• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৭, ২০২১, ০১:১১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৭, ২০২১, ০১:৩১ পিএম

সাক্ষাৎকার

নতুনদের বলব এত ভাবনার কিছু নেই: সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী

নতুনদের বলব এত ভাবনার কিছু নেই: সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী

সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, প্রশিক্ষক ও লেখক। প্রথম সিনেমা ‘ঘুড্ডি’ (১৯৮০) দিয়েই দর্শকের মন জয় করে নেন তিনি। এই সিনেমার মধ্য দিয়ে সুবর্ণা মোস্তফার বড় পর্দায় অভিষেক ঘটে। ‘ঘুড্ডি’ ছাড়াও  আলমগীর ও রোজিনাকে নিয়ে ‘লাল বেনারসী’ এবং ইলিয়াস কাঞ্চন এবং অঞ্জু ঘোষকে নিয়ে ‘আয়না বিবির পালা’ নির্মাণ করেন। ১৯৮১ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী এফডিসিতে অপারেটিভ ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন, পরে ১৯৯৬ সাল থেকে ৫ বছরের জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন, ছিলেন এসএটিভির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও)। এখন লেখালেখি ও চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে সময় কাটছে তাঁর। সম্প্রতি বিধান রিবেরুকে দেয়া সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ এখানে প্রকাশ করা হলো।

 

বিধান রিবেরু: সত্যজিৎ রায় বলেছেন চলচ্চিত্রের ভাষা সংগীতের মতো। সংগীতে যেমন কাউন্টার এনকাউন্টার নিয়ে ছন্দ তৈরি করা হয়, চলচ্চিত্রের ভাষাতেও তেমনি একটি ছন্দ তৈরি করতে হয়। না হলে মানুষের কাছাকাছি পৌঁছানো যায় না। একজন বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আপনার কাছে চলচ্চিত্রের ভাষাটা কেমন?

সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী: সত্যজিতের কথাটা আমার ভালো লেগেছে এজন্য যে উনি একটু কাব্য করে বলেছেন। কিন্তু এই কাব্যের পেছেনে ইমেজ মেকিংয়ের সত্য রয়েছে। আসলে তত্ত্ব দিয়ে ভাষার রূপটা তৈরি করা সম্ভব নয়। তবে একটি গাইড লাইন থাকে। আসলে মানুষই একমাত্র পারে যে তার ভেতরে যে ইমেজগুলো আছে, সেটাকে কলমের মাধ্যমে মুক্ত করতে। চলচ্চিত্র ভাষা নির্মাণে আমি কী চয়ন করছি, কী গ্রন্থনা করছি, কী উপস্থাপনা করছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি তোমাকে ভালোবাসি—এ কথাটি যখন আমি চলচ্চিত্রে বলব, তখন ‘আমি’ ট্রান্সফরমেশন হবে, ‘তুমি’ ট্রান্সফরমেশন হবে, ‘ভালবাসি’র ট্রান্সফরমেশন হবে। কিসে হবে? আমার ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজে হবে। প্রযুক্তি আমার হাতে আছে, ক্যামেরা আমার হাতে আছে, শব্দ আমার হাতে আছে, আমার সামনে শিল্পী আছে, আমি ক্যামেরার পেছনে আছি, এটা একটা টিমওয়ার্ক। পরিচালক একজন ছাতার মতো।  যার ছত্রছায়ায় এই জিনিসগুলো গড়ে ওঠে।

 

