• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১, ২০২১, ১০:১২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১, ২০২১, ১০:১৯ পিএম

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি আরো কঠিন হয়ে গেল : ড. আকমল হোসেন

মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) নেত্রী অং সান সু চি এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিনতসহ শাসক দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে আটক করেছে সেনাবাহিনী। এই সেনা অভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাগরণের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আকমল হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুব্রত চন্দ


জাগরণ: মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান অং সান সু চি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

ড. আকমল হোসেন: আমি খুবই খারাপভাবে এটাকে দেখছি। কারণ অং সান সু চি দ্বিতীয়বারের মতো সদ্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং তিনি ক্ষমতা নেওয়ার পথেই ছিলেন। আর যে প্রেসিডেন্ট তিনিও তার দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। সম্ভবত তিনি সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাও বটে। ফলে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এদেরকে গ্রেপ্তার করা মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়নের যাত্রাকে কঠিন করে তুললো।

জাগরণ: এর ফলে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ড. আকমল: আমি মনে করি, প্রত্যাবাসন বিষয়টি আরো কঠিন হয়ে গেল। এমনিতেই আমরা মিয়ানমারকে দেখলাম, ২০১৭-তে ঘটনাটির যখন জন্ম হয়েছে, তখন থেকে তারা বিভিন্ন কথাবার্তা বলেছে বাংলাদেশের সাথে। বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ আলোচনা, কূটনৈতিক সংলাপ করেছে বা সমঝোতা করেছে। ২০১৭-তেই একটি চুক্তি করেছিল রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু কিছুই হয়নি। অর্থাৎ মিয়ানমার তার কথা এবং কাজকে মিলাতে পারেনি।
মিয়ানমার বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছি, তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। তারপর তারা রাখাইনে এমন পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি যে, রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে আত্মবিশ্বাসী হবে। সুতরাং মিয়ানমার ইচ্ছাকৃতভাবেই এই কাজগুলো করে। কারণ মিয়ানমারের বর্তমান যে শাসকগোষ্ঠী; শুধু সামরিক বাহিনী বলবো না, বেসামরিক শাসক অং সান সু চি বা তার দলের লোকজন সবাই একইভাবে রোহিঙ্গাদের কোনো মানুষ বলে মনে করে না— নাগরিক হিসেবে স্বীকার করা তো দূরের কথা। তাদের যে সর্বনিম্ন মানবাধিকার, সেটুকুও তারা দেয় না। সুতরাং তারা সমস্যা সমাধানের জন্য খুব সহজ উপায় বেছে নিয়েছিল, বাংলাদেশের দিকে এদের ঠেলে দেওয়া। এরা ধর্মে মুসলমান আর এরা বাঙালি।
তার মানে মিয়ানমারের যে শাসকগোষ্ঠী, তারা শুধু রোহিঙ্গা না, সেখানে আরো যেসব জাতিগোষ্ঠী আছে, তারা পরিচিতি ধারণ করুক সেটা চায় না। যার ফলে অনেক জায়গায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লড়াই আছে। এমনকি রাখাইনে আরাকান আর্মি নামের একটি সশস্ত্র সংগঠনের সাথে তারা গত কয়েক মাস আগেও যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। সেই দিক দিয়ে রোহিঙ্গাদের তারা স্বীকারই করে না। তারা তাদের নিজ ভিটামাটিতে থাকুক, সেটা চায় না। ফলে তাদের ঠেলে দিয়েছে। ঠেলে দেওয়ার পরও প্রত্যাবাসনের নাম করে কূটনৈতিক আলোচনার কথা বলে তারা আসলে সময় নষ্ট করে। আমি বলবো তারা মিথ্যা কথা বলে। অর্থাৎ তারা কূটনৈতিকভাবে অনেক কথা বলে। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন করে না। কিন্তু ইদানীং তারা বলছিল যে, তারা তাদের কিছু লোককে ফেরত নেবে। কয়দিন আগে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে যে বৈঠক হলো, সেখান থেকে বাংলাদেশ পক্ষ একটা ধারণা করলো রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার রাজি হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ বলতে পারতো আসলে তারা সেটা করতে যাচ্ছিল কি না? এখন যখন সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, আমি মনে করি ওই পরিচ্ছেদ বন্ধ করে রাখতে হবে। কারণ সামরিক জান্তাদের ভেতরে কোনো মানবিকতা তো নেই। তারা ন্যায়-নীতিরও শ্রদ্ধা করে না, মানে না। তারা তাদের স্কুল মাধ্যমে যে শাসন ক্ষমতা নিল, সেই শাসনকে তাদের সংহত করতে হবে, নিজের দেশের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করতে হবে। সুতরাং সেখানে তারা রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা করা বা কোনো পদক্ষেপ নেবে— এটা আমি মনে করি সম্ভব না।

জাগরণ: তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে সু চির সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশে যে চুক্তি হয়েছে সেটা আর বাস্তবায়ন হচ্ছে না?

