• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০২০, ০৫:৩১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ১৫, ২০২০, ০৬:২৪ পিএম

মৌলবাদীরা দেশে গৃহযুদ্ধ চায় : যতীন সরকার

মৌলবাদীরা দেশে গৃহযুদ্ধ চায় : যতীন সরকার

যতীন সরকার বাংলাদেশের প্রগতিবাদী লেখক, চিন্তাবিদ ও শিক্ষক হিসেবে প্রখ্যাত। ষাটের দশক থেকে আজ অবধি দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত আছেন তিনি। মননশীল ও মুক্তচিন্তার স্বাক্ষর বহনকারী এ জ্ঞানসাধক অপশক্তির বিরুদ্ধে এখনো লড়ে যাচ্ছেন তাঁর বলিষ্ঠ কলম ও কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ‘দৈনিক জাগরণ’-এর সঙ্গে কথা বলেন।


জাগরণ : আপনি মার্কসবাদে বিশ্বাসী। বাংলাদেশে এই মতাদর্শ কতখানি এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

যতীন সরকার :
বাংলাদেশে মার্কসবাদ এগিয়েছে কি এগোয়নি, আগাবে কি আগাবে না, প্রশ্নটি ঠিক এভাবে বিচার করা সঠিক নয়। কারণ, মার্কসবাদ হচ্ছে একটি বিজ্ঞান। এর মূলটা হলো ডায়ালেক্টিক্যাল মেটারিয়ালিজম তথা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। এর ভিত্তিতে মূল বিষয়গুলোকে সব সময় সঠিকভাবে ধরা যায়। তাই বাংলাদেশে মার্কসবাদ আগাবে কি আগাবে না, এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে, ডায়ালেক্টিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজমকে ভিত্তি করে এখনো অনেকের চিন্তাচেতনা কাজ করে। কাজেই সে চিন্তার মধ্য দিয়ে মার্কসবাদ মিথ্যা তো প্রমাণিত হবে না। মার্কসবাদের ভবিষ্যৎ নেই বা অতীত ছিল না, এটা কিছুই বলা যাবে না। কাজেই মার্কসবাদের ভবিষ্যৎ অবশ্যই আছে। কারণ, বিজ্ঞান তো বিজ্ঞানই। বিজ্ঞান কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না। কাজেই যারা বোঝে তাদের কাছে এটার দাম আছে। যারা বোঝে না তারা সত্যিকার অর্থে কোনো বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। বাংলাদেশে ডায়ালেক্টিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজম কতটুকু? এ ডায়ালেক্টিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজমটাই অনেকে বোঝে না। যারা বোঝে তারা সে বিষয় নিয়ে সেভাবেই চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণ করে। যদিও তাদের সংখ্যা খুব কম। ফলে বাংলাদেশে মার্কসবাদ যে খুব বেশি এগিয়েছে, এমন বলতে না পারলেও এটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশে মার্কসবাদ স্তব্ধ হয়ে যায়নি। 

জাগরণ: সাম্প্রতিককালে ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে দেশে একটি অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে, এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

যতীন সরকার :
ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে যা হচ্ছে, সেটার প্রকৃত প্রস্তাবে আমার একটি বই আছে— ‘পাকিস্তানের ভূত দর্শন’। পাকিস্তানকে আমরা নিহত করেছিলাম আমাদের এ অঞ্চলে। সে নিহত পাকিস্তান ভূত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে আমাদের মাথায় চেপে বসে। চেপে বসার ফলেই আমাদের সমস্ত মূলনীতি বিসর্জিত হয়ে যায়। মূলনীতি যেখানে বিসর্জিত হয়েছে, সেখানে এ ধরনের লোকেরা তাদের সুযোগ গ্রহণ করার চেষ্টা করবে এবং এভাবেই তারা ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে লেগে গেছে। কিন্তু আমি মনে করি, ভাস্কর্য আমাদের ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে। নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য কি ফেলে দিতে পারবে? ঐতিহ্যকে রক্ষার জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে এবং সে চেষ্টায় আমরা সফল হবই। সফল হওয়ার জন্য যে কাজটি করতে হবে—ধর্মান্ধতা এবং ধর্মীয় মৌলবাদ যেটা চলছে, তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কখনো গতিবেগ পায় দেখি, কখনো কম। কিন্তু এটা হবেই। কিন্তু ভাস্কর্য-মূর্তিকে এক করে দেখানো—এ সমস্ত কথা মানুষে মানবে না। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে যা শুরু হয়েছে, এটার বিস্তৃতি অনেক দূর। 

জাগরণ : এ নিয়ে তো তারা ধর্মকে সামনে নিয়ে আনছেন?

