যার ফলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।  

মূলত কয়েক শতক আগে শরীরের এই মেটাবলিক স্টেট তৈরি করা হত এপিলিপ্সি রোগ সারাতে। কিন্তু বর্তমানে কিটো ডায়েটকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যে ওজন কমানোর একমাত্র পন্থা হল কিটো ডায়েট। এখানেই আমার যত আপত্তি। কিটো ডায়েট কেবল বিশেষ ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদের পরামর্শ সাপেক্ষে হতে পারে। সবার জন্য নয়। 

যেসব ক্ষেত্রে কিটো ডায়েট বিপজ্জনক  

• আমাদের সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫-৩৫ গ্রাম ফাইবার গ্রহণ করা উচিত। আমাদের দেহের চাহিদা অনুযায়ী ফাইবার গ্রহণের জন্য প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি এবং ফল গ্রহণ করা আবশ্যক। কিন্তু, কিটো ডায়েটে যেহেতু ৫% এর বেশি শর্করা গ্রহণ করা যায় না তাই প্রতিদিনের ফাইবারের চাহিদা পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

• শুধু যে ফাইবারের চাহিদা পূরণের জন্য শাকসবজি এবং ফলমূল খাওয়া জরুরি- তা নয় বরং আমাদের দেহের জন্য জরুরি খনিজ উপাদানের চাহিদা পূরণের জন্যও ফাইবার জাতীয় খাবার অত্যাবশ্যক। খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত ফাইবার না থাকার অর্থ হল প্রতিদিনের চাহিদা অনুযায়ী খনিজ উপাদানের চাহিদা পূরণ না হওয়া। 

• একজন ব্যক্তির যদি থাইরেড রোগ থাকে তবে তাকে কিটো ডায়েট দেয়া যাবে না। কারণ অতিরিক্ত ফ্যাট জাতীয় খাবার থাইরয়েড ফাংশনকে ঠিকভাবে কাজ করতে দেয় না।

• একজন মোটা মানুষ যার উচ্চ রক্তচাপ বা হার্টের রোগ রয়েছে কিটো ডায়েট তার জন্যও নয়।

• যে ব্যক্তির পেটের গণ্ডগোল বা হজমের সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এই ডায়েট কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেহেতু, পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাবে।

• যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের যেমন শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি তেমনি বেশি নিয়ন্ত্রণ করলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা, এমনকী ডায়াবেটিস রোগী ডায়াবেটিক কোমাতেও চলে যেতে পারেন। সুতরাং, একটু এদিক-সেদিক হলেই ডায়াবেটিস রোগীদের উপর কিটো ডায়েট বিরূপ প্রভাব ফেলার আশঙ্কা প্রবল।

• কিটো ডায়েট ফলো করার ফলে অন্ত্রের জটিলতা দেখা দেয়ার আশঙ্কা খুবই স্বাভাবিক। যারা কোনো কিছু চিন্তা-ভাবনা না করেই কিটো ডায়েট অনুসরণ করছেন তাদের মাঝে ডায়রিয়া, পেট ব্যথা বা বমি হতে পারে।

• কিটো ডায়েটের আরেকটি বিপদ হল এই ডায়েট করার ফলে আমাদের লিভার অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। কারণ ফ্যাট ও প্রোটিন ভেঙে গ্লুকোজ তৈরি করার ফলে লিভারে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। যার ফলে উচ্চ মাত্রার অ্যামোনিয়া তৈরি হয়।

• যেহেতু, কিটো ডায়েট করার ফলে অতিরিক্ত কিটোন বডি তৈরি হয় এবং তা কিডনির মাধ্যমে বের হয়ে যায়। অতিরিক্ত কিটোন কিডনির উপর চাপ ফেলে যার ফলে কিডনি অকার্যকরও হয়ে যেতে পারে।

• যেহেতু, শর্করা খুব কম পরিমাণে থাকে তাই ক্লান্তি, মাথা ব্যথা বা দুর্বল লাগে।

তাহলে আপনার কী করা উচিত :
যে ব্যক্তির বিগত ৫-৬ বছরে ২০-২৫ কেজি ওজন বেড়েছে তার জন্য ২০ দিনে ওজন কমানো যে মারাত্মক ভুল তাতে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। এই ওজন কমানোর জন্য তাকে অন্তত ১ বছর সময় ব্যয় করা উচিত। এর ফলে তার ওজন কমাটা স্থায়ী এবং তার স্বাস্থ্যের উপর এবং দেহের কোনো অর্গানের উপর কোনো চাপ বা স্থায়ী ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।   

যার ওজন বেশি তার ক্ষেত্রে এমনিতেই নানা রকম জটিলতা থাকা স্বাভাবিক। এমন অবস্থায় তার জন্য নতুন কোনো মেটাবলিক পন্থার চেয়ে জরুরি তার ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণগুলো খুঁজে বের করে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে প্রতি মাসে ২-৩ কেজি করে একটু সময় নিয়ে ওজন কমানো।

আর এরপরও যদি আপনি কিটো ডায়েট করতে চান সেটি একান্তই আপনার ইচ্ছা। সেক্ষেত্রে, একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ গ্রহণ করা আপনার জন্য বাঞ্ছনীয়। আপনার হিস্ট্রি ভালোভাবে জানার পর আপনি কিটো ডায়েট করার জন্য ফিট কি না সেই বিষয়ে তার মতামত নেয়া আবশ্যক। 

লেখক : পুষ্টিবিদ, বেক্সিমকো ফার্মা লিমিটেড।

এফসি