রিবেরু: নিজের মনের যে ভাব, ভাষায় পরিণত করছি অন্যদের মধ্য দিয়ে…

জাকী:  ছাতার কাজটি এখানেই। ছাতা কিন্তু এগুলোকে কো অর্ডিনেট করবে। যিনি ক্যামেরা পার্সন আছেন আমার সঙ্গে, তিনি আমার একটা হাত বা আমার একটি এক্সটেনশন। আমি বলছি যে এখানে এই শটটি আউট অব ফোকাস চাই। এখন আউট অব ফোকাস শব্দটি ক্যামেরা পার্সন জানেন, উনি সেটা করে দিলেন। এই যে একটা আইডিয়া এক্সচেঞ্জ হলো, এটা দিয়েই কিন্তু আমি প্রক্ষেপণ করেছি। সেটা সিনেমার পর্দায় করি, আর টেলিভিশনের পর্দাতেই করি, ভবিষ্যতে আরও যা আসছে, তার ভেতরে প্রক্ষেপণ হচ্ছে। আমি নতুনদের বলব যে এত ভাবনার কিছু নেই। আমার মনে আছে আজ থেকে প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমি টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠান করতে গিয়েছি, আউটডোরে, একজন বিখ্যাত ব্যক্তির ইন্টারভিউ নিয়েছি। তো আমাকে হঠাৎ প্রশ্ন করা হলো—লো অ্যাঙ্গেল শটের মাজেজাটা কী? আমি থমকে গেলাম। আমি বললাম, এখন এই প্রশ্নটি করো না। তোমার যদি মনে হয় এখন এখান থেকে এই শট ভালো লাগবে নিয়ে ফেলো। যেটা কাজ করছে, সেটাই ঠিক। আরেকটা কথা বলি, আজকে একজনের নাম মনে পড়ল, হুমায়ূন আহমেদের কথা বলি, আমার রুমের মাঝখানে একটা সোফা ছিল। সেখানে এসে চা খেত, শুয়ে থাকত, শুয়ে চিন্তা করত। আমার সঙ্গে যে খুব একটা কথা বলত তা নয়। মাঝে মধ্যে হুটহাট করে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে মারত। হঠাৎ করে সে বলল—একটা কথা জিজ্ঞাসা করি? আমি বললাম—বলো। টপ অ্যাঙ্গেলের হিসাবটা কী? আমি বললাম, শোনো, তুমি তো সায়েন্সের ছাত্র ছিলে, আসো আমার সামনে আসো। আমি বললাম, আমি তোমাকে ভেতরটা বলতে পারব না, ভেতরটা তোমার দায়িত্ব। আমি এটার ফিজিক্সটা বলতে পারব। তো ছবি এঁকে আমি গ্রাফিক্যালি মোটামুটি বুঝিয়ে দিলাম। বললাম, এবার তোমার দায়িত্ব এটাকে তুমি কীভাবে ব্যবহার করবে। চলচ্চিত্রের ভাষা নিয়ে খেলার, এই যন্ত্রনির্ভর ভাষাকে নিয়ে খেলার যথেষ্ট জায়গা আছে।  আমার ভেতরে কী উৎপাদন করছি দ্যাট ইস ইম্পরট্যান্ট। তাই নতুনদের আমি বলব ভেতরে উৎপাদন করো।

 

রিবেরু: চলচ্চিত্রে তো আগে থেকে ঠিক করা নন্দনতত্ত্ব তৈরি হয়েই আছে। যেমন টপ শট বলতে বোঝাচ্ছে কোনো মানুষ কোনো কিছুর অধীন। লো অ্যাঙ্গেল শট মানে কোনো একজন মানুষকে আমি অনেক বেশি মহীয়ান করছি। কিন্তু এগুলো এখন পরিবর্তন হচ্ছে...

জাকী:  এটার প্রয়োজন ছিল। পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। আমাদের প্রস্তুতির একটা ব্যাপার রয়েছে। যা হোক, যে কোনো প্রযুক্তির সঙ্গেই তো একটা ম্যাজিক জড়িত থাকে। সোভিয়েতের সময়ে এটাকে একটা ডিসিপ্লিনে ফেলার চেষ্টা হয়েছে।

 

রিবেরু: চলচ্চিত্রের ভাষার কথা যদি বলি, যেমন, জঁ রেনোয়ার ‘রুলস অব দ্য গেম’, সেটায় ডিপ ফোকাসের ব্যবহার তিনি করলেন, যখন এলিট ক্লাসকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, তার তিন বছর পর ‘সিটিজেন কেইন’ হলো, সেখানেও ডিপ ফোকাসের ব্যবহার হলো। চলচ্চিত্র নির্মাতারা নিজেদের বক্তব্যকে প্রকাশ করার জন্য এভাবে নতুন নতুন ভাষার ব্যবহার করেন। এটা কিন্তু খুব দারুণ ব্যপার।

জাকী:  ভেতরে আমার যা এসেছে, প্রযুক্তি যদি আমার করায়ত্ব থাকে তাহলে সাফল্য আসে। ঋত্বিক ঘটকের কথাতেই আসা যাক। ওয়াইড লেন্সের ব্যবহার করে তিনি একটা ব্যাপ্তি আনলেন। প্রয়োজনেই করেছেন। তিনি বিশ্বটাকে সেভাবেই দেখতেন। আমি একটা শর্টফিল্ম দেখেছিলাম,  সেটার নাম আমার মনে নেই। পুরোটা ২৫০ এমএম টেলিলেন্স দিয়ে করা। অর্থাৎ পার্সপেক্টিভ বলো, ডেপথ বলো, কিছুই নেই। একটু এদিক-ওদিক হলে আউট অব ফোকাস হয়ে যাওয়ার ব্যপারটা থাকছে। কিন্তু অদ্ভুত এক জগত তৈরি হচ্ছে। আমরা অনেক কিছুই ক্যামেরার সামনে লাগাচ্ছি, আসলে আমি কী চাচ্ছি সেটাই ইম্পরট্যান্ট।