যতীন সরকার :
ধর্ম সম্পর্কে আমার কথা বলার অধিকার নেই। তবে এইটুকু বুঝি, ধর্ম যার যার থাকবে। কিন্তু ধর্মতান্ত্রিক মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। কাজেই ভাস্কর্য ধর্মের ব্যাপার নয়; একটা ধর্মতান্ত্রিক মৌলবাদের উত্থানের ব্যাপার। মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম চলছে, চলবেই। কাজেই ভাস্কর্যের বিষয়টা এভাবে নিষ্পত্তি হবে বলে মনে করি।

জাগরণ : সম্প্রতি হেফাজতের একজন নেতা বলেছেন, অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা এটা একাত্তরে ছিল না, পরে এটা সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

যতীন সরকার :
তাদের এ কথায় আমি খুব আতঙ্কিত। সোজাসুজি ও পরিষ্কারভাবে এরা রাষ্ট্রবিরোধী—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তারা ইচ্ছে করেই এ কথা বলেছে। তারা এমন একটা কিছু করতে চায়, যেন তাদের গ্রেপ্তার করার দাবি ওঠে, গ্রেপ্তার হবে। গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েই তারা রাষ্ট্রবিরোধী এসব কাজ করে যাচ্ছে। অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সেক্যুলারিজম নিয়েই আমাদের বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কাজেই যখন বলা হয় বাংলাদেশে স্বাধীনতার মধ্যে এটা ছিল না, তখন তারা কী বলে? তারা ইচ্ছে করেই এ কথা বলে এবং ইচ্ছে করেই তারা একটি গৃহযুদ্ধ লাগাতে চায়। এ রাষ্ট্রবিরোধী কথাগুলোর মধ্য দিয়ে গৃহযুদ্ধের সূচনা হতে পারে বলে আমি মনে করি। কিন্তু এ গৃহযুদ্ধে তারা জয়ী হতে পারবে না। দেশের মানুষ, বর্তমান প্রজন্ম বেরিয়ে আসবে। এটার জন্য যদি গৃহযুদ্ধ হয়ও, মারাত্মক আকার ধারণ করলেও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনাই জয়ী হবে। মৌলবাদীরা জয়ী হবে না। অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এটা একাত্তরে ছিল, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো কারণই নেই।

জাগরণ : ৭২-এর সংবিধান নিয়ে মৌলবাদীরা অনেক কথা তুলছে, তারা খেলাফত চায়, বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

যতীন সরকার :
আসলে কথা হচ্ছে ‘পাকিস্তানের ভূত’ আমাদের ঘাড়ে এভাবে চেপে বসেছে, এটা নিয়ে তারা খেলা করতে পারে। এ কারণেই আমাদের সংবিধানটাকে কেটেকুটে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এখন সংবিধানের মূল কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন যদিও চার মূলনীতির কথা আছে, একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হচ্ছে, আবার রাষ্ট্রধর্মও আছে। কাজেই এই যে গোঁজামিল, এর অবসান করার দায়িত্ব কিন্তু কর্তৃত্বশীল-ক্ষমতাসীন যারা আছেন, তাদের ওপরই বর্তায়। তারা যদি এটার সমাধান না করেন সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা আরো সুযোগ পাবে বলে আমি মনে করি। আর খেলাফতের কথা বলছেন? বাংলাদেশে খেলাফত একেবারেই অসম্ভব। এরা যত চেষ্টাই করুক পারবে না, পারবে না, পারবে না। এবং এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হবেই। পারবে না এ কারণে, এ দেশটা যে স্বাধীন হয়েছে, সে স্বাধীনতার ঐতিহ্য যারা গ্রহণ করে, তারা সংখ্যায় অনেক বেশি। এখন ওরা যেভাবে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে, তারা বুঝতে চাইছে না মানুষ ধার্মিক কিন্তু ধর্মতান্ত্রিক মৌলবাদী নয়। কাজেই মৌলবাদীরা এখানে পরাস্ত হবেই। ধর্মতন্ত্র মৌলবাদ আর ধর্মবিশ্বাস এক জিনিস নয়। এই জিনিসটা আমাদের তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে বোঝে। তরুণ প্রজন্ম কি খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য ভাস্কর্য থেকে শুরু করে গানবাজনা, নাটক, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা বাদ দেবে? এটা অসম্ভব। কাজেই কোনোমতেই ইচ্ছে করলেই খেলাফত প্রতিষ্ঠা এ দেশে হতে পারবে না।

জাগরণ : স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সম্পর্কে জানতে চাই।

