• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৩, ২০২০, ০৯:১৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১৪, ২০২০, ১০:৫৩ এএম

শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান

“আমার বাবা চেয়েছিলেন সমাজতন্ত্র”

“আমার বাবা চেয়েছিলেন সমাজতন্ত্র”

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, কথাসাহিত্যিক জহির রায়হান স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কলম ও চলচ্চিত্রকে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেই স্বাধীনতা উদযাপন করতে পারেননি তিনি। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির পর তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘকাল। ব্যক্তিগত জীবনে অভিনেত্রী সুমিতা দেবীর সঙ্গে প্রথম বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন জহির রায়হান। এ দম্পতির মেজো ছেলে অনল রায়হান। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে জাগরণের কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।


জাগরণ: আপনার বাবার স্বপ্ন ছিল, আপনার স্বপ্নভঙ্গের কোনো বিষয় আছে কি?

অনল রায়হান: মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সাত কোটি বাঙালির যে স্বপ্ন ছিল, সেটাই ছিল বাবার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন ছিল মুক্তির স্বপ্ন, সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন, অসাম্প্রদায়িক সমাজের স্বপ্ন। মানবতাবাদ যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় এমন একটি সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। এই একই স্বপ্ন জহির রায়হান একভাবে দেখেছেন, ভেবেছেন। মুনির চৌধুরী একভাবে দেখেছেন,তাজউদ্দীন আহমদ একভাবে দেখেছেন, বঙ্গবন্ধু একভাবে দেখেছেন। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি মানুষ, বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে একেবারে গেরিলাযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী থেকে নাম না-জানা কৃষক প্রত্যেকের স্বপ্ন ছিল একটাই— পাকিস্তানি শোষণ থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। শোষণের কারণ ছিল— পাকসেনাবাহিনী, ধর্মের নামে অত্যাচার, সাম্প্রদায়িকতা, ধনী এবং দরিদ্রের বিভেদ— এগুলো যাতে সব ঘুচে যায়। পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে এমন একটা সমাজের স্বপ্ন আমিও দেখি। কিন্তু সেই স্বপ্নটা আমাদের প্রজন্মে এসে আমার মতো অনেকেরই ভঙ্গ হয়েছে। কারণ আমরা বুঝতে পারছি যে, একাত্তরে ৩০ লক্ষ শহীদের যে স্বপ্ন ছিল, তার থেকে আমরা বহু যোজন দূরে চলে এসেছি। এতদূরে চলে এসেছি যে, ওই স্বপ্নকে আবার পুনঃস্থাপন করতে গেলে হয়তো আবারো একটি রক্তপাতের ব্যাপার ঘটবে। এটা শুধুই আইনিভাবে করা সম্ভব না।

জাগরণ: আপনার বাবার প্রাপ্তি, আপনার অপ্রাপ্তি নিয়ে কিছু বলুন।

অনল: পেশাগত জীবনে উনার প্রাপ্তি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। তিনি মাত্র ৩৭ বছর বেঁচেছিলেন। এই ৩৭ বছরে তিনি যে কর্মযজ্ঞ করে গেছেন, সাহিত্য-চলচ্চিত্র-সাংবাদিকতায়, এমনকি সাংগঠনিকতায়— সেটি একটি অসাধারণ কাজ। যার মাধ্যমে ৫০ বছর পরের প্রজন্মও ইতিহাসের গভীরতাগুলো খুঁজে পাবে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীনতার সূর্যটা নিজ চোখে দেখে যেতে পেরেছিলেন। সেই জায়গা থেকে উনার একটি প্রাপ্তি নিশ্চয় ছিল। তবে এর সঙ্গে তিনি শোকটাও দেখে গেছেন। যাদের সাথে এক টেবিলে বসে কাজ করেছিলেন, চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করেছিলেন— বিজয়ের পরে এসে দেখলেন কেউ নেই। সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। কারো কারো লাশও নেই। যেমন তাঁর বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার। প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে উনাকে বিশাল বেদনাটাকেও সহ্য করতে হয়েছে।
আমার প্রাপ্তি হচ্ছে, আমরা একটি ইতিহাস পেয়েছি। যে ইতিহাসটা এতটা জোড়ালো, এতটা শক্তিশালী যে পৃথিবীর খুব কম দেশের জাতির কাছ থেকে পরবর্তী প্রজন্ম পায়। আমার প্রাপ্তি ৫২'র ভাষা আন্দোলন, আমার প্রাপ্তি মুক্তিযুদ্ধ। আর অপ্রাপ্তিটা হচ্ছে, আমাদের বাবার স্বপ্নটা বাস্তবায়ন হলো না।

জাগরণ: আপনার বাবার স্বাধীনতা, আর আপনার পরাধীনতা নিয়ে যদি কিছু বলেন।

অনল: আমার বাবার স্বাধীনতাটা হচ্ছে, তিনি স্বাধীনভাবে লড়াইটা করতে পেরেছিলেন। ধর্ম হোক, শোষণ হোক বা পুঁজিবাদ হোক যেকোনো বিষয়ে তারা প্রতিবাদ করতে পারতেন, কথা বলতে পারতেন। সেই জায়গা থেকে তাদের হয়তো একটা স্বাধীনতা ছিল। তারা সাহস নিয়ে কাজ করতে পেরেছিলেন। আমার পরাধীনতার জায়গাটা হচ্ছে, আমার বাবারা যে কারণে শহীদ হলেন সেই চেতনা যদি বাস্তবায়ন হতো, তাহলে এখন আমি অনেক স্বাধীন একটি মানুষ থাকতে পারতাম। চাকরি-ব্যবসা না করে দুই লাইন লিখতে পারতাম। সেই লেখার টাকা দিয়ে চলতে পারতাম। কাউকে মুখ দিয়ে 'শয়তান' বললে পরশুদিন কোনো দলের লোক এসে আমার রগ কেটে দিবে না। বা আমাকে পুলিশ এরেস্ট করবে না। এই যে স্বাধীনতার জায়গা, তা একেবারেই নাই। আর এর মূল কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন না হওয়া।

জাগরণ: আপনার বাবার দাবি, আর এখন আপনার দাবির ভেতর কি কোনো মিল আছে?

অনল: আমার বাবা চেয়েছিলেন সমাজতন্ত্র। তিনি সাধারণ একটা সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বপ্ন কখনোই দেখতেন না। তিনি মার্কসবাদে বিশ্বাস করতেন। মানবতাকে যদি এগুতে হয়, তাহলে ধনী-গরীবের বিভেদ শেষ করতে হবে। মার্কসের যে অর্থনীতি সেটার সঙ্গেই সমাজব্যবস্থা চলা উচিত। এছাড়া কোনো সমাধান আমি অন্তত দেখছি না, জহির রায়হানও ১৯৭১ সালে দেখেননি। উনিও মনে করতেন এটাই সমাধান।