 

রিবেরু: ডগমা ফিল্মের কথা যদি বলি, তারাও তো এক ধরনের ভাষা তৈরির চেষ্টা করছে।

জাকী: এটার পেছনে সমাজ সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার ব্যাপারগুলো রয়েছে। আমি চলচ্চিত্রকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করব নাকি অন্য কিছু হিসেবে ব্যবহার করব ইটস আপটু মি।  তবে আরোপিত হওয়া ঠিক নয়, তাতে ক্লিশে হয়ে যায় আলটিমেটলি। আমাদের দেশে সমস্যা যেটা হয়েছে এই মাধ্যমটি যখন এলো আমাদের দেশে, তখন কিন্তু নিছক একটা বিনোদন মাধ্যম হিসেবে এসেছিল। আমাদের বিগিনিং কিন্তু খুব ভালো ছিল। জহির রায়হান কিংবা সালাউদ্দিন সাহেব, যাদের পেছনে শিল্প-সংস্কৃতি রয়েছে। তারা এসেছিলেন। তো এই যাত্রাটা ভঙ্গ হলো। একসময় তো মাফিয়া চক্রের হাতে চলে গিয়েছিল চলচ্চিত্র। এবং এখনো আছে। সেজন্য চলচ্চিত্রের ভাষা এক জায়গায় থেমে আছে। একটু করুণ কিছু হলেই এক ধরনের মিউজিক যেতে হবে। তো দিস আর দ্য থিংস যেগুলো আমাদের বিক্ষিপ্ত করছে। তবে তোমাদের মতো, তোমরা যখন এসেছো, এটাকে একটা মর্যাদার আসন দিয়েছো, এবং আজকে যে প্রশ্নটা করলে, প্রশ্নটা আমরা যখন প্রথম এলাম, সেই সত্তরের দশকে, চলচ্চিত্রে পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণ নিয়ে, তখন কিন্তু প্রশ্ন করার মতো মানুষ খুব কম ছিল। আলমগীর কবির ভাইয়ের মতো কজন ছিলেন যারা এ প্রশ্ন করতে পারতেন। কিন্তু প্রথম যখন কোর্সটা হলো—মোরশেদ, তারেক মাসুদ, মানজারে হাসীন মুরাদ, তানভীর মোকাম্মেল—দেখা গেলো এরাও প্রশ্ন করতে শিখছে আস্তে আস্তে। আল্টিমেটলি উত্তরগুলোও তাদের পর্দায় চলে এসেছে। আমি কিন্তু মোরশেদের ছবি দেখে বলতে পারব যে এটা মোরশেদের ছবি। তানভীরেরটা দেখে আমি বলতে পারব। আভাস তো থাকবেই। আমি ক্লাসে পড়াই। একটা মেয়েকে আমি ছোট সংলাপ দিয়ে দিই। বলি- কাউকে বলবে না, যাও এটা মুখস্থ করো। একটা ছেলেকে বলি মুখস্থ করো, তোমরা হচ্ছো প্রেমিক প্রেমিকা। মুখস্থ করে আসো। এক্সপ্রেশনগুলো তৈরি করো। এলো যখন তখন আমি পাশাপাশি বসালাম। ওরা রেডি, একেবারে রেডি হয়ে এসেছে ওরা। এক্সপ্রেসন দিতে গিয়ে কী করব- প্রত্যেকে ১০০ রকমের চিন্তা করে এসেছে। আমি বললাম, সব বাদ দিয়ে ওদের হাত দুটির শট নাও। একটা হাত এসে আরেকটা হাতের উপর পড়ল। তাহলে কী হলো? এই যে পেছনে আমি এতগুলো কাজ করেছিলাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি—এটা রূপান্তর হয়ে গেল একটা হাতের উপর আরেকটা হাত এসে পড়ার ভেতর। আর কিছু লাগে? আর কিছু লাগে না। তো এই জায়গাগুলো যদি আমরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারি, তাহলে নতুন প্রজন্ম সুবিধা পাবে। আবার অসুবিধাও আছে। তবে অতিরিক্ত ফ্রিডম পেলে ক্ষতি হয়ে যায়। তবে আমি পজিটিভ দিকটাই দেখব; বলব—করুক।