ড. আকমল: না সম্ভব হচ্ছে না। মানে, এই ধরনের কূটনীতিতে সামরিক জান্তা যাবে বলে আমি মনে করি না। কারণ সামরিক জান্তা কখনোই কোনো ধরনের সমঝোতার মধ্যে যেতে চায় না। তাদের শাসনের মূল ভিত্তিটাই হচ্ছে গায়ের জোর। তাদের শাসনের মূল ভিত্তিটা হলো, যেখানে বন্দুক, সেখানে তারা আলাপ-আলোচনার পরোয়া করে না। ফলে এখানেও তারা পরোয়া করবে না।

জাগরণ: এক্ষেত্রে আমাদের কী করণীয় বলে আপনি মনে করেন?

ড. আকমল: বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এই মুহূর্তে মিয়ানমারকে প্রস্তাব দিলেও মিয়ানমার কোনো ধরনের ইতিবাচক সাড়া দেবে বলে আমি মনে করি না। সাড়া দেওয়ায় মতো মানসিকভাবে তারা প্রস্তুতও না। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ এতদিন যা করেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানাতে হবে। আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের দিকে মনোযোগী হতে হবে। অথবা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তদন্ত শুরু করেছে, সেখানে বাংলাদেশ সাহায্য করতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে এখন অপেক্ষা করতে হবে, শেষ পর্যন্ত সামরিক শাসনটি কীভাবে রূপায়িত হয়? অর্থাৎ এখানে সামরিক জান্তা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাটাকে ধরে রাখতে পারবে, নাকি তাকে একটা প্রতিরোধের সম্মুখিন হতে হবে? কারণ মিয়ানমারের অং সান সু চি তার মানুষকে আহ্বান করেছেন, রাস্তায় নেমে আসতে। অর্থাৎ, এই সামরিক শাসন জারি করার পর লোকজন ঘরে বসে থাকবে বা তার দলের নেতাকর্মীরা যদি ঘরে বসে থাকে, সেটা তাদের রাজনৈতিক পরাজয়, তাদের অস্তিত্বের সংকট হবে। ফলে তারা যদি গণআন্দোলন ও গণপ্রতিরোধকে জোরদার করতে পারে, তাহলে সামরিক জান্তা একটা ধাক্কা খেতে পারে। সেই ক্ষেত্রে পরিস্থিতি হয়তো পরিবর্তন হবে। তার মানে সামরিক জান্তা পক্ষে আসছে, এ ধরনের অবস্থান ধরে রাখা নাও সম্ভব হতে পারে। বাংলাদেশ এ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রেখে নিশ্চয়ই নীতি তৈরি করবে।

জাগরণ: সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পরে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোতে সার্বিকভাবে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ড. আকমল: মিয়ানমারের প্রতিবেশী বলতে আমরা, ভারত, চীন এবং থাইল্যান্ড আছে। কিন্তু উপমহাদেশের মধ্যে আমরা আর ভারত। ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক ভালোই। তাদের সঙ্গে মিয়ানমারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে। ভারতের ওইখানে একটা অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে বলেই তারা মিয়ানমারের সাথে ভালোভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে রেখেছে। এখন ভারত হয়তো সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা করবে। কিন্তু তাই বলে ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কে খুব বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না। এটা চীনের ক্ষেত্রে আরো বেশি করে সম্ভব। কারণ মিয়ানমারের ওপর চীনের যথেষ্ট পরিমাণ প্রভাব আছে। চীনের সেখানে বড় স্বার্থ আছে। ফলে এ দুটো দেশ মিয়ানমারের ওপর তেমন কোনো চাপও তৈরি করবে না। ফলে সম্পর্কেও তেমন পরিবর্তন হবে না।
মিয়ানমারের আরেক প্রতিবেশী থাইল্যান্ড। তারা আশিয়ানের সদস্য। এখন তারা আশিয়ানের মাধ্যমে কী অবস্থা নেয় সেটা বরং গুরুত্বপূর্ণ হবে। তার মানে, সামরিক বাহিনী যে একটা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করলো, সেটা কীভাবে থাইল্যান্ড দেখবে? যদিও থাইল্যান্ড নিজেও সামরিক বাহিনী দ্বারা শাসিত। দেশটির বর্তমান শাসক নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে অভ্যুত্থান করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। এ নিয়ে কয়েক মাস আগেও থাইল্যান্ডে বিক্ষোভ হয়েছে। ফলে সেদিক দিয়ে মিয়ানমারের এ বিবর্তনে থাইল্যান্ডেরও অখুশি হওয়ার কথা না। কিন্তু আশিয়ানের আরো যেসব রাষ্ট্র আছে, যেখানে রাজনৈতিক সরকার বিদ্যমান বা নির্বাচিত সরকার বিদ্যমান, তাদের অনুভবটা কী দাঁড়াবে বা মিয়ানমারের ওপর প্রভাব তৈরি করতে তারা কতদূর আশিয়ানকে ব্যবহার করতে পারব—সেটা দেখবার বিষয়।