যতীন সরকার :
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমাদের চৈতন্যে যে বোধটা আছে, সেখানেই আমরা একটি ইতিবাচক ব্যাপার পেয়েছি। এই ইতিবাচকতাকে আমরা গ্রহণ করেছি। সে যে প্রাপ্তি অর্থাৎ আমরা স্বাধীনতার পরে যে চার মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে সংবিধান রচনা করেছিলাম, সে সংবিধানটা আমাদের বড় প্রাপ্তি। এটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যথার্থ একটা পদক্ষেপ। কারণ, পাকিস্তান মরে গিয়ে আবার এখানে ভূত হয়ে আসবে, সেটা সেদিন আমরা ধারণা করতে পারিনি। তার চাইতে বড় কথা হচ্ছে, আমরা সেদিন ভুল করেছিলাম—আমরা মনে করেছিলাম যে সব ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের বিরোধী শক্তি যারা, তারা কিন্তু সে সময়ে বসে থাকেনি। তারা নানাভাবে চেষ্টা করছে। আমি ময়মনসিংহ শহরে দেখেছি, এখানে ‘মুসলিম বাংলা জিন্দাবাদ’ এ রকম করে দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয়েছে। এই ‘মুসলিম বাংলা জিন্দাবাদ’ যারা বলেছে, তারা কী হিসেবে বলছে? তারা এখানে পাকিস্তানকে নতুন করে ফিরিয়ে আনতে চায়? এ ব্যবস্থাটাই তারা করতে চাইছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সে সুযোগটা পেয়ে গিয়েছে। ৭২-এর সংবিধানকে কাটাকুটি করে সে অবস্থানে নেওয়া হয়েছে সেভাবেই তাদের সুযোগটা এনে দিয়েছে বলে আমি মনে করি।
আর প্রাপ্তি? সে তো অনেক হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থাকাকালে আমাদের এখানে যে বৈষম্য ছিল, সেটা অনেক কমেছে। বাংলাদেশে কোনো লোক পাকিস্তান আমলে একটা চাকরি পর্যন্ত পেত না, বাংলাদেশ আমলে দেখা গিয়েছে বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্র থেকে শুরু করে সবকিছু যে মানুষ পেয়ে গেছে, এটা তো কম কথা না। আর কলকারখানা ইত্যাদি যে পরিমাণে হওয়ার কথা ছিল, সে পরিমাণে না হতে পারে। কিন্তু আগে যা ছিল না, তার চাইতে বেশি তো হয়েছে।
অপ্রাপ্তি হলো—আমরা যেটুকু চেয়েছিলাম, সেটুকু পাইনি। এই না পাওয়ার সুযোগটা গ্রহণ করেছে স্বাধীনতাবিরোধীরা। কাজেই আমরা সেখানে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার উপকূলে পৌঁছেছিলাম। এখন সে সাংস্কৃতিক আন্দোলনটা শেষ হয়ে গেছে। এখন নতুনভাবে প্রাপ্তিগুলোকে ফিরিয়ে আনতে নতুন প্রাপ্তিকে গ্রহণ করতে এই ৫০ বছরে বঙ্গবন্ধুর নাম বলাই যথেষ্ট নয়, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহ্যকে গ্রহণ করে, বঙ্গবন্ধু যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখান থেকে যে আমাদের শুরু করতে হবে—এ বিষয়ে বোধটা আমাদের আসতে হবে। নতুন করে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করতে হবে, যে আন্দোলন পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি বড় হয়ে দেখা দেবে। তাহলেই আমাদের অপ্রাপ্তিগুলো দূর হয়ে যথার্থ প্রাপ্তি পাব।

জাগরণ : বাংলাদেশের প্রবন্ধের ইতিহাসে ষাট-সত্তরের দশকে প্রবন্ধের যে চর্চা ছিল, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম কবিতা, গল্প-উপন্যাসের প্রতি আগ্রহ। এখন কেন প্রবন্ধের চর্চা হচ্ছে না?

যতীন সরকার :
প্রকৃষ্টরূপে বন্ধন সমন্বিত রচনাই প্রবন্ধ। তো, যারা এভাবে প্রবন্ধ রচনা করেন, তাদের মধ্যে অনেক ব্যাপার আছে। যখন দেশের মধ্যে একটা আন্দোলন থাকে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলে, তখন প্রাবন্ধিকরা সাহসী হন। সেটা লিখতে পারেন তারা। ষাটের দশকে বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন এমনভাবে অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। কাজেই এর মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা থেকে বদরুদ্দীন উমরের মতো প্রাবন্ধিকরা সে সময় বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এর পরবর্তীকালে সেই অবস্থাটা তৈরি হয়নি বলে আমাদের প্রবন্ধ সাহিত্য অনেকটা বিলীন হয়ে গেছে। আর প্রাবন্ধিকরা সত্যিকারার্থে নানাভাবে নিজেদের গোপন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কবিতা-গল্প ইত্যাদির মধ্যে সত্যিকার অর্থে যেভাবে সৃজনশীলতা প্রকাশিত হতে পারে, প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে সেটা প্রকাশ হতে পারে না। সে কারণে প্রবন্ধ অনেক বেশি পিছিয়ে পড়েছে।